শরীফুর রহমান আদিল
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় যা ২০০৫ সালে ঞযব ঔধমধহহধঃয ঈড়ষষবমব অপঃ, ১৯২০ (অপঃ ঢঠও ড়ভ ১৯২০) বিলুপ্ত করে একে একটি প্রকল্পের অধীনে ২০ অক্টোবর ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় জাতীয় সংসদে। সেই থেকে এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার ৪ বছর পর শিক্ষার্থীদের বেতন এবং সেমিস্টার ফি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে ২৭/৪ ধারা নামক কালো আইনের কথা। যাই হোক, অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে সেই ২৭/৪ ধারা বাতিল হলো, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের কল্যাণে একই ধারা থেকে রক্ষা পেল আরো দুটি বিশ্ববদ্যালয়। ২৭/৪ ধারা থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তি পেলেও সুলভ মূল্যে ক্যান্টিনে মানসম্মত খাওয়ার, গবেষণা খাতে অপর্যাপ্ত বাজেট, সেমিস্টার ফি কমানো, পরিবহনসহ আবাসিক হলের সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আর এ কারণেই বছরের পর বছর রাজপথে নেমে আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্ষন্ত শিক্ষার্থীরা তাদের এসব অধিকারের সাথে বেদখলকৃত হলসমূহ পুনরুদ্ধারসহ নতুন হল নির্মাণের জন্য বিভিন্ন সময় আন্দোলন চালিয়ে আসলেও ৭ বছরেও তাদের এ দাবীটি আদায় হয়নি। আর এ যাত্রার সবচাইতে বড় আন্দোলনটি সংগঠিত হয় ২০০৯ সালের ২৭ জানয়ারি, তখন পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয় ২৯ দিনের জন্য। তখন থেকেই এই দিনটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের “হল আন্দোলন দিবস” হিসেবে পালন করে আসছে শিক্ষার্থীরা।
একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছে সরকার কিন্তু জগন্নাথের দিকে চোখ নেই কেন? জোট সরকারের শাসনামলে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে কি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সরকার কোন অবদান রাখবে না? দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দেখলে সেখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও আসে, আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বললেই আমাদের মনে ভেসে আসে গবেষণা, উন্নত ও পযাপ্ত বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরী, ছাত্র-শিক্ষকের জন্য আবাসিক হল, সুলভে মানসম্মত খাওয়ার ক্যান্টিন, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, প্রশস্ত খেলার মাঠ, উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহনের ব্যবস্থাসহ আরো অনেক। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও কি আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে? কেন তারা এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত? অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সমস্যার সমাধান না করে সরকার আরো নিত্যনতুন পাবলিক বিশ্ববিদালয় গড়ে তোলার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে! সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর জন্য সরকার যত টাকা বরাদ্দ দেয় এই বিশ্ববিদ্যাললয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও একই বাজেট দেয়ার কথা কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্যকিছু যা গত ১২ বছরের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে বাজেট দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায়। অথচ গত ১২ বছরে জগন্নাথ স্বল্প সুযোগ- সুবিধা নিয়ে যে ধরনের বিপ্লব ঘটিয়েছে তা উন্নত বিশ্বে একটি রোল মডেল হয়ে থাকবে। জগন্নাথই ছিল প্রথম কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যা সকল বিভাগে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করে যা আস্তে আস্তে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োগ করছে। জগন্নাথই প্রথম কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যারা কর্মঘণ্টা ঠিক রেখে সপ্তাহিক দুইদিন বন্ধের রীতি চালু করে আর এর দেখাদেখি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এটি প্রচলন করছে। অথচ বাংলাদেশের এমনকি বিশ্বেও রোল মডেল হওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এত বঞ্চিত? এত নির্যাতিত?
অথচ এ প্রতিষ্ঠানটি দেশের ক্রান্তিলগ্নে তথা, ভাষা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সবসময় পাশে ছিল এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৯২ প্রষ্ঠায় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবদানের কথা তুলে ধরে বলেন- সকল আন্দোলন পরিচালিত হতো জগন্নাথ কলেজ থেকেই। এছাড়াও ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া বরকত এই কলেজের হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে এ কলেজের অবদান ছিল সর্বাধিক কেননা, জগন্নাথের আন্দোলনের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য এখানেই স্থাপিত হয়েছিল পাক হানাদারদের ক্যাম্প, যে প্রতিষ্ঠান দেশ-জাতির জন্য এত অবদান রাখল তারা কি এখনো বঞ্চিত থাকবে? আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত জগন্নাথ কি কেবল আন্দোলন-সংগ্রাম এগুলোই করবে? তাদের কি সফলতার মুখ দেখানো হবে না? অথচ এই প্রতিষ্ঠানের আন্দোলনের ফলে স্বাধীনতা অর্জন করলেও তারা স্বাধীনতার স্বাদ পাচ্ছে না! আবার, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময় এই কলেজের জার্নাল, লাইব্রেরির অর্ধেক বই, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে এই কলেজকে ¯œাতক শ্রেণীকে অবনমিত করা হয়। আর তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একটি আবাসিক হলের নামকরণ করে জগন্নাথ হল নামে। আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এখন থাকার জন্য আন্দোলন করতে হয়! জানি না এইভাবে পৃথিবীর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল নির্মাণে এরকম আন্দোলন-সংগ্রাম কিংবা পুলিশের টিয়ারশেল আর রাবার বুলেট খেতে হয়েছে কিনা। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের আবাসিক হল নির্মাণে আন্দোলন করতে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলকৃত হলগুলোর মধ্যে ২টি ছাড়া বাকিগুলো উদ্ধারে কার্যত উদ্যোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসিসহ পরবর্তীতে বিভিন্ন কমিটি করে দিয়ে যেটুকু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল তাও প্রশাসনের গাফিলতির কারণে আলোর মুখ দেখছে না। আবার নতুন হল নির্মাণের কোন উদ্যোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ছোট হওয়ায় এতদিন বলা হয়েছিল হল নির্মাণের পর্যাপ্ত জায়গা নেই কিন্তু যখন ছাত্ররাই সমাধানের পথ বের করে দিল তখন এতে বাদ সাধার কি আছে? নাজিমউদ্দিন রোড়ের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জ স্থানান্তরিত হওয়ার পর ছাত্ররাই প্রথম দাবি উত্থাপন করলো সেখানে জাতীয় চার নেতার নামে বিশ্ববিদালয়ের আবাসিক হল নির্মাণ করা হোক, সেখানে বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম করা হোক, করা হোক একটি পার্ক যা সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকবে আর এটি পরিচালনা করবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যদিও সরকারের একই ধরনের ও একই নামে ভবন তৈরি পরিকল্পনা আছে কিন্তু তা পরিচালনা করার কথা ছিল সিটি কর্পোরেশন কিন্তু তার পরিবর্তে তা পরিচালনা করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পার্থক্য শুধু এটাই।
অন্যদিকে সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের নিদর্শন হিসেবে একটি ভবন সংরক্ষিত রাখা যেতে পারে। জাতীয় চার নেতার নামে আবাসিক হল নির্মাণ করে বঙ্গবন্ধুর নামে জাদুঘর করে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পরিচালনা করার জন্য দিলে এর মহত্ত্বতো আরো বৃদ্ধি পাবে। তবে অনেকে পুরনো ঢাকার মানুষদের জন্য একটি পার্ক গড়ে তুলে সেখানে তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করার কথা বলছে আর এতেই তাদের আপত্তি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালযের অধীনে পার্ক করলে তাতে কি সাধারণ মানুষ আসেত পারবে না? সাধারণ মানুষ যাতে আসতে পারে সে ব্যবস্থা করে ছাত্রাবাস-মিউজিয়াম তৈরির উদ্যোগ নিলেই হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে তাকালেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কি ঐতিহাসিক স্থান নয়? কিন্তু এটা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন হওয়ায় সেখানে কি সাধারণ মানুষ তাদের বিনোদন কিংবা ক্লান্তি নিরাময় করতে যেতে পারছে না? ভিক্টোরিয়া পার্ক কি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নয়? এই পার্কে কি সাধারণ মানুষ প্রবেশ করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না?
তবে পুরান ঢাকার মানুষের বিনোদনের স্থানের কথা বলে একে বিরোধিতা করার কি আছে? তবে আমাদের মনে রাখতে হবে এই আন্দোলন ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন, এই আন্দোলন বঞ্চিত থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলন, এই আন্দোলন অধিকার আদায়ের আন্দোলন, এই আন্দোলন সমতা বিধানের আন্দোলন আর এই ধরনের আন্দোলনের প্রবক্তাতো ছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু আর তার কন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে শিক্ষার্থীদের কাফনের কাপড় আর রক্ত ঢেলে রাজপথে নামছে এটি সত্যিই বেদনাদায়ক। একদিকে সারাদেশে জঙ্গি হামলার পর সারাদেশের মেসগুলোতে পুলিশের অভিযান অন্যদিকে ব্যাচেলরদের বাসা পেতে সমস্যা সর্বোপরি, কৃষক বাবার আর্থিক অনটন সবমিলেই এক করুণ অবস্থায় দিন পার করছে জবির মেধাবী শিক্ষার্থীরা অথচ বিসিএসে এবার ২য় হওয়া ছাড়া গত ২-৩ বছর যাবৎ এসআই বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারি ব্যাংক এবং পিএসসির সকল পরীক্ষায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ১ম তথা সর্বাধিক নিয়োগ পেয়ে আসছে পরিসংখ্যান দেখলেই এর সত্যতা বেরিয়ে আসবে। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালযের ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতা ভুগবে, এই বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষার্থীরা পুলিশের বুটের আঘাত সহ্য করবে তা কি লজ্জাস্কর নয়? সুতরাং উপর্যুক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে প্রধানমন্ত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল নির্মাণ, পরিবহন, ক্যান্টিন, গবেষণায় অমনোযোগিতা, সমাবর্তন সমস্যাসহ সকল সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিবেন- এই প্রত্যাশা সকলের।
ষ লেখক : জবির দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন