রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পিএইচডি নিয়ে জাল-জালিয়াতি উচ্চ শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

মাদরাসা-স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় যে পর্যায়ের শিক্ষকই হোক না কেন, তাঁদের কারো কারো অনৈতিক অপকর্ম সম্পর্কে লিখতে গেলে কলম আটকে যায়। নিজের কাছে নিজেকে হেয় হতে হয়। তারপরও অনেক শিক্ষাগুরুর অনাকাক্সিক্ষত অপকর্ম যেভাবে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়, তাতে দায়িত্ববোধ থেকে না লিখে পারা যায় না। শিক্ষকদের কেউ কেউ যখন নম্বর বাড়িয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়, টেন্ডারবাজির টাকা ভাগযোগে যুক্ত হয়, জাল সনদে চাকরি-পদোন্নতি পায়, নকল থিসিস দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রীধারী হয়, তখন লেখার উপলক্ষ সৃষ্টি হয়। গত কয়েক বছর ধরে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটনা সাধারণ মানুষও লজ্জিত হয়েছে।

নানা ধরনের অন্যায়-অনৈতিক কাজে শিক্ষকদের জড়িয়ে পড়া যেন এখন তেমন কোনো ঘটনা নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষকের রাজনৈতিক দলাদলি ও অপকর্ম দলীয় কর্মীকেও হার মানাচ্ছে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের অপকর্ম বেশি হচ্ছে। সাধারণ শিক্ষকদের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের কারো কারো অনিয়ম-দুর্নীতি ও দলবাজির যেসব তথ্য প্রকাশিত হয় তা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। শিক্ষাগুরুদের অনেকের এমন অপকর্মের মধ্যেই স¤প্রতি গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে এসেছে গবেষণাকর্মে কয়েক জন শিক্ষকের চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে পদাবনতির খবর। তাও হয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুককে নকলের অভিযোগে পদাবনতি দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নিজস্ব জার্নাল সোশ্যাল সায়েন্স রিভিউয়ে সামিয়া ও মারজান যৌথভাবে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সাবজেক্ট অ্যান্ড পাওয়ার’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে পাঁচ পৃষ্ঠার মতো হুবহু তারা নকল করেন। এ ছাড়াও ওই নিবন্ধে তারা অ্যাডওয়ার্ড সাঈদের ‘কালচার অ্যান্ড ইমপেরিয়ালিজম’ গ্রন্থের কয়েক পাতা হুবহু কপি করেন। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সামিয়া জামানকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদাবনতি করে সহকারী অধ্যাপক করেছে। আগামী দুই বছর তিনি পদোন্নতির আবেদন করতে পারবেন না। মারজান এখন শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। অন্যদিকে পিএইচডি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির জন্য সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুককে পদাবনতি দিয়ে প্রভাষক করা হয়েছে। ২০১৮ সালে সিন্ডিকেটের এক সভায় তার ডিগ্রী বাতিল করা হলেও তখন তাকে কোনো একাডেমিক শাস্তি দেয়া হয়নি। এদিকে সামিয়া রহমান একজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। খবর পাঠ ছাড়াও সংবাদ বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনায় অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখেন তিনি। ন্যায়নীতি-সত্যের পক্ষে সোচ্চার অথচ তিনিই কিনা কর্মজীবনে চৌর্যবৃত্তিতে আসক্ত। এই শিক্ষকরা এখন কিভাবে মুখ দেখাবেন তাদের ছাত্র-ছাত্রী বা সহকর্মীদের কাছে?– অবশ্য এমন প্রশ্ন উঠলেও তাদের মুখ দেখাতে কোন সমস্যা হয় না। তাদের মুখ দেখানোরও কিছু নেই। নানা ঘটনায় বদনামের ভাগিদা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ বাঘা বাঘা অন্য শিক্ষকরাও নিয়মিত মুখ দেখাচ্ছেন। টক শোতে বড় বড় কথা বলছেন। জাতিকে জ্ঞান দিচ্ছেন। কোন সমস্যা হচ্ছে না। কিছু শিক্ষকের নিজ দায়িত্বে উদাসীন থেকে অন্য কাজে মনোযোগী হওয়ার অনৈতিক কাজ এখন যেন আর অপরাধের মধ্যে পড়ে না। এই প্রবণতা এখন অনেক জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেও রয়েছে। এই শ্রেণীর কাছে মান-সম্মানের বিষয়টি আপেক্ষিক। কারো কাছে যেটা অসম্মানের, সেটাই আবার কারো কাছে সম্মানের হয়ে পড়েছে।

ঢাকার নীলক্ষেতে বেশ কিছু দোকানে নিয়মিত গবেষণাপত্র বেচাকেনা হয় বলে শোনা যায়। দোকানগুলোতে চুরি করা গবেষণাপত্র তথা থিসিস বিক্রি হয়। ¯œাতক ও ¯œতকোত্তর পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী পানির দরে তা কিনে নিজের গবেষণা হিসেবে জমা দেয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের থিসিস, মনোগ্রাফ নীলক্ষেতের এই দোকানগুলোতে প্রিন্ট ও বাঁধাই করাতে এলে কৌশলে তা কপি করে রেখে দেয়া হয়। পরবর্তীতে তা অন্য কোন শিক্ষার্থীর কাছে বিক্রি করা হয়। ফটোকপির দোকানে সহজলভ্য হওয়ায় অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে গবেষণা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ। শিক্ষকরাও এ থেকে পিছিয়ে নেই। দেশের এক্সক্লুসিভ বা বিশেষায়িত বিদ্যাপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি কারসাজির খবরও গণমাধ্যমে এসেছে বেশ কিছুদিন আগে। পিএইচডি গবেষণা কোন ছেলেখেলার বিষয় নয়। ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে জাল-ভেজাল থিসিস তৈরি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। এতদিন শোনা গেছে, রাজনৈতিক স¤পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এখন পিএইচডিও বাদ যাচ্ছে না। এ ধরনের প্রবণতা বন্ধ না হলে এক সময় সারাদেশ লাখ লাখ তথাকথিত পিএইচডিধারীতে ভরে যাবে। এমনিতেই পিএইচডি ডিগ্রী নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা সমাজে প্রচলিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েও কথাবার্তা রয়েছে। কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রীর খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। অনলাইনে করা পিএইচডি ডিগ্রীর বাজারও এখন দেশে রমরমা। আবার কোনো লাজ-লজ্জার বালাই না করে একশ্রেণীর লোক নামের সঙ্গে ডক্টর লিখে ঘুরে-বেড়াচ্ছে। পিএইচডি যে একটি দীর্ঘ গবেষণার ফল তা তারা জানে না। যেখানে বছরের পর বছর লাইব্রেরি ঘেঁটে, ফিল্ড ওয়ার্ক করে গবেষণা কাজটি শেষ করতে হয়, সেখানে কিছু লোক তা না করে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে কোনো সংস্থা থেকে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে তা নিজের নামের সাথে জুড়ে দিচ্ছে। সমাজে তথাকথিত সুশীল সেজে বুক ফুলিয়ে চলছেন। অভিযোগ রয়েছে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এতদিন শুধু সার্টিফিকেট বিক্রি করত। এখন তাদের কেউ কেউ ন্যায্যমূল্যে পিএইচডি ডিগ্রিও বাজারজাত করছে। সেই ডিগ্রী দিয়ে দেশে কতো শিক্ষক গজাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। ফলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ফলাফল যা হবার তাই হচ্ছে।

শিক্ষকতা শুধু একটি বৃত্তি বা পেশা নয়, বরং এটি একটি আরাধনা। আদর্শ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। শিক্ষক সমাজ একটি দেশের সামগ্রিক অবকাঠামো গঠনের প্রধান হাতিয়ার। সমাজে আলোকিত মানুষ গঠনে একজন শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। আর আলোকিত মানুষ তৈরি করার মাধ্যমেই কেবল গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গঠন সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশেষ করে ডিগ্রী, গবেষণাপত্র এখন জাতির কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ঘেঁষা নীলক্ষেতের রেডিমেইড নোটশিট দিয়ে একসময় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা সারতো। এখন কেউ কেউ সেখানকার গবেষণাপত্র দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রী নিচ্ছেন বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তাহলে, এই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের কী পড়াচ্ছেন? কী পড়াবেন? আমাদের সন্তানরাই বা কী শিখছে? বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞান সৃষ্টি, আহরণ ও বিতরণ কেন্দ্র। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় বিচরণ করে নিজেদের সৎ, যোগ্য, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতো প্রত্যয় নিয়ে। অথচ এখন বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের যে অধঃপতন শুরু হয়েছে, তা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে।

শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদÐ। আর সে মেরুদÐ গড়ার কারিগর শিক্ষক। সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবেন, এটিই শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা। কিন্তু, এই প্রত্যাশাটা হতাশায় ডুবতে বসেছে। আমারা জানি, মেধাবী মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নবাজ। কিন্তু সেই স্বপ্নের চ‚ড়ায় পৌঁছাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিছু জ্ঞানপাপী তথাকথিত শিক্ষক। ক্ষমতা-অর্থের কাছে নৈতিকতা ও আত্মমর্যাদা বিকিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে যখন কাউকে শিক্ষক বানানোর মতো অনৈতিক কাজ করা হয়, তখন তা শুধু অপরাধই নয়, বরং আরেকটি মেধাবী ও যোগ্যতম প্রার্থীকে বঞ্চিত করা। মেধার বদলে রাজনৈতিক পরিচয়, পারিবারিক স¤পর্ক ও অন্যন্য অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবার মাপকাঠি হওয়ার অপসংস্কৃতি গোটা জাতির জন্য অমর্যাদাকর। সামিয়া রহমান, মাহফুজুল হক মারজান বা মুহাম্মদ ওমর ফারুক এখানে উদাহরণ মাত্র। এইসব অপরাধের জন্য তদন্ত কমিটি হয়। কখনও বা সেই তদন্ত কমিটি হারিয়েও যায়। আবার কখনও বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ও প্রশাসনের দ্বারা নামকাওয়াস্তে শাস্তি হয়। তবে এক পর্যায়ে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Jack+Ali ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১১:৫৫ এএম says : 0
If our country rule by Our Creator The Al-Mighty Allah then people will not dare to commit any kind of corruption.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন