গত বছরের শুরুতে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আগে ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। ঢাকাসহ সারাদেশে হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। করোনা মাহামারি অন্য সব সমস্যা-সংকট ভুলিয়ে দিয়ে পুরো বিশ্বকে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ইতিমধ্যে নানাবিধ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে আসার সাথে সাথে ভ্যাকসিনেশন শুরু হলেও ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার পুরনো আতঙ্ক আবারো জেঁকে বসেছে। কারণ এসব রোগ নিয়ন্ত্রণের সাথে রয়েছে মশা নিধন ও মশা নিয়ন্ত্রণের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সরকারি উদ্যোগ এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের চরম ব্যর্থতার কারণে ঢাকাসহ সারাদেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ মশাবাহিত ৬টি রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে গেছে। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় কিছু প্রজাতির মশার পরিমান এখন চারগুণ বেশি বলে জানিয়েছেন এ বিষয়ে গবেষনার সাথে জড়িত জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল। এই গবেষকরা বিভিন্ন স্থানে মশার ঘনত্ব পরিমাপ করে দেখেছেন, আগে যেখানে প্রতি ডিপে(মশার ঘনত্ব পরিমাপের একক) ১৫ থেকে ২০ মশা শনাক্ত হয়েছিল, এবার তা বেড়ে গড়ে ৬০টিতে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ মশা বেড়েছে গত বছরের তুলনায় চারগুন। শহরের অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে বস্তি ও প্রান্তিক এলাকাগুলোতে মশা নিধন ও মশার প্রজননক্ষেত্রগুলোতে পরিচ্ছন্নতা জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই।
শীত গত হয়ে এখন বসন্ত চলছে। বসন্ত ও বর্ষায় মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এখন ঢাকা শহরের আবাসিক এলাকায় রাতে তো বটেই দিনের বেলায়ও মশার উৎপাতে টিকে থাকা দায় হয়ে পড়ছে। ডেঙ্কু-চিকুনগুনিয়ার জীবাণুবাহিত এডিস মশাগুলো সাধারণত দিনের বেলায় বেশি কামড়ায়। ঢাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার এই বাস্তবতার মধ্যেই এ সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের সাফল্য দেখছেন এবং তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাদের এই কথিত সাফল্য কিভাবে পরিমাপ করা হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। আমাদের গবেষকদের গবেষণার ফলাফল ছাড়াও ঢাকার নাগরিক হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, শহরে মশার উপদ্রব আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণে গতানুগতিক পদক্ষেপগুলো তেমন কোনো কাজে আসছে বলে মনে হয়না। আর এই ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত না করেই স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি মশক নিধনে সাফল্যের জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়েছে। এরপর কি সিটি কর্পোরেশনদ্বয় মশা নিয়ন্ত্রণে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করবে?
মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনায় জনবল এবং মশার ওষুধ ও ফগার মেশিন ক্রয়ের পেছনে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকারগুলো বছরে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে। তবে শত শত কোটি টাকায় কেনা মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। বার বার ওষুধ ছিটিয়েও মশার উৎপাৎ কমিয়ে আনতে না পারার মধ্যেই সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধন কার্যক্রমের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়। বর্তমান অবস্থায় মশা নিধন তথা মশার প্রজননস্থলগুলোতে নিয়মমাফিক পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে না পারলে মার্চ মাস নাগাদ ঢাকায় মশার উপদ্রব আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। শুধু মশার ওষুধের উপর নির্ভর করে মশক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর জন্য সামগ্রিক নগরব্যবস্থাপনা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও নাগরিক শৃঙ্খলার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। ঢাকার বাতাসে মারাত্মক দূষণ, নদনদী ও পানিদূষণ, শব্দদূষণসহ নানাবিধ নাগরিক বিড়ম্বনা দূর করার বাস্তবসম্মত উদ্যোগ না নিয়ে শুধুমাত্র মশার ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ অথবা পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে সফল হওয়া অসম্ভব। মশা নিধনসহ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শহরের মেয়র ও সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলররা এ বিষয়ে দায়মুক্তি পেতে পারেন না। ঢাকাসহ সারাদেশে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন