শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

ঐকমত্য ছাড়া একুশ-সংস্কৃতির বিকাশ সহজ নয়

প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর : ভাষা আন্দোলন ও অমর একুশে বইমেলার সঙ্গে একুশ-সংস্কৃতি বিকাশের আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে মূল বীজ নিহিত ছিল ভাষা আন্দোলনে। একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার যে লালন প্রক্রিয়া শত শত বছর ধরে চলে আসছিল সেই চেতনা প্রতিষ্ঠাই ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য। ঐতিহাসিকভাবে এ কথাই সত্যি যে, ’৪৭ পূর্ব থেকেই এ প্রবণতা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। বাস্তব হচ্ছে, জাতির অভ্যন্তরে থাকা চেতনার আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ হয়েছিল ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারি। এর মূল বিষয় ছিল একটি মেধা-মননশীল জাতি গঠন। ভাষার বিকাশের অঙ্গীকার নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা একাডেমি। অমর একুশে বইমেলা মূলত সেই চেতনাকেই লালন করছে। এটাই বাস্তব যে মেধা-মননে, চিন্তা-চেতনায় ও রাজনীতি-ভাবনায় উন্নত না হতে পারলে একটি জাতি টিকে থাকতে পারে না। সে বিবেচনায় ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার জন্যই শক্তিশালী জাতির প্রয়োজন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষার জন্য যে আত্মনির্ভরশীলতা প্রয়োজন তা না থাকলে কোনো লড়াই দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এটি সম্ভব কেবলমাত্র জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য লালনের মাধ্যম্যেই। বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে দেখলে বলতে হবে, প্রায় দু’শ বছর যে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি তাদের ভাষা ইংরেজি শিক্ষাকে আমরা এখনো অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছি। বলছি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে এটা শেখা জরুরি। অথচ কয়েকশ বছর যে মুঘলরা শাসন করেছে তাদের রাজ ভাষা ছিল ফার্সি, আমরা তা শেখার কোনো আগ্রহ দেখাই না। কারণ এ ভাষা আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে না। আরবি পবিত্র কোরআনের ভাষা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আরবি পড়তে পারেন বা বোঝেন এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আবার যাদের হয়তো আক্ষরিক জ্ঞানও নেই অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাকরি করছেন তারা অনায়াসে আরবি বলতে ও বুঝতে পারছেন। বিশ্বের যেসব দেশ প্রকৃতই তাদের জাতীয় উন্নয়ন করতে পেরেছে তাদের কাছে বিদেশি ভাষা শেখার গুরুত্ব অনেক কম। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও ফরাসিরা ইংরেজি ভাষার প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ করে না। ইংরেজি ভাষা হওয়ার পরও আমেরিকান ইংরেজি আর ব্রিটিশ ইংরেজি এক নয়। আমরা বাংলায় কথা বলি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তিনি মানুষকে বুলি দিয়েছেন। সে অর্থে প্রতিটি ভাষাই তার দান। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিটি জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও মেধা-মননে। সে অর্থে আমাদের ভাষার যে ঐতিহ্য তার ভিত্তিতেই আমাদের বিকাশ। এই ভাষা যে অন্য অঞ্চলের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে তার সুনির্দিষ্ট কারণও রয়েছে। এটাও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, ধর্মীয় কারণে যেখানে একসময়ে বাংলার বিকাশ হতে পারেনি সেখানে পরবর্তীতে ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতাতেই বাংলার বিকাশ হয়েছে। সবমিলে এটাই হচ্ছে মূল কথা যে, আমাদের বাংলাকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের সংস্কৃতিকেই লালন করতে হবে। এই লালন প্রবণতার একটি বড় বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে অমর একুশের বইমেলা। সে কারণেই দেখার ও ভাবার রয়েছে হৃদয়ের এই মেলা কতটা আমাদের হয়ে উঠতে পেরেছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই বিকালে প্রধানমন্ত্রী প্রথার অংশ হিসেবে বাংলা একাডেমিতে উদ্বোধন করেছেন বাংলা ভাষাভাষীর প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বাংলা ধ্রুপদি ও সাম্প্রতিক সাহিত্যের সুনির্বাচিত সম্ভার বিশ্ব পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে আরও ব্যাপকভিত্তিক অনুবাদের পাশাপাশি গণমানুষের জীবন ও সংগ্রাম সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। মেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলেছে, একাডেমির হীরক জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে এবারের বইমেলা হবে স্মরণকালের বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ। গত দুবারের চেয়ে এবার মেলার পরিসর প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির হীরক জয়ন্তী উদযাপন করতে এবার মেলার মূল থিম নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘বাংলা একাডেমির হীরক জয়ন্তী’। এ উপলক্ষে একাডেমির ইতিহাস এবং বিভিন্ন গবেষণামূলক কর্মকাল, অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ঐতিহাসিক ছয় দফার সুবর্ণ জয়ন্তী, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির সমকালীন প্রসঙ্গ এবং বিশিষ্ট বাঙালি মনীষার জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। মেলা উপলক্ষে ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসব। এতে বাংলা ও বিশ্ব কবিতা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি স্লোভাকিয়া, মরক্কো, সুইডেন, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের কবিরা কবিতা পড়বেন। বলার অপেক্ষা রাখে না ছয় দফা আমাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন তথা বাক ব্যক্তি সংবাদপত্র এবং সামগ্রিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে ছয় দফার ভূমিকা, গুরুত্ব এবং এর আলোচনার প্রয়োজনীয়তা সমসাময়িক প্রেক্ষাপটেও অনস্বীকার্য। ছয় দফার মূলে রয়েছে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রসঙ্গ। এটাই সত্যি যে, ’৪৭ সাল-পরবর্তী কয়েক বছরে পাকিস্তানের সংখ্যালঘিষ্ঠ অঞ্চলে তিন-তিনবার রাজধানীর পরিবর্তন করা হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার জন্য একবারও করা যায়নি। এ কথা হয়তো উঠত না যদি না অন্য প্রসঙ্গ না থাকত। সে ভিন্ন আলোচনা। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে ছয় দফার সুবাদেই হোক আর অন্য যে কোনো কারণেই হোক জনমনে অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং অধিকারহীনতার বাস্তবতা গেথে গিয়েছিল। সেটাই কাল হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকদের। যেহেতু আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বিষয়টি শত শত বছরে পুরনো, সে কারণে কোনো না কোনোভাবে ছয় দফা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার প্রতিফলন হয়েছিল ’৭০-এর নির্বাচনে। বিশ্লেষণ করলে এটাও বলা বোধহয় বেশি হবে না যে, ভাষা আন্দোলনে যেভাবে দলমত নির্বিশেষে একটা বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল ঠিক তেমনটি ঘটেছিল ছয় দফার ক্ষেত্রেও। সত্যি হচ্ছে যে, জনমনে একটা আস্থার জন্ম হয়েছিল, এর মাধ্যমে তাদের মুক্তি সম্ভব। এই আস্থা ও বিশ্বাসের প্রসঙ্গই বোধহয় বর্তমান সময়েও বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। ডান-বাম-মধ্য সবাই ভাষার সংগ্রামে শরিক হয়েছিলেন। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা যাক না কেন সত্যি এটাই যে, ভাষার দাবি সাধারণের মধ্যে আস্থার সঞ্চার করতে পেরেছিল বলেই আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক পরিচয়ে সাধারণের কোনো আগ্রহ ছিল না। এখনো ভাষাসৈনিক হিসেবে যারা জীবিত রয়েছেন তাদের দেখলে বা তাদের কথা শুনলেও মনে হয় নানাজনের নানা চিন্তা হয়তো ছিল। বাস্তবে জনগণ ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবির বাইরে অন্য কোনো দাবি নিয়ে ভাবেনি। এই আস্থার ভিত্তি আলাদা। মায়ের ভাষা তথা মাতৃভূমির প্রতি যে দরদ তার মূলে রয়েছে দেশপ্রেমের শিক্ষা এবং তা ধর্ম থেকেই পেয়েছে সাধারণ জনগণ। এই চেতনাই কার্যকর ছিল ছয় দফায়। আজকের প্রেক্ষাপটে যেমনি সেই চেতনার প্রায়োগিক দিক নিয়ে ভাবার রয়েছে তেমনি ভাবার রয়েছে একুশের চেতনার গভীরতা নিয়ে।
যে ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষরা প্রাণ দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, যাদের কথা আমরা গভীর শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসায় উচ্চারণ করি তারা মূলত এই চেতনা পেয়েছিলেন তাদের পূর্বসূরিদের থেকে। এ ভাষার টিকে থাকাটা খুব সহজ ছিল না। আদৌ টিকে থাকবে কিনা সে সংশয় যে একেবারে ছিল না সে কথাও জোর দিয়ে বলা যাবে না। ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ পাওয়া গিয়েছিল নেপালের রাজদরবারে। আজকের দিনে ভাষার সম্মানে সবার একটু ভেবে দেখা দরকার, পরিস্থিতি কতটা গুরুতর হলে বাংলা ছেড়ে আমাদের ভাষার পূর্ব পুরুষরা নেপালে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ষষ্ঠ শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এ অঞ্চলের সাধারণ জনগণকে ব্রাহ্মণ্যবাদের কারণে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। এর মাশুল বাংলা ভাষাকেও গুনতে হয়েছে। এ অঞ্চলের সাধারণ বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের দ্বারা নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হওয়ার কারণ ছিল তাদের ধর্ম বিশ্বাস। আর তারই বিরূপ প্রভাব পড়েছে বাংলা ভাষার ওপর। এ সময়টা ছিল কার্যত এক অন্ধকার যুগ। সেই প্রতিবাদের কথাই নীরবে উঠে এসেছে বাংলা সাহিত্যের প্রচীন নিদর্শন চর্যাপদে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়ে। ধর্মীয় পরিচয়ের সংকটে ভোগা নির্যাতিত বৌদ্ধরা দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে অশ্রয় নেয়ার ফলে একদিকে যেমনি শাসন ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে তেমনি নিরাপদ হয় বাংলা ভাষা। এরপর বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এই বিকাশকে আধুনিককালেও গ্রহণ করেনি পশ্চিমবাংলার কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলাভাষীরা। মুসলমান শাসনামলে মধ্যযুগে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ অর্জিত হয়েছে সে কথা তারা মানতে রাজি নয়। বরং যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছে মুসলিম যুগে তাই রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এ যুগকে তারা বলছেন অন্ধকার যুগ। শুধু তাই নয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ী বজ্রকণ্ঠ সম্পর্কেও কলকাতার বাবুদের ধারণা ছিল নেতিবাচক। এখানেই ভাষার সংস্কৃতি বড় হয়ে দেখা দেয়। সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা করবেন যাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখার ও অংশগ্রহণ করার সুযোগ লাভ করতে পারেন।” সংস্কৃতিই একই প্রবাহকে পানি ও জলের বিভাজন মুছতে দেয়নি। সংস্কৃতি কোনো আরোপিত বিষয় নয়। আরোপিত হলে তা টিকে না। এখানেই বাংলা একাডেমির অমর বইমেলার গুরুত্ব। এবারও বইমেলা নিয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন বইমেলা মানে মুদ্রিত বইয়ের মেলা। কথা ছোট তবে গভীরতা অনেক। সংস্কৃতি লালনের সঙ্গে যে অর্থনীতির সম্পর্ক অনেক নিবিড় সে কথাই মনে করিয়ে দেয় একুশের বইমেলা। এটি প্রকাশকদের সবচেয়ে বড় বাজার। যুগ যুগ ধরে মেলা চলছে। প্রকৃত বিবেচনায় কি আমরা দেশোপযোগী মেধা-মনন সৃষ্টিকারীদের লালন করতে পেরেছি? দেখা যায়, পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে প্রথমে হিন্দিতে অনূদিত হয়ে পশ্চিমবাংলায় প্রকাশিত হওয়ার পর নাম-ঠিকানা-পরিচয় পরিবর্তন করে তা নাকি আবার আমাদের দেশে বাংলায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এর ফলে এর মধ্যে কতটা জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ হচ্ছে তা বোধকরি নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। সে বিবেচনায় সংস্কৃতির যে আলোচনা রয়েছে তাকে এড়িয়ে গিয়ে একুশের সংস্কৃতির কোনো রূপ পাওয়া সম্ভব নয়। এই সংস্কৃতির আলোচনাই করেছিলেন সাংবাদিক খন্দকার আবদুল হামিদ। বাংলা একাডেমির বইমেলাতেই তিনি তুলে ধরেছিলেন জাতিসত্তার পরিচয়। এই পরিচয়ের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া তার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে। প্রেসিডেন্ট জিয়া যে সংস্কৃতির স্বস্বীকৃতি দিয়েছেন বর্তমান সময়ে অনেকেই তা নিয়ে অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। দেখা যাচ্ছে জাতীয় সংস্কৃতির বিপরীতে যেন বিতর্ক সৃষ্টির প্রবণতাও কোনো কোনো মহলে সক্রিয় থাকছে। ফলে যে বাস্ততার উদ্ভব হয় তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকেই।
মেলা চলাকালীন লেখক-প্রকাশকদের মেলার আশপাশের এলাকায় সাবধানে চলাচলের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খান। তিনি বলেছেন, গত দুই বছর বইমেলার অদূরে ও পরবর্তী সময়ে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন লেখক ও একজন প্রকাশক নিহত হয়েছেন। আমরা চাই না এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। আমরা এবারের বইমেলায় নিরাপত্তার দিকটি বিশেষভাবে নজর রাখছি। তিনি মনে করেন, আমরা গত বছরের জুন মাস থেকে এসব বিষয় নিয়ে নিরাপত্তা সংস্থাসমূহ, মন্ত্রণালয়, আন্তঃমন্ত্রণালয়, ফায়ার ব্রিগেট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছি। তিনি মনে করছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিñিদ্র হবে। ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও বলেছেন, বইমেলাকে কেন্দ্র করে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ। সারা দেশের মানুষ যখন নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে তখন মেলার নিরাপত্তা প্রসংশনীয়। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, যারা মেলায় অংশ নেন তারাই এক ধরনের প্রহরী। ভাষার সঙ্গে যে একাত্মতা রয়েছে সেটাই সবাইকে মেলার নিরাপত্তার কথা মনে করিয়ে দেয়। এটাও এক ধরনের ঐকমত্য। বর্তমান সময়ে ভাবার রয়েছে কেন, কী কারণে মেলার সেই পুরনো ঐতিহ্য ভেঙে আলাদা পাহারা বসাতে হয়েছে। এবার মেলার ঐতিহ্যবাহী রীতি ভেঙে আগেভাগেই চলে যেতে বলা হয়েছে। এটাও মেলা সংস্কৃতির সঙ্গে বিরোধাত্মক। কারণ মেলা মানেই মুক্ত মনে আনন্দ করা। লেখা হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার অংশ। মত প্রকাশ একুশের চেতনার মূল প্রতিপাদ্য। আমাদের মনের গভীরে জাতীয় সংস্কৃতির যে অংকিত বৃহত্তর ম্যাপ রয়েছে সেটা সবাই অনুসরণ করলে যে কোনো বিতর্ক যেমনি এড়ানো সম্ভব হতো তেমনি জাতিগত উন্নয়নও বোধহয় ত্বরান্বিত হতো। এর বিপরীতে কেউ কেউ যা করছি বা করার জন্য আগ বাড়িয়ে রয়েছি তার ফলে অগ্রগতিই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং বইমেলার মূল যে চেতনা তা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। এই অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত বাস্তবতার সূত্র উৎস খুঁজে বের করে তার প্রতিবিধান করার মধ্যে রয়েছে একুশের বইমেলার সার্থকতা।
নগর সভ্যতায় একুশের বইমেলা এক ভিন্ন আমেজ। সত্যি বলতে কি, মেলার কটা দিন ওই এলাকায় তৈরি হয় এক ভিন্ন বাস্তবতা। পড়ন্ত বিকালে, ছুটির দিনে, অফিসের ঝামেলা বা নিত্যদিনের ঝুট-ঝামেলা ঝেড়ে ফেলে বিকালটা মেলায় কাটানোর আনন্দই আলাদা। মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্কসহ গোটা এলাকায় বিরাজ করে এক ভিন্ন চিত্র। কার্যত এলাকা পরিণত হয় হর্নবিহীন এলাকায়। কাঁধে ব্যাগ, মুখে নানা আলোচনাÑ সবমিলে মেলা ঘিরে যারা থাকেন তাদের দেখলে মনে হয় না এই যন্ত্রণাক্লিষ্ট নগরীর নাগরিক তারা। একুশের বইমেলার মূল চেতনা গণতান্ত্রিক বোধ-বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা, অপরের মতকে শ্রদ্ধা জানাতে পারার মতো মানসিকতা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, যখন অমর একুশের বইমেলা হচ্ছে তখন সমাজে গণতান্ত্রিক বাস্তবতা নেই। বৈষম্য নীতির গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়ে সমাজ আজ দ্বিধাবিভক্ত। অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের সূত্র ধরে সমাজের অধিকাংশ মানুষই অধিকারহারা। এটা কোনো বিবেচনাতেই একুশের চেতনার সঙ্গে মেলে না। মত প্রকাশের অধিকার ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার যদি সমাজে না থাকে তাহলে মেলার আনন্দ উপভোগের সুযোগ কোথায়? যে মেধা-মনন বিকাশের দাবি নিয়ে প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলা হয়ে আসছে তার প্রকৃত সফলতা পেতে হলে মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া অত্যন্ত জরুরি। সে বিবেচনায় রাজনৈতিক বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে উঠতে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গ্রহণযোগ্য সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন আয়োজনের কোনো বিকল্প নেই। মানুষের অধিকারের প্রতি স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়েই একুশের চেতনার প্রতি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব।
awalthakur@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন