কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি, যদিও নজরুলকে জাতিরাষ্ট্রের গ-ির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা কঠিন। তিনি সমগ্র মানবাত্মার মুক্তির গান গেয়েছেন। নিজের কবিতাকে ঔপনিবেশিক বৃটিশ ভারতের মুক্তির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক শ্লোগান করে তুলেছিলেন। কবিতার জন্য ঔপনিবেশিক শাসকের কারাগারে বসেও শিকল ভাঙার গান গেয়েছেন। যে গান ও কবিতা ঔপনিবেশিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি ও পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধে প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিল। ‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত/ আমরা টুটাব তিমির রাত/ বাঁধার বিন্দাচল’ কবির এই কবিতাকে আমরা রণসঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছি। সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতাকে ডিঙিয়ে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রেরণায় নজরুল ইসলামই আমাদের প্রথম পথ প্রদর্শক। ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছো মহান/ তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান/ কন্ঠক মুকুট শোভা দিয়াছ তাপস/ অসঙ্কোচ প্রকাশের দূরন্ত সাহস’। এমন প্রবল সাহসী অর্ন্তদৃষ্টিপূর্ণ উচ্চারণ বাংলাসাহিত্যে আরো কারো নেই। এই নজরুল ইসলামকে আমরা কতটা জানি, যতটা জানি তার কতটা তার সত্যিকার চেতনাকে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। নজরুল গবেষকরা ঢাউস ঢাউস জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন। সেখানে নজরুলের একেকটা খ-িত প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। আজকে আমাদের যে সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা, সর্বব্যাপী অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনার ক্ষমতাদর্পী ঔদ্ধত্য থেকে মুক্তির চেতনাকে শাণিত করতে নজরুলের রচনা আমাদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজনীয়, অপরিহার্য। আল্লাহতায়ালা আমাদের এই দেশকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। এই দেশের উর্বর মাটি, মিষ্টি পানির অসংখ্য নদ-নদী, সবুজ প্রান্তর, সমুদ্রঘেরা বেলাভূমি, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত পাহাড় আর অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহনকারি ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ। এই সবকিছুকে ঘিরেই নজরুল আমাদেরকে একটি সমৃদ্ধ জাতি গঠনের প্রেরণাদায়ী রচনা সম্ভার রেখে গেছেন। এ জন্য একমাত্র নজরুল ইসলামও আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনা ও স্বাতন্ত্রের মূল স্তম্ভ ও শ্রেষ্ঠ সম্পদ। চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় অবক্ষয়ের চোরাবালি ও মূল্যবোধের খরায় নজরুল চর্চা আমাদের মুক্তির পাথেয়। আমাদের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ যেমন আত্মঘাতী ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের শিকার, একইভাবে নজরুলও যেন দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পড়েছেন।
বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থা সঠিক অবস্থানে নেই। গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুন্ঠন, বাড়ছে বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা কারিক্যুলাম থেকে শুরু করে জাতি গঠনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে একটি মারাত্মক বিপর্যয় পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৌশলে চাপিয়ে দেয়া আধিপত্যবাদী অর্থনীতি, সীমান্তে কাঁটাতারের ওপার থেকে গুলি করে এপারের মানুষ হত্যা, নদ-নদীর প্রবাহ রুদ্ধ করে পানি আগ্রাসন, অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে জাতীয় চেতনা ও মূল্যবোধকে বন্ধ্যাত্বের দিকে ঠেলে দেয়ার বাস্তবতা নজরুলের যুগে ছিল না। নজরুলের সৃষ্টিশীল সময়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বও ছিলনা। তারপরও ‘বাংলাদেশ’ নামক শব্দটি নজরুলের কাছ থেকেই উপহার পাওয়া। বাংলাভাষাভাষী জনপদকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পরিচয়ে স্বাধীন করতে লাখো মানুষের রক্ত ঝরাতে হয়েছে। যখন কোটি কোটি মানুষের শ্রমে-ঘামে এই জনপদ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করতে শুরু করেছে, তখন আমরা সর্বব্যাপী ষড়যন্ত্র ও লুন্ঠনের আগ্রাসী থাবা ক্রমশ বিস্তৃত হতে দেখছি। আমাদের নদী, পাহাড়, সমুদ্র, কৃষি, শিল্প, রাজনীতি-অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক চেতনা ও ঐক্যের ভিত্তিভূমি আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি নজরুলও কি আক্রমণের টার্গেটে পরিনত হয়েছে। বুঝে বা না বুঝে, হীনস্বার্থে বা বিভ্রান্তিতে পড়ে আমরা নিজেরাই কি নজরুলকে আক্রমণ করতে শুরু করেছি? রাষ্ট্র বাঙালীর আত্মঘাতী প্রবণতা নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই।
হাজার বছরের রাজনৈতিক পথপরিক্রমা শেষে লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীন সত্ত্বার উপর আঘাত তথাকথিত বাঙালীদের কাছ থেকেই বেশি এসেছে। কার্যত বাঙালিত্ব পরিত্যাগকারী বৃটিশ-ভারতীয় নাগরিক শ্রী নীরদচন্দ্র চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি। রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ বলে নিজের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন। তিনি তার দীর্ঘ প্রবাস জীবনে বেশ কিছু গ্রন্থ লিখেছিলেন। এর মধ্যে দুটি মাত্র বাংলায় লেখা; প্রথমটি বাঙালী জীবনে নারী আর দ্বিতীয় এবং শেষটি হচ্ছে আত্মঘাতী বাঙালি। ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ নামক রচনায় তিনি বাঙালী হিন্দুর ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ এবং ইংরেজী সাহিত্য পঠনের মধ্য দিয়ে নবশিক্ষিত বাঙালী মানসে যে নতুন চেতনার জন্ম হয়েছিল তাকে বাঙালির রেঁনেসা বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য এর আগে শ্রী চৈতন্যের আবির্ভাব ও তার নতুন ভক্তিবাদের প্রচার-প্রসারকে বাঙালির প্রথম রেঁনেসা বলে আখ্যায়িত করেন নীরদ সি চৌধুরী। এই রেনেসাঁসের ধারাক্রমে প্রথম ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজী ভাষাকে ভারতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বৃটিশদের স্বীকৃতি দেয়া এবং ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী হিন্দুর মনে যে নতুন চেতনাবোধের জন্ম হয়েছিল মূলত তাকেই তিনি বাঙালীর রেঁনেসা বলে দাবি করেছেন। যে সময়টাতে এ দেশের মুসলমানদের অন্তত একশ বছর দাবিয়ে রাখার কলাকৌশল গ্রহণ করে হিন্দুদের হাতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব তুলে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছিল, সেই সময়টাকেই বাঙালীর রেনেঁসাসের পটভূমি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য, পলাশী যুদ্ধে স্বাধীনতা হারানোর শত বছর পূর্তির বছর বাংলার স্বাধীনচেতা মুসলমান ও হিন্দুরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়ে ভবিষ্যতের স্বাধীনতার বীজ বপণ করেছিল। নীরদ সি চৌধুরী সে সময়টাতে বাঙালীর ইংরেজী শিক্ষা ও বৃটিশ ভাবাদর্শ গ্রহণের প্রবণতাকে রেনেঁসাস বা নবজাগরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এমন একজন বাঙালী যদি ‘আত্মঘাতি বাঙালী’ রচনা করেন, সেটা তো প্রকারান্তরে তারই আত্মচরিত বলে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য। অবিভক্ত বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আকাক্সক্ষা ও মর্যাদার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে শুধুমাত্র বাঙালী হিন্দুর বিষয়-আসয়গুলোতে বৃটিশদের প্রভাবকেই তিনি বাঙালীর নবজাগরণ বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বাবু, বুদ্ধিজীবী ও নীরদ চৌধুরীদের এই খ-িত চিন্তা-চেতনাই সাতচল্লিশে বাংলাকে বিভক্ত করার পটভূমি রচনা করেছিল।
তথাকথিত বাঙালী বাবু, বৃদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা সংকীর্ণ ভেদবুদ্ধির কারণে কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসাম্প্রদায়িক বিশ্বমানবিক চেতনাকে ধারণ করতে পারেননি। এখানেই নজরুলের সাথে সমকালীন অন্যদের বিস্তর পার্থক্য। এ কারণেই হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙ্গালী মুসলমানের স্বাধীন রাষ্ট্রের জাতীয় কবি তিনি। রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন, ‘রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি’ বলে। আর বাঙ্গালী মাত্রই কি আত্মঘাতের প্রবণতা? সেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে শুরু করে দুই বাংলার চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেন এ সত্যই ফুটে উঠেছে। যে সময় নজরুল ইসলাম দুই বাংলার ঐক্যবন্ধনের মূল প্রেরণারূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, বিপরীত মেরুর মানুষগুলো নিজ নিজ অবস্থানে থেকে নজরুলের বিরোধিতায় মুখর হয়েছিল। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় নজরুল সেই ভূমিকার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কারণ, তিনি ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থ, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বংশানুক্রমিক স্বার্থের উপর আঘাত করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের স্বাধীরনতার সবুর্ণ জয়ন্তীর বছরে এসেও কি সেই হীনস্বার্থান্ধ গোষ্ঠী নজরুলকে নিজেদের প্রতিপক্ষ বলে গণ্য করছে? সেটা অনেক বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নের বিচার বিশ্লেষণ এখন এখানে সম্ভব নয়। সেটা নজরুল গবেষকরাই বের করবেন। কিন্তু নজরুল গবেষণার নামে, নজরুলের জীবনী লেখার নামে দেশে এখন এসব কি হচ্ছে? সে বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা জরুরি। গত ১৮ ফেব্রুয়ারী দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে নৈরাজ্য’। দেশের খ্যাতনামা নজরুল গবেষক, জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের লেখা নজরুলের উপর গবেষণামূলক জীবনী ‘কাজী নজরুল ইসলাম- জীবন ও সৃজন’ গ্রন্থটির প্রকাশনা বিপর্যয় এই প্রতিবেদনের মূল উপজীব্য। সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জাতীয় প্রতিষ্ঠান কবি নজরুল ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রকাশিত বিশাল এই গ্রন্থের প্রতি পাতায় ন্যূনতম ৫টি থেকে অর্ধশতাধিক পর্যন্ত বানান ভুলের বিষয়টি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারী কুশিক্ষিত, অযোগ্য ব্যক্তিরা যতই চেষ্টা করুন, গণমানুষের চেতনা থেকে নজরুলকে মুছে ফেলা হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না। তবে জাতি গঠনে, জাতীয় মুক্তির চলমান আন্দোলনে নজরুলের সাম্য-মৈত্রীর শিক্ষা থেকে নতুন প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন রাখার অপপ্রয়াস হয়তো সাময়িক সফল হতে পারে। আমাদের চলমান শিক্ষাক্রম এবং সমাজবাস্তবতায় তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় নজরুলকে পাঠ না করেই উৎরে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অথচ নজরুল মানস ও নজরুলের আত্মদর্শন ও বিশ্ববীক্ষা আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে অনেক বড় পথেয় হিসেবে গ্রহণীয়।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নজরুল গবেষণার ধরন, লক্ষ্য ও বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা ভিন্ন প্রসঙ্গ আমরা শুধু তার লেখা গ্রন্থটির প্রকাশনায় জাতীয় প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে কথা বলছি। একই সময়ে আরেক নজরুল জাতীয় অধ্যাপক ও নজরুল গবেষক, গোলাম মুরশিদের লেখার ভাব-ভঙ্গি, নজরুল সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নজরুলভক্ত কোটি মানুষকে সন্ধিগ্ধ ও হতাশ করেছে। মাইকেল মধুসুদন দত্তের জীবনী ‘আশার ছলনে ভুলি’ লিখে গোলাম মুরশিদ বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যে মাইকেল ও নজরুল দুই বিস্ময়কর প্রতিভা। মাইকেলের জীবনে পারিবারিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সংকট, চরম জীবন সংগ্রামের টানপোড়েন ছিল। সেসব কিছুকে গোলাম মুরশিদ একটি ইতিবাচক মানদ-ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু নজরুলের একটি নির্মোহ জীবনী লেখার কথা বলে গোলাম মুরশিদ নজরুল সম্পর্কে যে বক্তব্য ও ব্যক্তিগত মন্তব্য দিয়েছেন, তাতে নজরুল সম্পর্কে যে ধারণা তার কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, তা নির্মোহ নাকি বিতর্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরী হয়েছে। ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’ নামের একটি নজরুল জীবনী গ্রন্থের লেখক ড. গোলাম মুরশিদকে এবার একুশে পদকে ভূষিত করেছে সরকার। একুশে পদকের জন্য নানা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য দেশের একুশ জন বিশিষ্ট্য ব্যক্তির নামের মধ্যে গোলাম মুরশিদের নাম ঘোষিত হওয়ার পর তার নজরুল বিদ্বেষের কথা জনসম্মুখে চলে আসে। বিশেষত জাতীয় কবির পরিবারের পক্ষ থেকে নজরুলের দৌহিত্রী খিলখিল কাজী গোলাম মুরশিদকে একুশে পদক দেয়ার বিরোধিতা করে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য গত ৯ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। জাতীয় কবির প্রতি প্রকাশ্য বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ব্যক্তি কি করে একটি জাতীয় পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন, এটাই ছিল আবেদনের সারবস্তু। তবে ২০ ফেব্রুয়ারী আনুষ্ঠানিক পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠানে গোলাম মুরশিদকেও একুশে পদক ও পুরষ্কার তুলে দেয়া হয়েছে। গোলাম মুরশিদকে একুশে পদক দেয়ার বিরোধিতা করে কবি পরিবারের আাবেদনের প্রেক্ষাপটে গত ১৯ ফেব্রয়ারী দৈনিক সমকাল পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়েছে, গোলাম মুরশিদ তার লেখায় এবং বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্যে জাতীয় কবিকে অশ্রদ্ধা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। জাতীয় কবির নামে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল জীবনী গ্রন্থে শত শত বানান ভুল এবং নজরুলের সত্যিকারের জীবনী প্রকাশের নামে কবির প্রতি তাচ্ছিল্য, অবমাননা ও বদনাম লেপনের দায়ে অভিযুক্ত একজনকে দেশের সর্বোচ্চ পদকে ভূষিত করার মধ্য দিয়ে যে মেসেজ দেয়া হলো, তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
কবি নজরুল বরাবরই প্রতিকূল বাস্তবতার শিকার হয়েছিলেন। শৈশবে পিতৃহারা হওয়া, দারিদ্র্য, ঔপনিবেশিক শাসকদের দ্বারা কারারুদ্ধ হওয়া অত:পর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমৃত্যু নির্বাক হয়ে যাওয়ার মত জীবনের রূঢ বাস্তবতার সম্মুখীন কবির প্রতি মানুষের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও তার সংক্ষিপ্ত সৃষ্টিশীল সময়ের অর্জন। তিনি কখনো প্রভাবশালী শাসক, বিত্তশালী বা ক্ষমতা ও জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, যাতে বলা যায়, তার জীবনীকাররা বাধ্য বা প্রভাবিত হয়ে তার প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ জীবনী রচনা করেছিলেন। নজরুলের মত বড় কবির সংগ্রামী জীবনের পুরোটাই বৈচিত্রে ভরপুর এবং উন্মুক্ত। তার যেমন অজশ্র ভক্ত ছিল এবং আছেন, তার সমালোচকের সংখ্যাও কম ছিলনা। আমরা সব সময় সমকালীন সমাজ বাস্তবতায় নজরুল চর্চার প্রাসঙ্গিকতাকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও ব্যত্যয়ের কথা বলছি। কিন্তু নজরুলের কথিত জীবনীর নামে নজরুলের ব্যক্তি জীবনের উপর কালিমা লেপনের অপচেষ্টার হেতু কি হতে পারে! নজরুল তার গানে বলেছেন, ‘আমায় নহে গো, ভালবাস শুধু, ভালবাস মোর গান’। সেই সাথে দারিদ্র্যসহ প্রতিকূল সমাজবাস্তবতা ডিঙিয়ে মহৎ প্রতিভা কিভাবে ইতিহাসে স্থান করে নেয় নজরুল তার শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। আমরা নিজেদের জীবনে এবং আগামী প্রজন্মের কাছে নজরুলের সেই দৃষ্টান্তই বার বার স্মরণ করতে চাই। এতেই জাতির কল্যাণ। দরিদ্র, ছন্নছাড়া, গৃহত্যাগী, বাউন্ডুলে, ক্ষ্যাপা, বিদ্রোহী, বাঁধনহারা এসবই নজরুল চরিত্রের সাথে সংযুক্ত। এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে নজরুলের বিশাল সৃষ্টি সম্ভারে যে সাম্য, মৈত্রী, মানবতার জয়গান আছে, যে আধ্যাত্মবোধ কোনো প্রবল শক্তির অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার প্রেরণা সঞ্চার করে সেই নজরুলকে খুব কমই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে রুমি, ফেরদৌসি, দান্তে, গ্যেটে, ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের মত কবি-সাহিত্যিকরা একেকটি জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সেই সাথে এরা বিশ্ব সভ্যতারও শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এদের নিয়ে জাতির স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সেতু রচিত হয়। জাতীয় কবিকে নতুন প্রজন্মের কাছে বিতর্কিতভাবে উপস্থাপনের যেকোনো অপপ্রয়াস কঠোরভাবে প্রতিহত করা রাষ্ট্র ও জনগনের কর্তব্য। নির্মোহ জীবনীকারের ভান করে রাজনৈতিক সমালোচকের মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রেম-বিদ্রোহ ও আধ্যাত্মবোধের কবি নজরুলকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা অসম্ভব। প্রকাশনার মাধ্যমে যদি কেউ অশ্রদ্ধা দেখিয়ে থাকেন, তাঁকে বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করেন, তার সম্পর্কে আমাদেরকে নতুন সিদ্ধান্তে আসতে হবে। নজরুল ইনস্টিউটের মত প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় কবির রচনাসমূহকে যথোপযুক্ত মান ও নির্ভুলভাবে প্রকাশনার যথাযথ দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি নজরুল গবেষণা ও অনুবাদের মাধ্যমে নজরুলকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’ অমানিশা রজনী পেরিয়ে আগামী প্রজন্মকে জেগে ওঠার প্রেরণাদায়ী কবিকে জাতির মননে সমাসীন শ্রদ্ধার উচ্চ আসন থেকে নামিয়ে ভুল-ভ্রান্তিতে বেপথু সাধারণ রক্ত-মাংসের মানুষে পরিনত করার যেকোনো অপচেষ্টা রুখতে হবে। নজরুলকে নয়, তার সৃষ্টিকে ভালবেসে চর্চা করার কথা কবি নিজেই বলে গেছেন। আমাদের সাহিত্য গবেষকরা বরং সে দায়িত্বটিই সঠিকভাবে পালন করলে জাতি উপকৃত হবে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন