ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর স্বাধীন ভারতের সাধারণ ভাষা বা ‘লিঙ্গুয়াফ্রাংকা’ কী হবে, তা নিয়ে গত শতকের শুরুতেই আলোচনার সূত্রপাত হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও হিন্দু বিদ্বৎসমাজ হিন্দির পক্ষাবলম্বন করে। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ও মুসলিম বিদ্বৎসমাজ উর্দুর পক্ষে সোচ্চার হয়। কংগ্রেস ছিল প্রধানত হিন্দুর স্বার্থসংরক্ষণকারী রাজনীতিক সংগঠন এবং মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাই হয় মুসলিম স্বার্থ দেখভাল করার জন্য। সাধারণ ভাষার প্রশ্নে দু’পক্ষের এই দু’পথে গমনের পেছনে রাজনৈতিক কারণ তো ছিলই, সাংস্কৃতিক কারণও ছিল। হিন্দি লেখা হয়, দেবনাগরী হরফে। এর শব্দসম্ভারের বেশির ভাগই হিন্দুর ধর্মীয় ভাষা ‘সংস্কৃতি’ থেকে আগত। পক্ষান্তরে উর্দু লেখা হয় ফারসি ও মুসলিমের ধর্মীর ভাষা ‘আরবী’ হরফে। এর শব্দভান্ডার গড়ে উঠেছে ফারসি ও আরবী শব্দ দিয়ে। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ভারত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ ভাষা নিয়ে এ বিতর্ক অব্যাহত ছিল।
একদা মহাত্ম গান্ধী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে চিঠি লিখে জানতে চান, ভারতের সাধারণ ভাষা কী হতে পারে? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন: ‘হিন্দি ছাড়া ভারতের আন্তঃপ্রাদেশিক সাধারণ ভাষা হওয়ার যোগ্য কোনো ভাষা নেই।’ অতঃপর বিশ্বভারতী সাধারণ ভাষা প্রশ্নে মহাসভার আয়োজন করা হয়। এতে সারা ভারতের ভাষা-বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। মহাসভায় সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রানাথ ঠাকুর। মহাসভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও আমন্ত্রিত হন এবং একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেখানে তিনি বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার প্রথম দাবি উত্থাপন করেন। বাংলার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে তিনি বলেন, ‘শুধু ভারত কেন, সমগ্র এশিয়া মহাদেশেই বাংলা ভাষার স্থান হবে সর্বোচ্চ।’ বলা বাহুল্য, আবেগতাড়িত হয়ে নয়, একজন ভাষাবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি এ অভিমত পেশ করেন। তার মতে, ভারতের সাধারণ ভাষা হওয়ার দাবি প্রথমত উর্দুর, দ্বিতীয়ত বাংলার এবং তৃতীয়ত হিন্দির। তার এ বক্তব্য শুনে মহাসভায় উপস্থিত পন্ডিত ও শ্রোতারা বিস্মিত ও হতবাক হয়। তাদের বিস্ময়ের মূলে ছিল বাংলার দাবি উত্থাপন। এ সম্পর্কে অধ্যাপক হেমন্ত কুমার সরকারের একটি প্রতিবেদন ‘মোসলেম ভারতে’র কার্তিক সংখ্যায় (১৯২০) প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেন: ‘বাঙ্গালা ভাষা ভারতের খরহমঁধ ঋৎধহপধ হইতে পারে কি না এ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ মৌলবী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে শান্তি নিকেতনে পাঠ করেন। সভায় ডা. তারাপুরওয়ালা, বিধূশেখর শাস্ত্রী প্রমুখ ভাষাতত্ত¡বিদগণ ও বর্তমান প্রবন্ধের লেখক উপস্থিত ছিলেন। মৌলবী সাহেব বলেন, ইংরেজি, উর্দু ও হিন্দির পর আবশ্যক সংস্কার করে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষায় পরিণত করা যাইতে পারে। ডা. তারাপুরওয়ালা বাংলার এইরূপ কোনো আশা আছে মনে করেন না। তিনি হিন্দি ছাড়া আর কোনো ভাষার আমাদের Lingua Franca হইবার সম্ভাবনা দেখেন না। পক্ষান্তরে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন যে, রাজনীতির ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য স্থলে আমাদের সাধারণ ভাষা যে ইংরেজি হইবে ইহা এক প্রকার ঠিক হইয়া গিয়াছে। রাজনীতির ক্ষেত্রেও এতদিন ইংরেজি চলিতে ছিল কিন্তু এমন একটা কথা উঠিয়াছে ভারতীয় কোনো ভাষা চালাইতে পারা যায় কি না এবং এ উপলক্ষে হিন্দির নাম উঠিয়াছে। দক্ষিণের কথা ধরিলে তিনি ইংরেজি অপেক্ষা হিন্দিতে যে কোনো অসুবিধা হইবে, মনে করেন না।’
এ সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত হয়ে যায় যে, ভারত শেষ পর্যন্ত বিভক্ত হয়েই দু’টি দেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করছে, তখন ভারতে সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দির দাবিই বহাল থাকে। পক্ষন্তারে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা কী হবে তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দেয়। সংশোধিত লাহোর প্রস্তাবে ভারতের পশ্চিম ও পূর্বাংশে একাধিক রাষ্ট্রের বদলে একটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার পরপরই পাকিস্তানের সাধারণ ভাষার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। ঢাকা ও কলিকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিকদের অনেকেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ১৯৪০ সালের পর থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত যারা এ ব্যাপারে অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও কবি ফররুখ আহমদ, মোহাম্মদ আকরম খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজিবুর রহমান খাঁ, তালেবুর রহমান, মাহবুব জামাল জাহেদী, আবুল মনসুর আহমদ, কাজী আবুল হোসেন, আবদুল মতিন প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
১৯৪৭ সালের ১৭ মে হায়দরাবাদে এক উর্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান বলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে।’ এ রকম উক্তি, দাবি ও ঘোষণা তখন অনেকেই একের পর এক করতে থাকেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামানের ঘোষণার প্রতিবাদে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী আবুল হোসেন, আবদুল মতিন প্রমুখ দৈনিক আজাদে প্রবন্ধ লিখে তার জবাব দেন। পাকিস্তানের জন্মের এক মাস আগে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ স্বাধীন ভারতে হিন্দির মতো পাকিস্তানের উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। সেইসঙ্গে সমগ্র পাকিস্তানে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম করারও দাবি করেন। তাঁর এ প্রস্তাব ও দাবি অগ্নিতে ঘৃতাহুতির কাজ করে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকেই এই অন্যায় প্রস্তাব ও দাবির প্রতিবাদ জানান। ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় বিভিন্ন মহলে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন দেশ হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যুদয় ঘটে। এর সাধারণ ভাষা কী হবে সে প্রশ্নে কোনো সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে হয়নি। একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, বাঙালি মুসলিম রাজনৈতিক মহল ও বাঙালি মুসলিম বিদ্বৎসমাজ কখনো বাংলাকে পাকিস্তানের একমাত্র সাধারণ ভাষা করার দাবি করেনি। তারা উর্দুর পাশাপাশি বাংলার দাবি পেশ করেছে এবং পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে শিক্ষা ও আদালতের ভাষা করার কথা বলেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ১৭ দিন পর ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংস্কৃতি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ মজলিস প্রতিষ্ঠার প্রাণপুরুষ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক আবুল কাসেম। উল্লেখযোগ্য অন্য দুই সদস্য হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও শামসুল আলম। মজলিস ১৫ সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি পুস্তক প্রকাশ করে, যার লেখক ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. কাজী মোতাহের হোসেন এবং খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ। ওই পুস্তিকায় তমদ্দুন মজলিসের পক্ষে অধ্যাপক আবুল কাসেম যে প্রস্তাব করেন তার মধ্যে এ অভিমতেরই প্রতিফলন রয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে : ১. বাংলা ভাষাই হবে ক. পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, খ. পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা, গ. পূর্ব পাকিস্তানে অফিসাদির ভাষা। ২. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুইটি- উর্দু ও বাংলা।
এসব প্রস্তাব বা দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবোচিত। পাকিস্তানে বাঙালিরাই হয়ে দাঁড়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, অন্তত ৫৬ শতাংশ। সে মতে, তাদের মাতৃভাষাই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার প্রথম হকদার।
বাংলা ভাষা কোনো দুর্বল ও অর্বাচীন ভাষা নয়। রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যাবতীয় সক্ষমতা ও যোগ্যতা তার রয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বলে বাঙালিরা উর্দুর বিরোধীও নয়। তারা উর্দুকেও রাষ্ট্রভাষা করে সম্মান দিতে চায়। কারণ, তারা উর্দুকে অন্যতম মুসলিম ঐতিহ্য সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে বিবেচনা করে। উর্দু চর্চা বা উর্দুতে সাহিত্য রচনার নজিরও রয়েছে বাঙালিদের।
কিন্তু এই যুক্তি-বিবেচনা ও বাঙালিদের ঔদার্য পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর অনেকেরই বুদ্ধি ও হৃদয় দিয়ে বোঝার ক্ষমতা ছিল না। ছিল না বলেই তারা শুরু থেকে বাংলার রাষ্ট্রভাষার দাবিকে উপেক্ষা ও অস্বীকার করতে থাকে। অন্তরালে নানা রকম ঘোঁটও পাকাতে থাকে। এতে বাঙালিরা স্বভাবতই বিচলিত হয়ে পড়ে। তারা পাকিস্তানের পক্ষে ব্যাপক সমর্থন এই জন্য দিয়ে ছিল যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। শিক্ষার বিস্তার ঘটবে। তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হয়ে চাকরি-বাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। কিন্তু স্বাধীন দেশে বাংলা শিক্ষা ও অফিস-আদালতের ভাষা না হলে তাদের এ প্রত্যাশা পূর্ণ হবে না। তাদের ফের শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে হবে। এসব আশঙ্কা তাদের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে মানি অর্ডার ও টেলিগ্রাম ফরম, ডাকটিকিট ও মুদ্রায় ইংরেজির পাশাপাশি উর্দুর স্থান প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা হয় উপেক্ষিত। শুধু তাই নয়। কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন উচ্চতম সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি সার্কুলার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর প্রেরণ করে। ওই পরীক্ষায় ৩১টি বিষয় নির্বাচন করা হয়, যার মধ্যে ৯টি ছিল ভাষা। ওই ৯টি ভাষার মধ্যে ইংরেজি, উর্দু, জার্মান, ফ্রেন্স এমনকি ল্যাটিন ও সংস্কৃতির স্থান হলেও বাংলার স্থান হয়নি। এই সার্কুলারের প্রতিবাদ করে নবগঠিত তমদ্দুন মজলিসের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাসেম। বিবৃতিটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদে প্রকাশিত হয়। এরপর সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ এর ওপর একটি কড়া সম্পাদকীয় লেখেন। তমদ্দুন মজলিস শুরু থেকেই জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সেমিনার, আলোচনা, বিবৃতি, পোস্টার ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে আসছিল। ইত্তেহাদে সম্পাদকীয় প্রকাশের পর শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি পায়। ভাষার দাবি আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে। আর এ আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন হিসেবে তমদ্দুন মজলিসের নাম ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে যে অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে, ঢাকায় যে আন্দোলন গড়ে উঠছে, কেন্দ্রীয় সরকার তাতে কোনো পাত্তা দেয়ারই প্রয়োজন দেখায় না। এই পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিস আন্দোলনে সহযোগী শক্তির সহায়তা লাভের চেষ্টায় তাৎপর হয়ে ওঠে। এর মধ্যে গণআজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক যুবলীগ নামের দু’টি সংগঠন ভাষার দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। এদিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগের একাংশ সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপ ঢাকায় পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মীশিবিরকে কেন্দ্র করে কাজ করছিল। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হল মিলনায়তনে অধ্যাপক নাজমুল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এই গ্রুপটি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামে একটি ছাত্র সংগঠনের জন্ম দেয়। নঈমুদ্দীন আহমদ এর কনভেনর নির্বাচিত হন। আর ঢাকা শহর কমিটির কনভেনর হন অলি আহাদ। এই ছাত্র লীগ গোড়া থেকেই ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের তরফে ৮ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিনিধদল পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভাষার মর্যাদাসহ বিভিন্ন দাবি পেশ করে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে এবং কেন্দ্রে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি জানান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এর বিরোধিতা করেন। ইতোমধ্যে খাজা নাজিমুদ্দীনও তার অবস্থান পরিবর্তন করেন। এর প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়, যাতে সভাপতিত্ব করেন অধাপক আবুল কাসেম। ২৭ ফেব্রুয়ারি তমদ্দুন মজলিসের অফিসে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় শামসুল আলমকে আহবায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠিত করা হয় এবং ১১ মার্চ হরতাল, সভা ও মিছিলের আহবান জানানো হয়। উল্লেখ্য ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার আহবায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিজ্ঞানের শিক্ষক নূরুল হক ভুঁইয়া। যাহোক, ১১ মার্চের হরতাল, সভা-মিছিল ব্যাপকভাবে সাফল্যমন্ডিত হয়। পুলিশি হামলা, নির্যাতন ও গ্রেফতারও হয় ব্যাপক হারে। অতঃপর ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বহু আলোচনা ও বিতর্কের পর উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দীন ও সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেন।
চুক্তির দফাগুলো ছিল :
১. পূর্ববঙ্গ পরিষদের চলতি অধিবেশনে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা এবং সর্বস্তরের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব পাস করতে হবে।
২. বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ সম্বলিত প্রাদেশিক পরিষদে গৃহীত একটি প্রস্তাব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠাতে হবে।
৩. ভাষা আন্দোলন চলাকালে গ্রেফতারকৃত সকল রাজবন্দির মুক্তি দিতে হবে।
৪. আন্দোলন সমর্থনকারী পূর্ববঙ্গ ও কলকাতার সকল পত্রিকার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. পুলিশ এবং দায়িত্বে নিয়োজিত কমান্ডিং অফিসারদের সকল নির্যাতনমূলক কার্যকলাপের অনুসন্ধানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত দল গঠন করতে হবে।
৬. আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকলের ওপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
৭. সরকারিভাবে ঘোষণা করতে হবে যে, এ আন্দোলন গভীর দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। প্রেসনোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে তা ঢাকা থেকে তার ভাষণে বলতে হবে।
৮. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার পর আমি (খাজা নাজিমুদ্দীন) এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়েছি যে, এ আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি।
এভাবেই ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় পর্বের শুরু এর কিছুদিন পর। সে আরেক কাহিনী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন