মিয়ানমারে পুনরায় সেনা অভ্যুত্থান এবং সেনাশাসন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন: বৌদ্ধধর্ম কি গণতন্ত্রের বিরোধী? এ প্রশ্ন এ জন্য যে, মিয়ানমারে যতবার সেনাশাসন এসেছে, তা এসেছে বৌদ্ধধর্মের নামে। তার ফলে বৌদ্ধধর্মবিশ্বাসী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর শাসন প্রতিষ্ঠার প্রধান শিকার হয় সবখানে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের ‘অপরাধ’ তারা মুসলমান ও তারা বাংলা কথা বলে। তাদের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া ছাড়াও আরেকটা বড় অপরাধ তারা ধর্ম বিশ^াসে মুসলমান। রোহিঙ্গাদের বাংলাভাষী হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় বিখ্যাত সাহিত্য গবেষক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হকের রচিত ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ নামীয় গ্রন্থে (১৯৩৫)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশেই মূলত রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বাস করে। সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থানের পূর্বে রোহিঙ্গারা নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে চলে আসতে বাধ্য হয় বাংলাদেশে। অল্পদিনের মধ্যে তারা নিজ জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন বলে যে আশা করছিল সেনাশাসন শুরু হওয়ায় তাদের সে আশা নিরাশার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।
মিয়ানমারের নেত্রী সূচিসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে আটক করেছে সামরিক বাহিনী। সুতরাং সেখানে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার আপাতত কোনো সম্ভাবনাই থাকলো না। এ অবস্থায় গণতান্ত্রিক বিশে^র সকল দেশের পক্ষ থেকে হতাশা প্রকাশ এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে মিয়ানমারে সেনাশাসন প্রত্যাহার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আহবান জানানো হয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের বন্ধুদেশ চীন সরাসরি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা না করলেও আশা প্রকাশ করেছে যে, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সকল দেশের নিকট গ্রহণযোগ্য একটা সমাধানে পৌঁছা সম্ভব হবে। এর অর্থ হলো, মিয়ানমার থেকে প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপার আর বিলম্বিত হয়ে পড়লো। এর সাথে সাথে বাংলাদেশসহ যেসব দেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে তাদের সবার ওপর রোহিঙ্গা নামক বাড়তি জনসংখ্যার বোঝা রয়েই গেল।
রোহিঙ্গারা ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান বলে তারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে আর কতকাল বাড়তি বোঝা হয়ে থাকবে, এটাই প্রশ্ন এখন। এ প্রশ্ন যেমন বাংলাদেশের পক্ষে তোলা যায়, তেমনি তোলা যায় অন্যান্য যেসব মুসলিম দেশে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে, তাদের পক্ষ থেকেও। একটি জনগোষ্ঠি শুধু ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান হবার কারণে নিজের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হবার মত অন্যায় ঘটনার শিকার হবে, আর পৃথিবীর অন্যান্য দেশ শুধু তা চেয়ে চেয়ে দেখবে, এ অন্যায় ঘটনার আশু প্রতিকারে এগিয়ে আসবে না, এটা তো বর্তমান গণতন্ত্রের যুগে কল্পনাও করা সম্ভব নয়।
এটাই যদি হয় কঠোর বাস্তবতা, তাহলে পৃথিবীতে জাতিসংঘ আছে কেন? জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূলেই তো ছিল বিশ্বের যে কোন অঞ্চলে এরকম অশান্তি ও অন্যায় ঘটনার প্রতিকার করে বিশ্বশান্তি জোরদার করা। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এতদিন পরও যদি আন্তর্জান্তিক ক্ষেত্রে এ ধরনের অন্যায় ঘটনা চলতেই থাকে, তাহলে তার সব দায়-দায়িত্ব কি জাতিসংঘের নেতৃস্থানীয় দেশসমূহের উপর পড়ে না? বিশেষ করে জাতিসংঘের যেসব সদস্য রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসাবে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী, তারা এ ব্যাপারে কিছুতেই তাদের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আমরা আশা করবো, জাতিসংঘের যেসব সদস্য-রাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসাবে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে তাদের বিশেষ মর্যাদার উপযোগী বিশেষ দায়িত্ব পালনে তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগিয়ে আসবে। যদি তারা তা না করে, শুধু বিশেষ মর্যাদা ভোগকেই একমাত্র কাজ বলে মনে করে, তাহলে ব্যর্থতার জন্য ইতিহাসের কাছে তাদের দায়ী থাকতে হবে।
এ তো গেল ঘটনার এক দিক। অন্যদিকে যেসব শক্তি (যেমন রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী) এসব অন্যায়ের মূল হোতা তাদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এসব না করে জাতিসংঘ যদি শুধু নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়, অর্থাৎ অন্যায়কারী শক্তির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে, নিন্দা ও প্রতিবাদের মধ্যেই দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখে তবে জাতিসংঘের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আমরা আজকের এ লেখায় যেসব বিষয় উল্লেখ, করেছি সেসব বিষয়ে জাতিসংঘের কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে সক্রিয় ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তা না করে জাতিসংঘ যদি নিষ্ক্রীয়-নিচেষ্ট থাকে তবে ভবিষ্যতে তাকে এ জন্য জবাবদিহি করতে হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন