মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া বিরোধী দলের রাজনীতি করা কঠিন

দেশে করোনাভাইরাস

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে অনুপস্থিত। বিরোধী দল হিসেবে একটি রাজনৈতিক দলের যে ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন, তা দলটি দিতে পারছে না। বলা যায়, দলটি অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। এর কার্যক্রম সংবাদ সম্মেলন ও প্রেস রিলিজ নির্ভর হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। দলটি কেন ও কি কারণে কর্মসূচি দিতে পারছে না, তা বোধকরি কম-বেশি সবারই জানা। দলটির পক্ষ থেকে সবসময় যে ব্যাখ্যা দেয়া হয় তা হচ্ছে, সরকার তাকে মাঠে নামতে দেয় না। কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলেই পুলিশ প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা হামলা-মামলা ও নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। এ কারণে দলটি কোনো জনসভা ও কর্মসূচি দিতে পারছে না। জনসভার অনুমতি চাইলেও নানা অজুহাতে তা দেয় না। সরকার ফ্যাসিবাদী আচরণ করে। দলটির এ ব্যাখ্যা সত্যি হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে এ পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করে তার কর্মসূচি পালন করবে, তার কোনো কর্ম পরিকল্পনা নিতে দেখা যায় না। এ কথা সবার জানা, আমাদের দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে। বিরূপ রাজনৈতিক পরিবেশে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করেছে এবং সফলও হয়েছে। তবে বর্তমানে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেও তার আচরণে বিরোধী দলের রাজনীতি করতে না দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার যখন স্বৈরাচারের মতো আচরণ করে, তখন বিরোধী দলের রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের মোড়কে এ শাসন ব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও কঠিন। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও কার্যক্রমে স্বৈরতন্ত্রকেও হার মানায়। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা আমাদের দেশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। স্বৈরতন্ত্রে বিরোধী দল আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রতিবাদ করতে পারলেও গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে স্বৈরতন্ত্রে বিরোধী দলের পক্ষে আন্দোলন করা যে কঠিন হয়ে পড়ে তা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখলেই বোঝা যায়। এ ধরনের রাজনৈতিক ডাইমেনশনে বিরোধী দলের কার্যক্রম ও কর্মসূচি কেমন হওয়া উচিৎ, এ অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তবে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে রাজনীতি করা যায়, তার পরিকল্পনা যেকোনো রাজনৈতিক দলের থাকতে হয়। বিএনপি নতুন মাত্রার এ রাজনীতিতে খাপ খাওয়াতে না পেরেই নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না, এ অভিযোগে বিএনপি কোনো ধরনের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছিল। দেখা যায়, দলটি এ ঘোষণায় স্থির থাকতে পারেনি। উপ-নির্বাচন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সব নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করে এবং করছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়ে কেন অংশগ্রহণ করছে, এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয়, আমরা দেখাতে চাই, এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয় না। আরেকটি যুক্তি দেখানো হয়, দলের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত ও চাঙ্গা রাখতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। দলটির প্রথম যুক্তির প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বিগত দুইটি জাতীয় নির্বাচন ও অন্যান্য স্থানীয় নির্বাচন থেকে সাধারণ মানুষ ভাল করেই জেনেছে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। এখানে বিএনপির নতুন করে দেখাবার কিছু নেই। বরং কিভাবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বাধ্য করা যায়, এ ব্যাপারে দলটির কোনো কর্মসূচি ও জনস¤পৃক্ত কর্মসূচি নেই। দলটি যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ও ফেল করার নীতি অবলম্বন করে চলেছে। অনেকে বলেন, বিএনপি গা বাঁচানোর জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এতে যে সাধারণ মানুষের মধ্যে দলটির কর্মকাÐ স¤পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে, তা আমলে নিচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া আমাদের দেশে বিরোধী দলের রাজনীতি করা কঠিন। সেখানে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে স্বৈরতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন করা তো আরও কঠিন। তারা আরো বলছেন, এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক কৌশল ও পরিকল্পনা বদলাতে হয়। সেক্ষেত্রে বিএনপি কি এ ধরনের কোনো কৌশলী রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পেরেছে? পারেনি। বরং দেখা গেছে, সরকারের কাছে মার খাওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে দলটি নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। অথচ আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হচ্ছে, বিরোধী দলকে বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়। বিরোধী দলের রাজনীতির পথটি পু®প আচ্ছাদিত নয়, কণ্টাকীর্ণ। এর নেতা-কর্মীদের জেল-জুলুম, হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আজ যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় সেও অনেক বিরূপ পরিস্থিতিতে রাজনীতি করে এসেছে। এখন ক্ষমতায় গিয়ে কীভাবে বিরোধী দলকে দমাতে হয়, সে অভিজ্ঞতা এবং তার সাথে আরও ক‚টকৌশল যোগ করে কাজে লাগাচ্ছে। ক্ষমতায় থেকেও বিএনপির এ অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে দলটির অভিজ্ঞতায় দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে। কঠিনতম পরিস্থিতিতে কীভাবে রাজনীতি করতে হয় এবং হবে, এ পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। যার খেসারত এখন দলটিকে দিতে হচ্ছে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ক্ষমতাসীন দল প্রশাসনকে ব্যবহার করে যেভাবে বিরোধী দলের রাজনীতি দমিয়ে রেখেছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। বিরোধী মতের রাজনীতি করার গণতান্ত্রিক যে সুযোগ দেয়া দরকার তা দিচ্ছে না। তার আচরণে এমনটাই প্রকাশিত হচ্ছে, দেশের উন্নয়ন করার জন্য বিরোধী দলের রাজনীতির প্রয়োজন নেই। উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরোধী দল বড় বাধা। কাজেই, বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে না দিয়ে ঘরবন্দি করে উন্নয়ন করতে হবে। এর ফলে উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই, তবে তাতে দুর্নীতিরও ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে। জনগণের স্বার্থে এই উন্নয়ন করতে গিয়ে দুর্নীতি তাদের কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দুর্নীতিবাজরা জনগণের অর্থ লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে। দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাত বছরে দেশ থেকে ৪ লাখ কোটি টাকা দেশে পাচার হয়ে গেছে। বলা যায়, দেশের এক বছরের বাজেটের অর্থ বিদেশে চলে গেছে। এটা হয়েছে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবের কারণে। সুশাসনের অভাবের কারণে দুর্নীতিবাজরা যে যেভাবে পারছে জনগণের অর্থ লুটে নিচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যে সাধারণ মানুষের যে দুর্গতি এবং নাভিশ্বাস তা এই সুশাসনের অভাবেই হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের প্রভাব বলয়ে থাকা সিন্ডিকেট পণ্যের দাম যেমন খুশি তেমন বাড়িয়ে জনগণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের তরফ থেকে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সরকার দেখেও না দেখার ভান করে আছে। যেন লুটেরাদের লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। জনগণের সরকার হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। যদি গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং বিরোধী দলের রাজনীতি সংকুচিত করা না হতো, তাহলে দুর্নীতির এই মহোৎসব চলত না এবং এতটা বিস্তার লাভ করত না। জবাবদিহিতা এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকত। সরকারের জবাবদিহী করতে বাধ্য হতো এবং দুর্নীতিবাজরা এত বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারত না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় সরকারকে এখন জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। অথচ গণতান্ত্রিক পরিবেশে যে উন্নয়ন হয়, তাতে যেমন জবাবদিহিতা থাকে, তেমনি দুর্নীতি কমে এবং উন্নয়নও টেকসই হয়। এজন্যই দেশে বিরোধী দলের অবাধ রাজনীতির সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।

বিরোধী দলের রাজনীতি করার সুযোগ সংকুচিত হওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি বিরোধী দলের সঠিক ও পরিকল্পিত কর্মসূচি না নেয়ার সক্ষমতারও অভাব রয়েছে। এই যে বৃহৎ বিরোধী দল বিএনপি যতটুকু রাজনীতির সুযোগ পাচ্ছে, তাতে জনগণের কথা কতটুকু বলছে? দেশে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে দলটির জোরালো কোনো ভ‚মিকা দেখা যাচ্ছে না। এভাবেই কি দলটি বছরের পর বছর রাজনীতি করে যাবে? তার এই অচলায়তন ভাঙ্গবে কবে? অবশ্য স¤প্রতি দলটি দীর্ঘদিন পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ভোট কারচুপির প্রতিবাদ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে এ মাসে ও মার্চ মাসের মধ্যে দেশের ছয়টি মহানগরে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই মহাসমাবেশের উদ্দেশ, জনগণকে সরকারের ভোট ডাকাতির বিরুদ্ধে স¤পৃক্ত করা। বৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির এমন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করা স্বাভাবিক। তবে সংকুচিত রাজনৈতিক পরিবেশে দলটি এ কর্মসূচি পালন করতে কতটা সক্ষম হবে তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ স¤পাদক বলেছেন, বিএনপি সমাবেশের নামে স্যাবোটাজ করলে তা কঠোর হস্তে দমন করা হবে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন ও জনগণের কাছে যেতে দিতে চায় না। এটাও আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দলের চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের মতো। তবে ক্ষমতাসীন দলের হুমকিতে বিরোধী দল চুপসে গিয়ে বা অন্য কোনো উছিলায় যদি কর্মসূচি পালন না করে, তাহলে তারা কোনো দিনই রাজনীতি করতে পারবে না। তাদের অস্তিত্ব বলে কিছু থাকবে না। কাজেই, গণতন্ত্রের স্বার্থে, জনগণের মতামত তুলে ধরার মুখপাত্র হিসেবে বিরোধী দলের উচিৎ হবে বৈরী পরিবেশেও তার গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করা। সরকার বাধা দিলেও জনগণ যেমন তা দেখবে, তেমনি সরকারের প্রতিও বিরূপ ধারণা পোষণ করবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনায় শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে স¤প্রতি বক্তব্য রেখেছেন। তাই বর্তমান প্রক্ষাপটে বিরোধী দল কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে গ্রহণযোগ্য কারণ না দেখিয়ে পালন না করলে, তা তাদের জন্য আরও ক্ষতিকর হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, সরকারেরও উচিৎ বিরোধী দলের রাজনৈতিক স্বাভাবিক কর্মসূচি পালন করতে দেয়া।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

rintu108@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন