এম. জায়েদ হোছাইন ফারুকী
নানা সমস্যায় জর্জরিত আজকের বিশ্ব। সঙ্কটের আবর্তে নিপতিত কোটি কোটি আদম সন্তান। অশান্তির যাঁতাকলে গোটা বিশ্ব মানবতা, হিংসা, জিঘাংসা, মারামারি, হানাহানি গোটা বিশ্বজুড়ে। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি আর নৈতিক অবক্ষয় কুরে কুরে খাচ্ছে মানব জীবনকে। সভ্যতা যান্ত্রিকতায় পরিণত। মানবতা ভূলুন্ঠিত। এহেন দুরবস্থা থেকে মুক্তি নিপীড়িত-নির্যাতিত মানবতা, চায় শান্তি ও মুক্তি। হন্য হয়ে ছুটছে দিকদিগন্তে শান্তির অন্বেষায়। কিন্তু শান্তির নাগাল কোথাও পাচ্ছে না তারা। এ মুহূর্তে মুক্তির মহা সনদ আল-কোরআন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সব সমস্যার সমাধান পবিত্র আল-কুরআনই দিকনির্দেশনা দিচ্ছে গোটা বিশ্ব মানবতাকে।
আমরা শিক্ষা লাভ করছি ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঞবপযহড়ষড়মু-এর যুগে। জ্ঞান অর্জনের জন্য আর মানবতার মুক্তি ও শান্তির নিমিত্তে উচ্চ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করছি একবিংশ শতাব্দীতে কিন্তু সঠিক সমাধান পাইনি কোথাও। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাচ্ছি, এক সেকেন্ডে বিশ্বের সংবাদ নিচ্ছি, মঙ্গল গ্রহ সফর করছি, জ্ঞান বিজ্ঞানে উন্নতির শিখরে আরোহণ করছি, বুক ফুলে সভ্য জাতির দাবি করছি। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতায় রয়েছি কিন্তু ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবনে আদৌ আমরা কি প্রকৃত শান্তি লাভ করতে পেরেছি? না পারিনি। তার মূল কারণ শিক্ষার অভাব না বরং সুশিক্ষার অভাব। আদর্শিক জ্ঞান চর্চার অভাব। দেড় হাজার বছর পূর্বে আল-কোরআনের প্রথম নির্দেশনা ছিল ‘‘পড় তোমার প্রভুর নামে’’। উহাকে আমরা কলেজ-ভার্সিটি আর মাদরাসায় মনোগ্রামে রাখি। বক্তব্য বিবৃতি লেখনীতে শোনাই। চর্চা করি না আল-কোরআন নিয়ে। করি না গবেষণা, কোরআন চর্চাই আমাদেরকে উৎসাহিত করবে মানব কল্যাণে, অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায়। আর এ পৃথিবীতে আল্লাহর রাজ প্রতিষ্ঠার গভীর প্রেরণায় আমরা কুরআন তেলওয়াত করি। কুরআন দিয়ে ঝাড়ফুঁক করি। কুরআনকে ভালোবাসি কিন্তু কুরআন চর্চা করি না, গবেষণা করি না, কুরআন দিয়ে জীবন গড়ি না, করলেও অপর্যাপ্ত, অপ্রতুল। অতীতে আমাদের ইসলামী মনীষী ও গবেষকগণ কুরআন চর্চা করে বিজ্ঞানের অনেক বড় বড় গবেষণার জনক হয়েছে। আল্লামা আলবেরুনী রকেট আবিষ্কারের ফর্মুলা, আল খাওরেজমী, আলফারাবী, আলকিন্দি অঙ্ক আবিষ্কার করেছেন। ইবনে সিনা চিকিৎসা বিজ্ঞানে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কানুন ফিততিব চার লক্ষ পৃষ্ঠা কলেবরে গ্রন্থ রচনা করে বিশ্বে মহাবিপ্লব সৃষ্টি করেছেন। এমন অবদান রেখেছেন যার তুলনা আজও মেলেনি। আমরা সেই কুরআন অনুশীলন, গবেষণা, চর্চা না করে কত যে পিছিয়ে রয়েছি তা কি আমরা খতিয়ে দেখেছি কখনও। আজকের বিজ্ঞানের যত বড় বড় অবদান এর মূল উৎস পবিত্র কুরআন। কুরআন যা দেড় হাজার বছর পূর্বে দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছে আজকের আধুনিক বিজ্ঞান তা সাহস করে বলতে শুরু করেছে সবেমাত্র। যেমন মঙ্গল গ্রহে প্রাণী আছে কি নাই পবিত্র কুরআনের সূরায়ে সুয়ারা ২৯ নং আয়াতে রয়েছে। ভূম-ল নভঃম-লে তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন এমন প্রাণী যারা পা দিয়ে চলে (যেমন মানুষ, গরু, ছাগল)।
কুরআনে করীম হচ্ছে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত প্রতিষেধক, যেমন সূরা বনি ইসরাইলে বর্ণিত আছে, ‘‘আমি এই কুরআনের মধ্যে নাযিল করেছি যা মানুষের জন্য প্রতিষেধক ও বিশ্বাসীগণের জন্য শান্তি দায়ক’’। অন্যদিকে রাসূল (স) বলেছেন; ‘‘মহান আল্লাহ এমন কোন রোগ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেনি যার চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নাযিল করেনি’’ (আল-হাদিস, মেডিসিন অধ্যায়, বোখারী)।
অথচ বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে ‘‘ক্যান্সারের কোন চিকিৎসা নেই’’ অসংখ্য অগণিত মানুষ আজ চিকিৎসার অভাবে অথবা অপচিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। কিন্তু কোরআন হাদিসের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা যদি কোরআন নিয়ে যুগোপযোগী চর্চা গবেষণা করতাম অবশ্যই ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো থেকে বিশ্ববাসীকে পরিত্রাণ দিতে সক্ষম হতাম। আর চর্চা যে করি না এ জন্য কী আমাদেরকে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি
করতে হবে না? নিশ্চয় হবে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বহুবার ঘোষণা দিয়েছেন, ‘‘কেন তারা কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না তাদের অন্তর কী তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে?’’ (সুরা মোহাম্মদ, আয়াত : ২৪)।
পবিত্র কুরআনে ৩৫০টি আয়াত বা মেডিকেল ইন্ডিকেশন রয়েছে। ৭৫০টি আয়াতের সরাসরি বিজ্ঞানের নির্দেশনা দেয়া আছে। কুরআন আধুনিক বিজ্ঞানের উৎস, কুরআন বিজ্ঞানময়। আজকে একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঞবপযহড়ষড়মু-এর যুগ। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় পবিত্র কুরআনই ওহভড়ৎসধঃরড়হ ঞবপযহড়ষড়মু এই মর্মে পবিত্র হাদিস শরীফে দেখা যায় বিশ্বনবী (স) এরশাদ করেন, এমন যুগ আসবে যে যুগে অসংখ্য অগণিত সমস্যা, সঙ্কট, ফিতনা সৃষ্টি হবে। সাহাবা (রা)গণ আরজ করেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ উত্তরণের পন্থা কী? আল্লাহর রাসূল (স) বলেন, উত্তরণের একমাত্র পথ, সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে পবিত্র আল-কুরআন। এতে রয়েছে অতীতের ইতিহাস, ভবিষ্যতের তথপ্রযুক্তি এবং তোমাদের পারস্পরিক সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান ও গাইডলাইন।
সুতরাং বর্তমান যুগে আমাদের সবচেয়ে বেশি করণীয় যা তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন চর্চা, গবেষণা, অধ্যয়ন, প্রচার, প্রসার প্রেস মিডিয়া/ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। লেখনী ও সাহিত্য চর্চা তাফসীর অধ্যয়ন ও উহা প্রসারের মাধ্যমে ঘরে ঘরে আল-কুরআনের আলোকে প্রজ্বলিত করতে হবে।
কুরআন দিয়ে গড়তে হবে ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন। তাহলে কেবল অশান্ত বিক্ষুব্ধ পৃথিবী লাভ করতে পারবে শান্তি/মুক্তি। পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তির সওগাত, রহমতের ফল্গুধারা। নারী পাবে তার হারানো অধিকার ও মর্যাদা। সর্বস্তরের মানুষ ঘুমাবে আরামে। জানমাল, শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সকল প্রকারের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে এ পৃথিবীতে। পৃথিবী হয়ে যাবে জান্নাতের কানন-কুসুম, পরিণত হবে এ ধুলার ধরণী স্বর্গীয় উদ্যানে।
পবিত্র কুরআন আরবী ভাষায় হলেও এর রয়েছে অসংখ্য বাংলায় তাফসীর। তাফহীমুল কুরআন, মাআরেফুল কুরআন, বায়ানুল কুরআন, জোলালুল কুরআন ইত্যাদি বঙ্গানুবাদ চর্চা করুন।
যতই পবিত্র কুরআন চর্চা করা হবে ততই আমাদের সমস্যা সমাধানের পথ সুগম হবে। দূর হবে কুশিক্ষার অমানিশা, অশান্তি, দারিদ্র্য, জঙ্গিবাদ ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এ পৃথিবী থেকে।
সুতরাং মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মানবতার মুক্তির একমাত্র দর্পণ। আসুন একে চর্চা করি, লালন করি, গবেষণা করি। অতীতের ন্যায় গোটা বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পারবে মুসলমানরা। জ্ঞান বিজ্ঞানের ধারক-বাহক হিসেবে তারাই বিশ্বকে শাসন করতে পারবে তাঁদের জ্ঞান দিয়ে, নৈতিক চরিত্র মাধুর্য দিয়ে।
হে তরুণ, হে বন্ধু এসো শান্তির পথে, কুরআনের পথে। পবিত্র কুরআন তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর কোথাও যেওনা, যেওনা হে বিভ্রান্ত তরুণ সন্ত্রাসের পথে, হানাহানির পথে। এসো আল্লাহর পথে, এসো রাসূলুল্লাহর পথে।
মহান আল্লাহ সূরা ইয়াসীনের প্রারম্ভে ঘোষণা দেন, হে মহান নেতা, বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ নিশ্চয় আপনি রাসূলদের (ম্যাসেঞ্জার) অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন সরল সঠিক পথে। মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআনের পথে চলার তৌফিক দিন, আমিন।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন