কামরুল হাসান দর্পণ
বাংলাদেশে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা কত? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া মুশকিল। দেখা যায়, সরকারি হিসাব এক রকম, অন্যদিকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব আরেক রকম। অবশ্য সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিনই বটে। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় হিসাব করাও সম্ভব নয়। কিছুটা হেরফের হওয়া স্বাভাবিক। তবে হিসাবের ব্যবধানটা কম হলে তাকেই স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে নেয়া যায়। বেকারের আবার ধরন আছে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, বয়স্ক এবং তরুণ। তরুণদের মধ্যে নারীও আছে। নারী বেকারত্বের সংখ্যা আলাদাভাবে পাওয়া যায় না। গড়পড়তা হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। তবে ২০১০ সালে ‘সমুন্নয়’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থা হিসাব দিয়েছিল, দেশে কর্মক্ষম নারীর সংখ্যা ১০ লাখ। এ সংখ্যা ৬ বছরে নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি প্রেডিক্ট করে ২০১৫ সালে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯.৪০ শতাংশ হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে কর্মক্ষম ৫ কোটি ৬৭ লাখ লোকের মধ্যে কাজ করছে ৫ কোটি ৫১ লাখ। তার অর্থ, বেকারের সংখ্যা মাত্র ২৬ লাখ। এ হিসাব কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, আইএলও, বিশ্বব্যাংক, কমনওয়েলথ-এর হিসাব দিয়েছে, গত এক দশকে বেকারত্বের হার বেড়েছে ১.৬ শতাংশ। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এদের মধ্যে কাজ পায় মাত্র ৭ লাখ। এর মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার রয়েছে। তবে গত বছর একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকার প্রায় পৌনে এক কোটি। প্রতি বছর এর সাথে নতুন নতুন বেকার যুক্ত হচ্ছে। পরিসংখ্যানগত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় মাধ্যম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৯৫ ভাগ কর্মসংস্থান করে। এর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান করছে পোশাকশিল্প। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ লোক কাজ করছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থার অবদান মাত্র ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা নিয়ে সরকারি, বেসরকারি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হিসাবের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য দেখা না গেলেও সরকারি হিসাবের সাথে বিস্তর পার্থক্য দেখা যায়। সরকার দেশে বেকারের সংখ্যা কম দেখাবে, এটাই স্বাভাবিক। বেকারের সংখ্যা বেশি দেখানো সরকারের ব্যর্থতা নির্দেশ করে। কোনো সরকারই এই ব্যর্থতা দেখাতে চায় না। বেকারের সংখ্যা নিরূপণে যদি বেকার নিবন্ধনের একটি ব্যবস্থা থাকত, তাহলে হয়তো বেকারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যেত। আমাদের দেশে বেকার নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব তথ্য-উপাত্ত এখানে তুলে ধরার একটি কারণ রয়েছে। কারণটি হচ্ছে, আমাদের দেশে যেখানে কোটি কোটি বেকার নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সেখানে গত শনিবার একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চাকরি বাজারে বিদেশিদের আধিপত্যের কথা। বাংলাদেশিদের ছাঁটাই করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো নিয়োগ দিচ্ছে চীন, কোরিয়া, ভারত ও শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকদের। দেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোটি কোটি বেকারের যেখানে কর্মসংস্থান হয় না, সেখানে বিদেশিদের নিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সংবাদ দেখে বিস্মিত এবং দুঃখিত না হয়ে পারা যায় না।
দুই.
রেমিটেন্স নিয়ে আমাদের সরকারের গর্বের সীমা নেই। কিছু দিন পর পর রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন, ৩০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, এমন তথ্য উৎফুল্ল চিত্তে জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়। বলাবাহুল্য, এই রিজার্ভের জোগানদাতা যারা তারা জমিজমা, বসতবাটি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে দিন-রাত হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে। তাদের ঘাম ঝরানো অর্থেই বাংলাদেশের রিজার্ভ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে সরকারের ভূমিকা কী? সরকারের গর্ব করারই বা কী আছে? যে সরকার কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান করতে সক্ষম হচ্ছে না, তার কি এ নিয়ে খুব বেশি অহংকার করা সাজে? যেসব মানুষ বিদেশে গিয়ে দাসগিরি করছে, তাদের সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কতটুকু ভূমিকা রয়েছে? সরকার কি নিজে উদ্যোগী হয়ে বেকারদের বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে? আমরা জানি, এসব কর্মক্ষম এবং কর্মস্পৃহ মানুষ নিজ প্রচেষ্টায় ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে গেছে। এখনো যাচ্ছে। এমনকি যারা সর্বস্ব বিক্রি করে প্রতারক দালাল চক্রের দ্বারা প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রে তো সরকারের ভূমিকা দেখা যায় না। আবার এ কথাও তো সত্য, এ সরকারের আমলেই মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হয়েছে। এ বাস্তবতাকে আড়াল করতে দেশের মানুষ সরকারের তরফ থেকে অনেক নাটকও দেখেছে। ঘটা করে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি করে ঘোষণা করা হয়েছে বছরে লাখ লাখ মানুষ যাবে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল এসব চুক্তি-টুক্তি আষাঢ়ে গল্পে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সউদি আরব পুনরায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেবে বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সউদি আরবের শ্রমবাজারের দ্বার খুলে দেয়া হয়েছে। তবে বিগত ঘোষণার অসারতা পর্যবেক্ষণ করে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাদের সংশয় এ কারণে যে, এর মধ্যে সউদী আরবে লোক পাঠানো নিয়ে বড় বড় কথা বলা হলেও, শেষ পর্যন্ত তা অনেকটা লোক দেখানোতে পরিণত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি দেশের মানুষ আরেকটি দেশে গিয়ে অমর্যাদাকর কাজ করে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠাবে, তা ওই দেশের জন্য গৌরবের কিছু নয়। এ যুগে একে আধুনিক দাসবৃত্তি বলা হয়। মর্যাদাশীল কোনো জাতি চাইবে না, তার নারীরা বিদেশে গিয়ে গৃহকর্মীর কাজ করুক। তরুণরা নি¤œশ্রেণির শ্রমিকের কাজ করে কাজের লোকের মতো খুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকুক। সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকরা তাদের নিচু দৃষ্টিতে দেখে বলুক, অমুক দেশের ফকির-মিসকিন। আমাদের দেশ থেকে যেসব তরুণ কামলা খাটতে যায়, কোনো কোনো দেশ তাদের এই দৃষ্টিতেই দেখে। এটা নিশ্চিতভাবে গ্লানিকর। অথচ আমাদের রাষ্ট্রের কর্ণধারদের এ নিয়ে গর্বের সীমা থাকে না। এর কারণ প্রবাসীরা যে টাকা পাঠায়, তাতে রাষ্ট্রের কোষাগার সমৃদ্ধ হয়। আর এর ক্রেডিট রাষ্ট্র পরিচালকরা নেন। অথচ প্রবাসে যেসব শ্রমিকের মৃত্যু হয়, নীরবে লাশ দেশে ফেরে এবং পরবর্তীতে তাদের পরিবার যে ধরনের দুর্দশায় পড়ে, রাষ্ট্রকে তার দায়দায়িত্ব নিতে দেখা যায় না। মৃত্যুবরণকারী প্রবাসী শ্রমিক যে রাষ্ট্রের কোষাগার সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রেখে গেল, তার স্বীকৃতিটুকুও দেয়া হয় না। এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের দেশের যেসব কর্মদ্যোমী তরুণ নিজ প্রচেষ্টায় ভাগ্য উন্নয়ন তথা অর্থনীতিতে অবদান রাখতে প্রবাসে পাড়ি জমায়, সেক্ষেত্রে সরকার তার দায়িত্ব পালনে ভূমিকা রাখতে পারছে না। একে দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য এবং দেশ পরিচালকদের ব্যর্থতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! গত কয়েক বছর ধরে সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হচ্ছে, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। নি¤œমধ্যবিত্ত দেশে পরিণত হয়েছি। ভবিষ্যৎদ্বাণী করে বলা হচ্ছে, আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। এসবই যে বাস্তব পরিস্থিতির সাথে সাংঘর্ষিক তা ইতোমধ্যে অর্থনীতিবিদরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, দেশে এখনো চার কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র সীমার মধ্যে রয়েছে, যা মোট জনসংখ্যার ২৪.৪৭ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, যে ব্যক্তির দৈনিক আয় ১.২৫ ডলার বা প্রায় ৯৭ টাকা সে দরিদ্র। এ হিসাবে দেশের ৪ কোটিরও বেশি মানুষ দৈনিক এ আয় করতে পারছে না। তারা দরিদ্র রয়ে গেছে। এর সাথে বেকার বা যার কোনো আয় নেই তা যুক্ত হয়ে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য সীমা অতিক্রম করতে পারেনি। যে তরুণ বেকার, বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল, সে তো আরও দরিদ্র। অথচ সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা দেখা যায় যে, দেশের মানুষ খুব সুখে-শান্তিতে আছে। তারা সুখনিদ্রায় আছে। এক্ষেত্রে যে বিরাট একটি শুভংকরের ফাঁকি রয়ে গেছে, তা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকার তাদেরকেই গণনায় ধরছে যাদের আয় আকাশছোঁয়া। তাদের উন্নতিকে উন্নয়নের মাপকাঠি মনে করছে। এই খ-িত উন্নয়নকেই সরকার ব্যানার আকারে তুলে ধরে বলছে, আমরা অনেক উন্নতি সাধন করছি।
তিন.
যে দেশে চার কোটি মানুষ দরিদ্রসীমা অতিক্রম করতে পারেনি এবং আরও ছয় কোটি বেকার থাকে, সে দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নতি করছে, এ কথা সামান্য জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়ার কথা। সরকারের কথামতো যদি উন্নয়নের চাকাটি তরতর করে এগিয়ে যেত, তাহলে এত মানুষ দরিদ্র ও বেকার থাকার কথা নয়। কর্মসংস্থানের এই আকালের মধ্যে যদি বিদেশিরা এসে হানা দেয়, তাহলে কোটি কোটি বেকারের দুঃখ ঘুচবে কী করে? নিবন্ধের শুরুতে যে দৈনিকের সংবাদ উল্লেখ করেছি, তাতে দেখানো হয়, দেশের বিভিন্ন কোম্পানিসহ মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি কাজ করছে। এদের বেশির ভাগই কর্মকর্তা পর্যায়ের। তাদের একেক জনের বেতন পাঁচ বাংলাদেশি কর্মকর্তার মোট বেতনের চেয়েও বেশি। অর্থাৎ এক বিদেশি কর্মকর্তা পাঁচজন দেশীয় কর্মপ্রত্যাশীর জায়গা দখল করে রেখেছেন। এ হিসেবে বিদেশি কর্মকর্তারা প্রায় ৫০ লাখ বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সুযোগ কবজা করে নিয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেয়া হয়েছে ভারতীয়দের। বেসরকারি সংস্থা সিপিডির এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় কাজ করছে। তারা বছরে ৩.৭৬ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ দেশটির পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রদানকারী দেশ। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, একদিকে আমাদের লোকেরা বিদেশে গিয়ে চরম প্রতিকূল পরিবেশে থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে দেশ থেকে বিদেশিরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী ভারত বাংলাদেশকে তার অন্যতম শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণকারী দেশে পরিণত করেছে। যেখানে বাংলাদেশে কর্মক্ষম বেকার উপচে পড়ছে, সেখানে বিদেশিদের এই আধিপত্যকে কোন ভাষায় প্রকাশ করা যায়, তা জানা নেই। দুঃখজনক হচ্ছে, যোগ্য বাংলাদেশি চাকরি প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশি কর্মী ছাঁটাই করে বিদেশিদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল, বিদেশিদের নিয়োগ দিলে তাদের প্রেস্টিজ বাড়ে। তাদের এ মানসিকতা যে দেশকে, দেশের কর্মক্ষম বেকারদের উপহাস করা, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। তাদের মধ্যে এ বোধটুকু কাজ করছে না, যদি দেশের একজন বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়, তবে দেশের অনেক বড় উপকার হয়। একজন বেকারের কর্মসংস্থানের কারণে একটি পরিবার বেঁচে যায়। দেশের অর্থনীতি গতি লাভ করে। দেশের টাকা দেশে থেকে যায়। তাদের এ মানসিকতা কি দেশপ্রেমহীনতা নয়? তারা এটা মনে করে না, আমাদের দেশ মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত দেশ নয় যে, বাইরের দেশ থেকে শ্রমিক আমদানি করে কাজ করাতে হবে। যেখানে আমাদের দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকার তরুণরা উন্নত দেশে মজুরের কাজ করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশিদের চাকরি দেয়া কি তাদেরকে উপেক্ষা, উপহাস ও অবহেলা করা নয়? আমাদের বিদেশিপ্রেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এ বোধ কে জাগাবে? বাংলাদেশে বিদেশি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যে নিয়োগ করা যাবে না, তা নয়। বিনিয়োগ বোর্ড একটি নীতিমালা করে দিয়েছে। নীতিমালায় বলা আছে, একজন বিদেশি নিয়োগ দিতে হলে তার বিনিময়ে পাঁচজন বাংলাদেশি নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি এ কথাও বলা আছে, নিযুক্ত বিদেশি নাগরিকের কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে বিদেশিকে বিদায় করে দিতে হবে। নীতিমালা যথাযথভাবে করলেও বিদেশিদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তার কোনো তোয়াক্কা করছে না। বিনিয়োগ বোর্ড বা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও এ নীতিমালা অনুসরণ করছে কিনা, তার কোনো তদারকি করছে না। করলে এভাবে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি নিয়োগ দিতে পারত না। এটা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! প্রতিবেদনে এ কথাও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কত সংখ্যক বিদেশি কর্মরত তার সঠিক হিসাব সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, বাংলাদেশে অবস্থানকারী বৈধ বিদেশি আছেন ১ লাখ ১১ হাজার ৫৭৫ জন। অথচ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদেশি আছে প্রায় ১০ লাখ। এদের বেশির ভাগ ট্যুরিস্ট ভিসায় এলেও তাদের মূল লক্ষ্য কাজ করা। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে ছুটি নিয়ে দেশে গিয়ে নতুন করে আবার ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো লাখ লাখ বিদেশিকে নিয়োগ দিয়ে একদিকে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে চলে যাওয়ার পথ তৈরি করে দিচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের পথটিকেও রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। বিদেশি চাকুরেদের এই অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া যে দেশের বেকারত্বের হার অধিক বাড়িয়ে দেয়া এবং যুব সমাজকে অসহনীয় হতাশার দিকে ঠেলে দেয়া, বিষয়টি কেউই আমলে নিচ্ছে না।
চার.
বিশ্বের কোনো দেশই বেকারত্ব থেকে মুক্ত নয়। উন্নত বিশ্বেও বেকারত্ব রয়েছে। তবে তাদের বেকারত্ব আর আমাদের দেশের মতো উন্নয়নকামী দেশের বেকারত্বের ধরন এক নয়। সেখানে সরকারিভাবে বেকারদের ভাতা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। যদিও সেসব দেশের বেকাররা এ ভাতা নেয়াকে অসম্মানজনক মনে করে। আবার ইউরোপের বেশ কিছু দেশ আছে, যাদের জনশক্তি কম এবং কাজ করার মতো পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব রয়েছে। তারা অন্য দেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আমদানি করে। আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাব থাকলেও কর্মক্ষম বিপুল জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের বেশির ভাগই তরুণ। বলা যায়, তারুণ্যে ভরপুর একটি দেশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তরুণ জনগোষ্ঠীর এ সুবিধা যদি কাজে লাগানো যায়, তবে বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করবে। এই জনগোষ্ঠীকে বোঝায় পরিণত না করে কাজে লাগানোর সব ধরনের ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করতে না পারলে এ সম্পদ হারিয়ে যেতে সময় লাগবে না। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, সরকারের এদিকে তেমন মনোযোগ নেই। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে যে এদের কাজে লাগাবে, তার কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। উদ্যোগ থাকলে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তে হ্রাস পেত বা এক জায়গায় স্থির থাকত। বলার অপেক্ষা রাখে না, কর্মসংস্থানের মূল ক্ষেত্র হচ্ছে বিনিয়োগ। এর মাধ্যমে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য ক্ষেত্র গড়ে তোলা হয়। বিনিয়োগের এ ক্ষেত্রটি বিগত কয়েক বছর ধরে ঋণাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। সরকার মুখে মুখে বিনিয়োগের প্রাচুর্যের কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে, নতুন শিল্প-কারখান গড়ে ওঠা দূরে থাক, বিদ্যমান অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস, বিদ্যুতের অভাবে অনেক কারখানা চালু করা যাচ্ছে না। কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত পোশাকশিল্পে প্রায় পাঁচশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বলে ইতোমধ্যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বেকার হয়েছে পনের লাখের বেশি কর্মজীবী। ফ্রেশ বেকারের সংখ্যার সাথে কর্মচ্যুত বেকার যুক্ত হয়ে বেকারত্বের মিছিলটিকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ করে তুলছে। এই বেকারদের অনেকে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা থেকে শুরু করে মাদকাসক্তি ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নিচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা। বেকাররা পরিণত হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও দেশের বোঝায়। এই বেকারের দেশই আবার কোনো কোনো দেশ তাদের আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত করেছে। ভারত তো অন্যতম শীর্ষ রেমিট্যান্স আহরণের দেশ বানিয়ে ছেড়েছে। এ যেন মরুর বুকে মরুদ্যান সৃষ্টি করা। কেবল আমরাই পারলাম না, এ মরুদ্যান রক্ষা করতে। ইচ্ছাকৃতভাবে বিদেশিদের হাতে তা ছেড়ে দিচ্ছি। একদিকে জনশক্তি রপ্তানি করছি, অন্যদিকে আমদানি করছি। আমাদের বেকার তরুণরা একটি চাকরির সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছে, বিদেশ যাওয়ার জন্য সর্বস্ব বিক্রি করছে, অন্যদিকে আমাদেরই প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশিদের নিয়োগ দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা যে উন্নতির কথা বলছি, তা মানুষের কাছে প্রহসন হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। এ ধরনের প্রহসন চলতে দেয়া যায় না। দেশের বেকারত্বের রাস টেনে ধরতে সরকারকে অবশ্যই এদিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিদেশি নিয়োগের ক্ষেত্রে নীতিমালা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান বিদেশিদের নিয়োগ দিচ্ছে, তাদেরও দেশের বেকারত্বের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়ে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বেকারদের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে হবে। দেশের টাকা দেশে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন