মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ব্রেজনিস্কির ‘ব্রোকেন চেজবোর্ড’ ‘ইসলাম উইল উইন’

প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, ধর্ম-বর্ণ ও ভৌগলিক সীমারেখার পার্থক্য নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ব ক্রমাগত অস্থির, অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ স্থানে পরিণত হচ্ছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাসমৃদ্ধ পশ্চিমা উন্নত রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের ফ্রান্স-বেলজিয়াম থেকে সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ইয়েমেন বা বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে পড়া সমাজও নিরাপত্তাহীনতা ও সর্বগ্রাসি সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। চরমপন্থি রাজনৈতিক সন্ত্রাস এবং জাতিগত সহিংসতার ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে এসব সন্ত্রাসি কর্মকা-ের মাধ্যমে রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের ব্যাপকভিত্তিক রূপরেখা সাম্প্রতিক বিশ্ব ইতিহাসের অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিমা নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রথম পর্যায়টি সোভিয়েট ইউনিয়নের সাথে পশ্চিমাদের চার দশকের পারমাণবিক ¯œায়ুযুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপে নতুন জুজু হিসেবে র‌্যাডিকেল ইসলামকে বেছে নিয়েছে পশ্চিমা এমআইসি (মিলিটারী ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স)’র কর্পোরেট বিনিয়োগকারীরা।
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়ায় নতুন সহ¯্রাব্দের শুরুতে পুরনো কমিউনিস্ট জুজু আর কাজে লাগানো সম্ভবপর হয়নি। অতএব পশ্চিমা জনগণকে বোকা বানিয়ে সামাজিক নিরাপত্তাসহ নানা খাত থেকে হাজার হাজার কোটি ডলারের বর্ধিত সামরিক বাজেটের যোগান দিয়ে মূলত অস্ত্র ব্যবসায়’র মাধ্যমে পশ্চিমা পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে একটি ভয়ঙ্কর ও শক্তিশালী নতুন শত্রুর প্রয়োজন ছিল। ২০০১ সালের এগার সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্যকেন্দ্র এবং পেন্টাগনে কথিত আল-কায়েদার সন্ত্রাসী বিমান হামলা তাদের হাতে সেই সুযোগ এনে দেয়। সেই থেকেই শুরু হওয়া সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে অন্তহীন যুদ্ধ চলছে। প্রেসিডেন্ট বুশের সূচিত সেই যুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাস দমন বা মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত র‌্যাডিকেল ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা। তবে পশ্চিমাদের সম্মিলিত শক্তি নিয়ে যুদ্ধ শুরুর দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর নানাভাবে এই যুদ্ধের ভ্রান্তি, ব্যর্থতা ও লক্ষ্যহীনতা প্রমাণিত হওয়ার পরও যুদ্ধ থামানো বা গুটিয়ে নিয়ে বিকল্প পন্থা খুঁজে বের করার কোন লক্ষণ বা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মূলত ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যনির্ভর পশ্চিমাদের ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের ভেতরের কুৎসিত চেহারাটা বেরিয়ে পড়ার সাথে সাথে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ যখন ক্রমে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, তখন জায়নবাদিরা ইসলাম ও মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা (ইসলামোফোবিয়া)’র মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সমাজে ইসলামের বিস্তৃতি রোখার চেষ্টা করছে। বিশেষতঃ নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমা অ্যাকাডেমিসিয়ান স্যামুয়েল পি হান্টিংটন তার ‘ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড রি-মেকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ প্রকাশের পর থেকে সভ্যতার সংঘাতকে বিশ্বের সামনে মূর্ত করার নানামাত্রিক চেষ্টা অব্যাহত আছে। হান্টিংটনের লেখা এই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক বিতর্ক ও বিশ্লেষণ হলেও নাইন-ইলেভেন উত্তর বিশ্বব্যবস্থা যেন কথিত এই সংঘাতকে সামনে রেখেই আবর্তিত হচ্ছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি বুক রিভিউতে এক লেখক (প্যাট্রিক হিলি-দ্য বোস্টন গ্লোব) লিখেছেন, ‘দ্য ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন অ্যান্ড দ্য রি-ম্যাকিং অব ওয়ার্ল্ড অর্ডার হ্যাজ বিকাম ওয়ান অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল বুকস অব দ্য নিউ ওয়ারটাইম এরা। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে লেখক প্যাট্রিক হিলি চলমান সময়কে একটি নতুন ওয়ারটাইম এরা (যুদ্ধকালীন সময়) বলে অভিহিত করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর নতুন বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে পঞ্চাশ দশকের শুরু থেকেই পরাশক্তিগুলো সক্রিয় ছিল। তবে নব্বই দশকের শুরুতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ভেঙে যাওয়ার সাথে সাথে ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ¯œায়ুযুদ্ধ শেষ হলেও একটি নতুন প্রত্যক্ষ যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রথম গাল্ফ ওয়ারকে একটি টেস্ট কেস হিসেবে গ্রহণ করে পরবর্তীতে নাইন-ইলেভেনের পর সেই অন্তহীন যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের কণ্ঠ থেকে। এরই মধ্যে দেড় দশক পেরিয়ে গেছে। পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে সভ্যতার এই স্বঘোষিত সংঘাতের ফলাফল কোথায় দাঁড়িয়েছে তার হিসাব-নিকাশ মেলানো শুরু হয়ে গেছে। যদিও ইসলামি সভ্যতা বা মুসলিম উম্মাহ অন্য কোন সভ্যতার বিরুদ্ধে কখনো যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। ইসলামের সার্বজনীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে সোনালী যুগে রোমান, পারস্য, বাইজান্টাইন সভ্যতার মত পুরনো সভ্যতাগুলো অনেকটা স্বেচ্ছায়ই ইসলামি শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে ইসলামের পতাকাতলে সামিল হয়েছিল। একাদশ শতকে পোপ দ্বিতীয় আরবানের ঘোষিত প্রথম ক্রসেড থেকে শুরু করে গত শতকের দুইটি মহাযুদ্ধ এবং জর্জ বুশের (নাইন ইলেভেন ঘটনার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ ‘ক্রুসেড’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন) ওয়ার অন টেরর পর্যন্ত সব যুদ্ধ পশ্চিমারাই ঘোষণা করেছিল। একইভাবে মুসলমানরা নিজেদের বিজয়ী দাবি করার আগেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষই তাদের পরাজয় মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পশ্চিমাদের ঘোষিত চলমান বিশ্ব সংঘাত এবং কথিত অন্তহীন যুদ্ধের বর্তমান পর্যায়ে কিছু পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাদের ভয়, আশঙ্কার কথা বলতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ ইসলামের বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ভবিষ্যদ্বাণী দিয়েছেন। যদিও পশ্চিমা পুঁজিবাদি সা¤্রাজ্যবাদের মূল অ্যাপারেটাস হিসেবে কর্পোরেট থিঙ্কট্যাঙ্ক ও মূলধারার কর্পোরেট মিডিয়াগুলো এখনো ইসলামোফোবিয়া প্রচারেই ব্যস্ত রয়েছে। পুঁজিবাদি অর্থনীতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আর পশ্চিমাদের হাতে কেন্দ্রীভূত নয়, চায়না, রাশিয়ার মতো স্টেকহোল্ডাররা এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে মূলধারার কর্পোরেট মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন জনমত গঠন ও পরিবর্তনশীল বিশ্বের ধারণা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অন্তহীন যুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখার কারসাজি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে চলেছে এবং পশ্চিমা গবেষক-বিশ্লেষকদের অনেকে প্রতিপক্ষ ইসলামের বিজয়ের ব্যাপারে আগাম মতামত দিতে শুরু করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব খবর সারাবিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মানব ইতিহাসের ধারাবাহিক পরিক্রমা এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা ধরে পশ্চিমা জগতের কিছু চিন্তাশীল মানুষের মধ্যে মনোজাগতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেখানে এক ধরনের প্যারাডাইম শিফ্ট ঘটতে শুরু করেছিল বহু আগে থেকেই। বিশেষতঃ ষাটের দশকে যখন আমেরিকায় মার্টিন লুথারকিং, ম্যালকমএক্সদের মানবাধিকারের আন্দোলন বিজয়ী হচ্ছিল। তখনমার্কিন পতাকাকে বিশ্বের সামনে অতি উচ্চে তুলে ধরা তিনবারের অলিম্পিক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ক্যাসিয়াস ক্লে ইসলাম গ্রহণ করে মোহাম্মদ আলী হলেন। এরপর সত্তুরের দশকে মার্কিন বিজ্ঞানী (অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট) ‘দি হান্ড্রেড’ বইয়ে মানবসভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ মানুষের জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত ডেটা তুলে ধরে সার্বিক বিচারে ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)কে এক নম্বরে স্থান দিতে বাধ্য হলেন। ফরাসী বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলি মিশরীয় মমির অবিকৃত টিকে থাকার রহস্য খুঁজে বের করতে গিয়ে কোরআনের বিজ্ঞানময়তায় অভিভূত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞানের তুলনামূলক আলোচনা করে মহামূল্য গ্রন্থ রচনা করলেন। কেট স্টিভেন অথবা মাইকেল জ্যাকসনের মতো পশ্চিমা হার্টথ্রব মেগাস্টার ইসলাম গ্রহণ করে আল্লাহ ও রাসূলের প্রশস্তি প্রচারে ব্রতী হলেন এই পরিবর্তনের গতিপথকে ভিন্নপথে প্রবাহিত করতেই ‘ইসলামোফোবিয়া’ বা ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার এজেন্ডা গ্রহণ করা হয়েছিল। এসব অপপ্রচার শেষ পর্যন্ত যে ব্যর্থ হচ্ছে তা’ এখন অনেকটা স্পষ্ট। দু’ বছর আগে ১৯ বছর বয়েসী মার্কিন সুপারস্টার জাস্টিন বিবার যখন তুরস্কের ইস্তাম্বুলে কনসার্ট করছিলেন হঠাৎ মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজানের সুরে থমকে দাঁড়ান তিনি, দু’ মিনিটের জন্য সবকিছু বন্ধ রেখে পবিত্র আজানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তার এই আজান প্রীতির সূত্র ধরে পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রশ্ন ওঠে জাস্টিন বিবারওকি শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করতে চলেছেন? ইউরোপ-আমেরিকায় নতুন প্রজন্মের অন্যতম সেনসেশন বিবারকে নিয়ে এমন জল্পনা অমূলক নয়। প্রতিবছর পশ্চিমের হাজার হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছেন এদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন এমন বহু পরিবার খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে পুরো পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছেন, অথবা পরিবারের শুধুমাত্র তরুণ সদস্যরা ইসলাম গ্রহণ করে প্রাকটিসিং মুসলিম হিসেবে তাদের জীবন ধারায় বিশাল পরিবর্তন এনেছেন। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা সাংবাদিক লরা বুথ অথবা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের কন্যার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ এবং ভিডিও ক্লিপ যখন ইউটিউবের মাধ্যমে সারাবিশ্বের তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে যায় তখন তারা ইসলাম সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য হয়। এভাবেই প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও পশ্চিমা খ্যাতিমান নওমুসলিমরা অন্যদের মাঝে ইসলামে সামিল হওয়ার প্রেরণা হয়ে উঠেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ২০ হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে বলে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে। প্রায় একই হারে প্রতিবছর বৃটেনে ৫ হাজারের বেশি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে। ফ্রান্স ও জার্মানীতে এ সংখ্যা আরো বেশি। একইভাবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীন এবং ভারতেও তুলনামূলকভাবে মুসলমান জনংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে জানা যায়। মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইসলামের বিজয়ের একটি প্রধান সূচক হলেও পশ্চিমা পুঁজিবাদি অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতে ইসলামের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে পশ্চিমা পুঁজিবাদে ধস এবং ইসলামের সার্বজনীন শান্তির দর্শন ও বৈষম্যমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উথানের মধ্যে। পশ্চিমা লেখক ও নীতি বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে যে সব বিশ্লেষণ, আশঙ্কা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছেন তার চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করতে গিয়ে সভ্যতার সংঘাতে ইসলামকেই বিজয়ী শক্তি হিসেবে তারামেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক, রেডিও- টিভি টকশো প্রেজেন্টার গ্লেন বেকের বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনাকে আমলে নেয়া যেতে পারে। ফক্স নিউজ এবং ব্লেইজ টিভির উপস্থাপনায় জিবি (গ্লেনবেক) অর্থনৈতিক, সামরিক ও আদর্শিকভাবে বর্তমান বিশ্বের স্টেকহোল্ডারদের চারটি ভাগে ভাগ করে নানা দিক বিচার বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ‘ইসলাম উইল উইন’। যদিও আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদি প্রতিযোগিতায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কোন খেলোয়াড় হিসেবে মানতে নারাজ। তিনি মনে করেন জর্জ সরোসের মতো কর্পোরেট ধনকুবেররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে খেলাচ্ছেন। প্রতীকী অর্থে জর্জ সরোসদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি রেখে বাকি বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে রাশিয়া, চীনকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে গণ্য করে সামগ্রিক প্রতিযোগিতায় ইসলাম বিজয়ী হওয়ার পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের চেয়ে ‘ফেইথ’ বা পারলৌকিক বিশ্বাসকে সবচেয়ে বড় অস্ত্র বা সম্পদ হিসেবে গণ্য করছেন গ্লেন বেক। স্টুডিওতে স্থাপিত মঞ্চে বসানো কয়েকটি ব্লাকবোর্ডে ছক এঁকে অঙ্ক কষে গ্লেন বেক দেখিয়েছেন, (যে কেউ ইউটিউবে সার্চ করে দেখতে পাবেন) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে জর্জ সরোস মার্কিন সরকার, লেবার ইউনিয়ন, এমআইসি, কর্পোরেট মিডিয়া, সামরিক বাহিনী, র‌্যাডিকেলিস্ট, চার্চ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে রাশিয়া এবং চায়না নিজেদের সামরিক শক্তি, জ্বালানি শক্তি, সামরিক প্রযুক্তি ও সেনাবাহিনী এবং বিশাল দক্ষ জনশক্তির উপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত খেলায় শেষ পর্যন্ত ফেইথ বা বিশ্বাসেরই বিজয় হয়। এখানেই ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বলে মনে করেন গ্লেন বেক।
গত বছর প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা সংঘটিত হওয়ার পর ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত লেখক-সাংবাদিক রবার্ট ডব্লিউ ম্যারির একটি বিশ্লেষণধর্মী ওপিনিয়নের শিরোনাম ছিল ‘দ্য ওয়েস্ট অ্যান্ড ইসলাম: দি ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন ইজ আন্ডারওয়ে, অ্যান্ড মুসলিমস ইন্টেন্ড টু উইন’। অনেকেই চলমান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধকে বিশ্বযুদ্ধাবস্থা বলে মনে করেন, রবার্ট ম্যারি হান্টিংটনের সূত্রকে মেনে নিয়ে এই যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। বহুজাতিক যুদ্ধে নিজেদের অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে পশ্চিমা পুঁজিবাদের প্রতিনিধিরা মার্কিন সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিভাবে ক্ষমতার জোরে ভয়কে কাজে লাগাচ্ছে তার বিবরণ গ্লেন বেক তার বেস্ট সেলিং বই ‘লায়ার’ এ তুলে এনেছেন। তথাকথিত প্রগ্রেসিভদের এই মিথ্যা ও প্রতারণার কারণেই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদিদের প্রতিযোগিতার মঞ্চ থেকে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে নেমে যেতে হচ্ছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর মাত্র দুই দশক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা যে একচ্ছত্র বিশ্বব্যবস্থার (নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার) কর্ম পরিকল্পনা এঁেকছিলেন, এখন তারা সেখান থেকে সরে যেতে শুরু করেছেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নীতি নির্ধারক জিবনিও ব্রেজনিস্কির বইয়ের শিরোনাম ছিল- ‘দি গ্রান্ড চেজবোর্ড: আমেরিকান প্রাইম্যাসি অ্যান্ড ইটস জিওস্ট্রাটেজিক ইমপেরাটিভস’। বিশ বছর আগে যে ব্রেজনিস্কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘প্যারামাউন্ট অব পাওয়ার’ বলে অভিহিত করছেন, তিনি এখন বলছেন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইজ নো লংগার দ্য গ্লোবালি ইম্পেরিয়াল পাওয়ার’। গত সপ্তায় লেখক মাইক হুইটনির প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শিরোনাম ছিল- ‘দ্য ব্রোকেন চেজবোর্ড: ব্রেজিনিস্কি গিভস আপ অন অ্যাম্পায়ার’। মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সমাজে একটি সর্বগ্রাসি ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিয়েই তারা সা¤্রাজ্যবাদ টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। প্রোপাগা-া, ইসলামোফোবিয়া ও আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে স্বার্থরক্ষার সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকার এডিটরিয়াল পেইজের এডিটর, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক টনি ব্লাঙ্কলে তার সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি গ্রন্থের শিরোনাম দিয়েছেন, দি ওয়েস্ট’স লাস্ট চান্স: উইল উই উইন দ্য ক্লাশ অব সিভিলাইজেশনস? সেখানে বইয়ের ভেতরে ফ্লাপে বলা হয়েছে- নাৎসিরা ইউরোপ দখল করতে ব্যর্থ হলেও মিলিট্যান্ট ইসলাম শীঘ্রই ইউরোপ দখল করবে। এক্সপ্লয়টেড ফিয়ার বা ভয়ে আক্রান্ত ব্লাঙ্কলে যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের প্রতিটি দেশে প্রতিবছর যে হাজার হাজার মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে তারা কি কোন মিলিট্যান্ট ইসলামের ভয়ে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন? বরং ইসলামকে ভীতিজনকভাবে উপস্থাপন করার কারণে পশ্চিমা তরুণরা যখন কোরানের প্রতি কৌতূহলি হয়ে তা পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন তখনই তাদের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটছে। একটি অধঃপতিত পুঁজিবাদি অর্থনীতির শেষপাদে এসে ভোগবাদের প্রতিযোগিতায় মানসিকভাবে রোগাক্রান্ত চিন্তাশীল মানুষরা একটি স্থায়ী বিকল্প খুঁজে নিতে চায়। এভাবে পশ্চিমা সমাজের ভিত্তিমূলে ইসলামের বিজয়ের বীজ বপিত হচ্ছে। মানবতার মুক্তির জন্য আগামী দিনে এভাবেই ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন