শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

বাঁশ কুটির শিল্পপল্লী শরীয়তপুরের রামকৃষ্ণপুর চাঁই বুনে সচ্ছল হয়েছে শত শত গ্রামবাসী

প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোঃ হাবিবুর রহমান হাবীব, শরীয়তপুর থেকে

প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করা বাঙালির আবহমান কালের কৃষ্টি। বিশেষ করে দরিদ্র মৎস্যজীবী এবং অ-মৎস্যজীবী পল্লীবাসীরা বছরের সব মৌসুমেই নদীনালা, খালবিল, হাওড়-বাঁওড়সহ বিভিন্ন জলাশয় ও জলাধার থেকে মাছ শিকার করে। মাছ ধরার জন্য তারা ব্যবহার করে নানা উপকরণ। এরমধ্যে জাল, ভেসাল, পলো, বরশি, কোঁচ, টেটা, যুতি, বইচনা ও দোয়াইর বা চাঁই অন্যতম। পল্লী অঞ্চলে মাছ ধরার সবচেয়ে পুরনো ও আদি উপকরণের একটি হচ্ছে চাঁই। যেখানে জোয়ারের পানির উৎস আছে সেখান থেকেই চাঁই দিয়ে মাছ ধরার সুবিধেটি গ্রহণ করে মৎস্যজীবীরা। মাছ ধরার এই বহুল ব্যবহৃত উপকরণ চাঁই বুনে (তৈরি করে) সচ্ছল হয়েছে জেলার জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের রামকৃষ্ণপুর গ্রামের ৮০ ভাগ বাসিন্দা। গ্রীষ্মের শুরু থেকে গ্রামাঞ্চলের খালবিল ও নদীনালায় শুরু হয় চাঁই দিয়ে মাছ ধরার। বিশেষ পদ্ধতিতে বাঁশ দিয়ে নদী-খালে, বিল-বাঁওড়ে গড়া দেয়া হয়। ২০ ফুট থেকে শুরু করে একেকটি গড়া ১০০ ফুটেরও বেশি লম্বা হয়ে থাকে। এই গড়ার ফাঁকে ফাঁকে ৪/৫ ফিট পর পর বসানো হয় একটি করে চাঁই। বাবুই পাখির বাসার মতো চাঁইয়ের প্রবেশ মুখের ধরণ (প্যাটান) তৈরি করা হয়। পানিতে চাঁই বসানো হয় মূলত চিংড়ি মাছ শিকারের জন্য। কিন্তু ধরা পরে পুঁটি, বেলে, টেংরাসহ সকল প্রকারের সাচরা মাছ। সরেজমিন রামকৃষ্ণপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, এই গ্রামের ১০ বছর বয়সের শিশু থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে মিলে চাঁই বুনছে। কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ শলা তুলছে, কেউ শলা চাঁছছে আবার কেউবা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে চাঁই বুনা ও বাঁধার কাজে। ঘরের বারান্দায়, উঠানে, গাছের ছাঁয়ায় যে যেখানে পারছে সেখানে বসেই করছে চাঁই বানানোর কাজ। রামকৃষ্ণপুর গ্রামের প্রায় ২০০টি পরিবারের মধ্যে ১শ ৫০টি পরিবারের অন্তত ১ হাজার ২শ জন শিশু, নারী ও পুরুষ জড়িত চাঁই বুনার কাজে। প্রায় ২০ বছর ধরে এই গ্রামে চাঁই বানানোর কাজ চললেও ব্যাপক ও বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে ৩/৪ বছর যাবৎ। মাঘ মাস থেকে এই গ্রামে চাঁই বুনার কাজ শুরু হয়। চলে আশ্বিন মাস পর্যন্ত। বছরের ৯ মাসই গ্রামবাসী ব্যস্তÍ থাকে চাঁই বুনার কাজে। এক মৌসুমে প্রায় ২ লক্ষ চাঁই বানানো হয়। প্রতিটি চাঁই-এর নির্মাণ খরচ হয় সব মিলে ১০০ টাকা। শ্রমিকরা পায় একটি চাঁই বানানোর বিনিময়ে ৪০ টাকা। এই পল্লীতে মৌসুমে মালিক ও শ্রমিক মিলে চাঁই উৎপাদন করে আয় করে প্রায় ২ কোটি টাকা। চাঁই বুনন শ্রমিক শহিদুল কাজী ও তার স্ত্রী রজিনা বেগম বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী রাত দিন করে চাঁই বুনি। সপ্তাহের শেষে আমরা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫শ টাকা করে বিল তুলি। বছরের ৯ মাস চাঁই বুনার কাজ করে আমরা অনেক ভালো আছি। আমাদের সংসারে কোন অভাব নাই। নিলুফা বেগম (৩৮) বলেন, আমি প্রতিদিন ১০০টি করে পাড় বাঁধাই করি। প্রতিটিতে ২ টাকা করে পাই। রোজ ২০০ টাকা আয় করে আমি খুব সচ্ছলভাবে দিন কাটাই। চাঁই বানানোর উদ্যোক্ততা আঃ রব মাদবর বলেন, ২ লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে চাঁই তৈরির ব্যবসা করছি। প্রতি সপ্তাহে ২০০ চাঁই নামাতে পারি। এতে সব খরচ দিয়ে লাভ হয় সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা। তিনি জানান, তাদের উৎপাদিত চাঁই জেলার চাহিদা পূরণ করে মুন্সীগঞ্জ, চাঁদপুরের হাইমচর, মতলব, বরিশালের মুলাদী ও হিজলা, ফরিদপুরের সদরপুর, পিয়াজখালীর পাইকার এসে কিনে নিয়ে যায়। বড়কান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম সরদার জানান, রামকৃষ্ণপুর গ্রামের চাঁই তৈরির উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা গেলে তারা আরো লাভবান হতে পারতো। এই শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তা একান্ত প্রয়োজন বলেও তিনি জানান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন