মোহাম্মদ আবদুল গফুর
আজ সেপ্টেম্বর মাসের পহেলা তারিখ। পহেলা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠা দিবস। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট উপমহাদেশে ১৯০ বছরের সা¤্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যা আমরা সবাই জানি। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার পাকিস্তান রাষ্ট্রের অবস্থান ছিল উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত দুটি বিচ্ছিন্ন মুসলিম -অধ্যুষিত এলাকা জুড়ে। উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের অবসানের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের ঢাকা শহরে জন্ম হয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের।
সাধারণত একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার কোনো দেশের জাতীয় ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা থাকে না। কিন্তু তমদ্দুন মজলিসের ছিল। তমদ্দুন মজলিস তার জন্মের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে এদেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নামের এমন একটি আন্দোলনের জন্ম দেয়, যা এদেশের ইতিহাসে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। উপরে উল্লিখিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক যে পুস্তিকার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়, তার লেখক ছিলেন তিনজনÑ তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক কলকাতা থেকে প্রকাশিত তদানীন্তন দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ।
এদের মধ্যে প্রথমজন অর্থাৎ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নিবন্ধে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে মূল দাবি তুলে ধরা হয় এভাবেÑ
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিস-আদালতের ভাষা হবে বাংলা।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা ভাষা।
(গ) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটিÑ বাংলা ও উর্দু।
সমগ্র ভাষা আন্দোলন এই তিন দাবি নিয়েই পরিচালিত হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে সে বিষয়ে কংগ্রেস পূর্বাহ্নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে বিষয়ে মুসলিম লীগ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সে সময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার প্রতিবাদ জানান।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে বাস করতেন সমগ্র পাকিস্তানের শতকরা ৫৬% অধিবাসী, তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অন্যদিকে পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ছিলেন অবাঙালি। তারা ছিলেন উর্দুভাষী। তাদের উদ্যোগে গোপনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার একটা প্রচেষ্টা এগিয়ে যেতে থাকে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় নতুন রাষ্ট্রের জন্য মুদ্রিত পোস্টকার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফরম প্রভৃতিতে ইংরেজির পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার থেকে। এসবের ফলে নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ধুমায়িত হতে থাকে।
এদিকে ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের ডাক দিয়েই বসে থাকেননি অধ্যাপক আবুল কাসেম। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ব্যক্তিগত দেখা সাক্ষাৎ এবং আলোচনা বৈঠকের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে এবং মাঝে মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে ক্যাম্পাসে আলোচনা সভা চালিয়ে যেতে থাকেন। ভাষা আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে সাতচল্লিশেই তমদ্দুন মজলিসের অন্যতম সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন শাস্ত্রের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভুইয়াকে কনভেনর করে গঠিত হয় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সাবেক অবিভক্ত বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের একাংশ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই ছাত্রলীগ গোড়া থেকেই তমদ্দুন মজলিস সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়। ছাত্রলীগের জন্মের পর তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য জনাব শামসুল আলমকে কনভেনর করে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ সময়ে গণপরিষদে বাংলায় বক্তৃতা দেয়ার দাবি অগ্রাহ্য হলে তার বিরদ্ধে ঢাকায় প্রতিবাদ ওঠে। দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের আহ্বান জানানো হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আহূত এই প্রথম হরতাল বিপুলভাবে সাফল্যম-িত হয়। রেল শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ এই হরতালের প্রতি সমর্থনদানের ফলে ওইদিন চট্টগ্রাম থেকে কোনো ট্রেন ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করতেই পারেনি। ঢাকায় বাংলা ভাষা সমর্থকদের পিকেটিংয়ের ফলে খুব কম সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীই সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতে সমর্থ হন। সেক্রেটারিয়েট গেটে পিকেটিং করতে গিয়ে অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ অনেকে গ্রেফতার হন। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন অধ্যাপক আবুল কাসেমসহ অনেকে। গ্রেফতার ও লাঠিচার্জের খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে কিছুক্ষণের মধ্যে সমগ্র সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুব্ধ মানুষের জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সমগ্র প্রশাসনে অচলাবস্থা দেখা দেয়।
এ অবস্থা চলতে থাকে ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এতে প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভয় পেয়ে যান। কারণ ১৯ মার্চ কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহের ঢাকা আগমনের কথা। ঢাকায় এ পরিস্থিতি দেখে তার খুশি হওয়ার কথা নয়। নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সদস্যের সাথে কথা বলে তাদের সকল দাবি মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়। পূর্ব ব্যবস্থা মোতাবেক কায়েদে আজম ১৯ মার্চ ঢাকা আসেন। এর পর প্রথমে ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসভায় এবং পরে ২৩ মার্চ কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দেন। উভয় স্থানে তিনি উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প ঘোষণা করেন। উভয় স্থানে তার এ ঘোষনার প্রতিবাদ হয়। রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় কোনদিকে প্রতিবাদ হয় তা তিনি ততটা বুঝতে সক্ষম না হলেও কার্জন হলের সীমিত উপস্থিতিতে কিছু সংখ্যক ছাত্রের প্রতিবাদ তাঁর নজর এড়ায়নি। যে ছাত্র সমাজ মাত্র কিছু দিন আগেও তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারাই তার মুখের সামনে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছে দেখে তিনি বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত করে হল ত্যাগ করেন। পরে তিনি ছাত্র নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। কিন্তু উভয় পক্ষ যার যার বক্তব্যে অটল থাকাতে বৈঠক ব্যর্থ হয়। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে প্রকাশ্যে আর কোনো বক্তব্য দেননি।
প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক অলি আহাদের পুস্তক জাতীয় রাজনীতি থেকে জানা যায়, সে সময় দেশের জনগণের মধ্যে কায়েদে আজমের বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার কারণে ওই সময় নতুন করে ভাষা আন্দোলনকে আর চাঙ্গা করা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হতো এটা জানান দিতে যে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ভাষাসৈনিকরা কখনো ত্যাগ করেনি। ভাষা আন্দোলন নতুন করে চাঙ্গা হয়ে ওঠে ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পল্টনের এক জনসভায় নাজিমুদ্দিনের ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ ঘোষণার কারণে। যে নাজিমুদ্দিন নিজে ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি মেনে নিয়ে ভাষাসৈনিকদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তার এই পরিবর্তনকে ভাষাসৈনিকরা বিশ্বাসঘাতকতা বিবেচনা করে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি। ভাষা আন্দোলন এখন আর শুধু তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের ব্যাপার নয়। ইতোমধ্যে জন্ম দিয়েছে অনেক রাষ্ট্রভাষা সমর্থক সংগঠন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ। সবাই বাংলা রাষ্ট্রভাষার সমর্থক। নতুন করে গঠিত হলো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদে থাকলেন মওলানা ভাসানী, জনাব আবুল হাশিম প্রমুখ প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন বাংলা ভাষা সমর্থক সংগঠনের প্রতিনিধি। প্রতিবাদ দিবস ঘোষিত হলো ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে হঠাৎ ১৪৪ ধারা জারি করল। কিন্তু ফল হলো উল্টো। ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রফিক, সালাম, বরকতসহ তরুনরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে প্রমাণ করল রাষ্টভাষা বাংলার প্রশ্নে তারা কোনো বাধাকেই বাধা বলে মানতে রাজি নয়। ভাষা শহীদদের রক্তদানের ফলে বাংলা ভাষা বিরোধিতার সাহস উবে গেল বাংলাবিরোধীদের মন থেকে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদে পাকিস্তানের যে প্রথম সংবিধান গৃহীত হলো, তাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হলো।
এবার জাতীয় ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব প্রসঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক যে পুস্তিকা প্রকাশিত হয় তাতে অধ্যাপক আবুল কাসেমের নিবন্ধে পাকিস্তানের দুটি রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও উর্দুর দাবির পক্ষে যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে গিয়ে বলা হয়, ১৯৪০ সালের যে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি বিবেচনা করা হয়, তাতে উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব দিকে অবস্থিত দুটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তার তুলনায় পাকিস্তানের জন্য দুটি রাষ্ট্রভাষা করার দাবি খুবই সামান্য। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের এ দাবি মেনে নেয়াই সঙ্গত।
তাঁর এই বক্তব্যের মধ্যে লাহোর প্রস্তাবের মর্মবাণীর প্রতি যে ইঙ্গিত নিহিত ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তব পরিস্থিতি ভাষা আন্দোলন-পরবর্তীকালে সেই পথেই অগ্রসর হয়। সেই নিরিখে আমরা লক্ষ্য করি ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই প্রথমে আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন আন্দোলন, পরে ছয় দফা আন্দোলন এবং স্বাধিকার আন্দোলন শুরু হয়। এর পর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে স্বাধিকার আন্দোলন পন্থিরা একচেটিয়া বিজয় অর্জন করলে তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক সরকার জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পশু বলে জনগণের স্বাধিকার চেতনা ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হলে জনগণ।
জানকবুল করে সশস্ত্র্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসের মরণপণ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
এ কথা সত্য যে ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে শুরু হয় যে স্বাধীনতা আন্দোলন তার এক পর্যায়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য দিতে এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু এই সাহায্য দান বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে দেখার লক্ষ্যে না, পাকিস্তান নামের বৃহৎ রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশকে ভারতের আশ্রিত একটি দুর্বল রাষ্ট্র হিসেবে দেখার লক্ষ্যে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ভারতের হয়তো ধারণা ছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের মূল স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে কখনো জীবিত ফিরে আসতে পারেন না। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারকে ভারতের জমিনে পেয়ে ভারত সরকার তাদেরকে এমন এক সাতদফা চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য করে, যার মধ্যে ছিল :
(এক) মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডের অধীনে থাকবে।
(দুই) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশে ভারতীয় বাহিনী অবস্থান গ্রহণ করবে।
(তিন) স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না।
(চার) বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একটি বাহিনী গঠন করা হবে।
(পাঁচ) মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি এমনসব সরকারি কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হবে। প্রয়োজনে ভারতীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা শূন্যস্থান পূরণ করা হবে।
(ছয়) ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চলবে।
(সাত) বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নেয়া হবে।
এই অসম চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হওয়ার পরই মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন।
[দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে র এবং সিআইয়ের ভূমিকা : মাসুদুল হক]
সৌভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে জীবিত এবং সুস্থ শরীরে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। তিনি পাকিস্তান থেকে প্রথমে লন্ডনে যান। তিনি তাঁর সংক্ষিপ্ত লন্ডন সফরকালেই অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের সাথে ভারতের সাত দফা চুক্তি সম্পর্কে অবহিত হন এবং তার আলোকে তাঁর ইতিকর্তব্য স্থির করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পথে নয়াদিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতিকালে প্রথম সুযোগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি প্রশ্ন করেন : ম্যাডাম, আপনি বাংলাদেশ থেকে আপনার বাহিনী কখন ফিরিয়ে আনবেন? জবাবে ইন্দিরা বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। এর ফলে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশ একটি প্রকৃত স্বাধীন দেশ হিসেবে তার যাত্রা শুরু করতে সক্ষম হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন