মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

ইসলামে নৈতিকতা ও অমুসলিমের অধিকার

প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ
দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, বর্তমানে কেউ কেউ নীচতা-হীনতায় ইতর প্রাণীর চেয়েও জঘন্য! আফসোস ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ মানুষ কেন এমন হয়! এখানেই পবিত্র কুরআনের বাণীর নিত্যতা ‘উলাইকা কাল আনআম্ বাল হুম আদ্বাল অর্থাৎ ওরা তো পশু বরং তার চেয়েও অধম’। মহান আল্লাহ আরো বলেন “তুমি কি বধিরকে শোনাতে পারবে...” (যুখরুফ: ৪০)? দৈহিক, জৈবিকতাড়না, বৈশিষ্ট্য ও স্বাভাবিকতায় মানুষ ও ইতর প্রাণীর মধ্যে প্রভেদ হলো: ইতর প্রাণীর যোগ্যতা প্রক…তিগত, অন্যদিকে মানুষ তার যোগ্যতার মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. আ. ন. ম. রইছউদ্দিন বলতেন “মানবতা ও নৈতিকতাহীন মানুষ চেহারায় মানুষ হলেও প্রক…ত মানুষ নয়”।
অন্যদিকে প্রকৃত বান্দার বৈশিষ্ট্য বিনয়। তাই সামান্য সাফল্য বা অর্জনে ও আত্মগর্বে অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মনুষ্যত্বের পরিপন্থি। মহান আল্লাহর নির্দেশ “ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ করো না, তুমি কখনোই ভূপৃষ্ঠকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বতপ্রমাণ হতে পারবে না” (বানী-ইসরাইল: ৩৭)। মহান আল্লাহরই নির্দেশ “অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না...” (লুকমান: ১৮)। অথচ সৃষ্টির সেরা মানুষ স¦ার্থের জন্য হয় হিংস্র, সশস্ত্র এবং ঘাতক অথবা আত্মঘাতীÑ আবার এ মানুষই নিজের স্থিতি ও সাফল্যের কারণে হয় অহংকারী। প্রিয়নবী (স.) বলেন “মারাত্মক বিষয় হলো ... লোভের বশবর্তী হওয়া, আত্মগৌরব করা” (মুসলিম)।
মানবতার ধর্ম ইসলাম, উদার ও সহজপন্থায় বিশ্বাসী। প্রিয়নবী (স.) বলেন “সহজ কর, কঠিন করো না; সুসংবাদ জানিয়ে আহ্বান কর ভীতি প্রদর্শন করে তাড়িয়ে দিও না” (বুখারি)। এজন্যই একটি সভ্য-শান্তির সহাবস্থানপূর্ণ সমাজের চিত্র উড় ঃড় ড়ঃযবৎং ড়হষু, যিধঃ ুড়ঁ ষরশব ড়ঃযবৎং ঃড় ফড় ঃড় ুড়ঁ. এমনই হতে হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘সংখ্যালঘুগণে’র সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ ও দায়িত্বপালনের অধিকার রয়েছে। ধর্ম পালনে ‘ইসলাম’ প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। মহান আল্লাহ্ বলেন “ধর্মের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই” (বাকারা: ২৫৬)। অন্যদিকে বিশ্বনবীর (স.) সুস্পষ্ট ঘোষণা “যে লোক অমুসলিম নাগরিককে কোনরূপ কষ্ট দেবে, আমি নিজেই কিয়ামতের দিন তার বিপক্ষে দাঁড়াবো” (জামে’ সাগীর: ২য় খ. পৃ. ৪৭৩)। ন্যায়ের শাসক হযরত ওমরের (রা.) বিচার-ফয়সালা এজন্যই অনেক সময় তৎকালীন ইহুদি-খ্রিস্টানদের পক্ষে গেছে। ইসলামের সোনালি অধায়ে অমুসলিম নাগরিকগণ মুসলমানদের চারিত্রিক মাধুর্যের কারণেই ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতি অনুরুক্ত হয়েছেন, অভিভূত হতেন। এজন্য তৎকালের দেশীয় রাজ্যের অমুসলিমগণ আরবীয় ইসলামি রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত হবার চুক্তিবদ্ধ হতেন এবং নিরাপদ জাতি গঠনে অবদান রাখতেন।
অমুসলিম নাগরিকগণ ‘রাষ্ট্রীয় আমানত’ তাদের জীবন-সম্পদ একটি সুরক্ষাব্যবস্থা পাওয়ার দাবিদার। মহান আল্লাহ্ বলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তাদের প্রাপকদের পৌঁছে দিতে” (নিসা: ৫৮)।
একটি শান্তি ও সহাবস্থানের সমাজ বিনির্মাণের জন্য হিজরতের পর প্রিয়নবী (স.) সম্প্রীতিমূলক ঝড়পরধষ পড়হঃৎধপঃ-এর মতো এক মহা সনদ প্রণয়ন করেন। যা হলো ঐতিহাসিক ‘মদীনা সনদ’। কেননা, মানবিক সাম্য, সামাজিক শান্তি-ন্যায় বিচার, সমঅধিকার, সুষম বণ্টন ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস তথা স্বীকৃতি ইসলামের বিঘোষিত অঙ্গীকার। আর তা রক্ষা করা মহান আল্লাহ্র আদেশ ও প্রিয়নবীর (স.) আদর্শ। কোন হটকারিতা, অশান্তি, বৈষম্য, বঞ্চনা ইসলামের শিক্ষা নয় বরং নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার একটি ঝঁনসরংংরাব সমাজ বিনির্মাণ ইসলামের প্রাত্যহিক চেতনা।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন, ইসলাম ধর্ম পালনে কোন আপোষ, সমঝোতা, অস্পষ্টতা শিক্ষা দেয় না। প্রিয়নবী (স.)-এর মক্কার জীবনে পৌত্তলিকতা ও ‘তাওহিদে’র আদর্শের বিষয়ে যখন বিধর্মীদের পক্ষ থেকে আপসের প্রস্তাব করা হয় তখনই মহান আল্লাহ্ জানিয়ে দেনÑ (হে রাসূল: বলুন) “তোমাদের কর্মের ফল শুধু তোমাদের, আমার কর্মের ফল আমারই নিজের” ঞড় ুড়ঁ নব ুড়ঁৎ ধিু, অহফ ঃড় সব সরহব : ‘লাকুম দ্বীনুকুম্ ওয়ালিয়া দ্বীন’ (কাফিরুন: ৬)।
প্রিয়নবী (স.) যখন মদীনায় হিজরত করেন (সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রি.) তখন তিনি (স.) পাঁচ ধরনের মানুষ সংশ্লেষের এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখী হন। এরা হলো-মুহাজির, আনসার, ইয়াহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক। তখন নবীর (স.) প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হয় ভ্রাতৃ বিরোধ-বিদ্বেষ, বিগ্রহের অবসান ঘটান। এ লক্ষ্যেই মদীনা সনদের প্রধান অর্জন ছিলÑ (ক) প্রিয়নবীর (স.) নেতৃত্বে শান্তি ও রাজনৈতিক ঐক্য। (খ) তাওহীদভিত্তিক লিখিত সনদের আলোকে সংঘাতের স্থলে সার্বজনীন নিরাপত্তা। (গ) সাম্য ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা। এজন্যই পি কে হিট্টি বলেনÑ ‘রক্তের সম্পর্কের পরিবর্তে ধর্মের শৃংখলায় সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা আরবের ইতিহাসে এই প্রথম’।
ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক নাগরিকের মতো অমুসলিম নাগরিকের রয়েছে- বাঁচার অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, বাক-ব্যক্তিত্বের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ, সংগঠিত হওয়া, ধর্ম পালনসহ অসংখ্য মৌলিক অধিকার। অমুসলিম নাগরিকের ধর্মীয় বিষয়ে কটাক্ষ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। মহান আল্লাহ্ বলেন “যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যকে উপাস্যভাবে তাদের তোমরা গালমন্দ করো না” (আনআম: ১০৮)।
বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মধ্যমপন্থি মুসলিম রাষ্ট্র। এদেশের অমুসলিম নাগরিকগণও আমাদেরই ভাই, বন্ধু-প্রতিবেশী হিসেবে সমান নাগরিকাধিকারের দাবিদার। তাই ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ আমাদের ‘জাতীয় লজ্জা’। পবিত্র কুরআনের শাশ্বত বাণী অনুসরণ করে আমাদের উচিত শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশের উন্নয়নে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করা। মহান আল্লাহ্ বলেন, “দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরোধিতা করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি (হিজরতে বাধ্য করেনি), তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ্ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ্ তো ন্যায়পরায়ণদের ভালবাসেন” (মুমতাহানা: ৮)।
ব¯ুÍত মানবীয় যোগ্যতা ও নৈতিক বৈশিষ্ট্য যখন একজন মানুষের মধ্যে লোপ পায় তখন সে সুদ, ঘুষ, প্রতারণা, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মাদকাশক্তি, মিথ্যাচার, জুলুম ইত্যাদি অনাচারে জড়িয়ে যায়। সঙ্গে ঘটে সংখ্যালঘু নির্যাতন। তাই মনুষ্যত্বের দাবি হলো বিবেক ও আন্তরিকতাÑ যা সামাজিক আস্থা ও জান্নাতি সুখের বাহনÑ
“কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহু দূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক মানুষেতে সুরাসুর।
রিপুর তাড়নে যখন মোদের বিবেক পায় গো লয়
আত্মগ্লানির নরক অনলে তখনই পুড়িতে হয়।
প্রীতি-প্রেমের পুণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়ে ঘরে”।
(শেখ ফজলুল করিম)
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন