শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০৫ এএম

আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক অনন্য স্থান অধিকার করে রয়েছে। বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ যদি এক অবিভক্ত রাষ্ট্ররূপে স্বাধীনতা লাভ করত, তাহলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলাই সম্ভবপর হতো না। বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মহাত্মা গান্ধী প্রশ্ন করেছিলেন, যদি ভারত স্বরাজ লাভ করে, তবে এদেশের সাধারণ ভাষা কী হবে? জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, হিন্দী।

রবীন্দ্রনাথের এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ভারতবর্ষের তিনটি ভাষার রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যোগ্যতা ও সম্ভাবনা রয়েছে। ভাষা তিনটি হলো: বাংলা, উর্দু ও হিন্দী। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বক্তব্য যে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ছিল তা এখন সুপ্রমাণিত। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের রাষ্ট্রভাষা যথাক্রমে বাংলা, উর্দু ও হিন্দী। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, পৌনে দু’শ বছরের বৃটিশ-শাসিত ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে অবিভক্ত অবয়বে নয়। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বৃটিশ শাসনের অবসানে ভারতবর্ষ প্রথম স্বাধীনতা লাভ করে পৃথক দুটি রাষ্ট্র হিসাবে। একটি ভারত, আরেকটি পাকিস্তান। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অখন্ড। অপর পক্ষে পাকিস্তানের অবস্থান ছিল ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনপদ নিয়ে। হাজার মাইলেরও অধিক দূরত্বে অবস্থিত দু’টি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন জনপদ নিয়ে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল, যা পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত ছিল, তার চারটি প্রদেশ ছিল: পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। আর পূর্বাঞ্চলে একমাত্র প্রদেশ ছিল, যার নাম ছিল পূর্ববাংলা। পূর্বাঞ্চলের এই একটি প্রদেশের জনসংখ্যা ছিল পশ্চিমাঞ্চলের চার-চারটি প্রদেশের সর্বমোট জনসংখ্যার চাইতেও অধিক। পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার সবাই ছিল বাংলাভাষী। এই নিরিখে বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি তোলা যেতো। তা অবশ্য তোলা হয়নি। তার জায়গায় উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালিয়ে দেয়ার একটা গোপন চক্রান্ত শুরু হয়। নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষী অবাঙ্গালীরা।

সাধারণ ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণের মাতৃভাষা বাংলাকে বিবেচনায় আনা হয়নি। পূর্ববঙ্গের পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য হিসাবে তার মাতৃভাষা ছিল উর্দু। তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে সম্ভবত ধারণা দিয়েছিলেন যে, পূর্ববঙ্গের জনগণ সবাই উর্দু বোঝে। তিনি যদি জিন্নাহ সাহেবকে এই ভুল ধারণা না দিতেন, তাহলে জিন্নাহ সাহেবের মনে এমন একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি হতো না যে, পূর্ব পাকিস্তানের সব লোক উর্দু বোঝে। জিন্নাহ সাহেব খাজা নাজিমুদ্দীনের কথায় বিশ্বাস করে তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে রেসকোর্স ময়দানে এবং কার্জন হলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেন, যার ফলে নতুন করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। পরে মৃত্যু শয্যায় জিন্নাহ সাহেব তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্নেল এলাহি বখসের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে বলেছিলেন, আমি অন্যের কথায় বিশ্বাস করে জীবনে বেশ কিছু ভুল করেছি। এর অন্যতম হলো আমার রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করা। এ বিষয়টা আমার গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। এ তথ্য আমরা জানতে পেরেছি বিখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে।

কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। এরপর পাকিস্তানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা লিয়াকত আলী খানও পরবর্তীকালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। পরবর্তীতে খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের প্রধান নেতা হিসেবে ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদানকালে বলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।

অথচ এই খাজা নাজিমুদ্দীনই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যে খাজা নাজিমুদ্দীন ১৯৪৮ সালের জিন্নাহ সাহেবের সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে প্রস্তাবের পক্ষে স্বাক্ষর করেন, সেই খাজা নাজিমুদ্দীনই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সংকল্প ঘোষণা করেন। এটা ভাষা সংগ্রাম পরিষদ অমার্জনীয় অপরাধ হিসাবে গণ্য করে এবং তার এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদ হিসাবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস এবং হরতালের ডাক দেয়। এর পরের ঘটনা সবার জানা। রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ভাষা শহীদ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলেন। আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Sunjida Islam ২২ মে, ২০২১, ৬:২৭ পিএম says : 0
Shondor hoi nai plass valo laga nai..????????????????????????????????‍♀️????‍♀️
Total Reply(0)
Antika chakma ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৮:৩৯ পিএম says : 0
আমি যা ছাই তাই আাসতে হবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন