আবদুল আউয়াল ঠাকুর
পবিত্র ঈদুল আজহা দ্বারপ্রান্তে। এটি আমাদের জাতীয় উৎসবের অন্যতম। বছরে দুটি ঈদের মধ্যে এই ঈদের তাৎপর্য খানিকটা ব্যতিক্রমী। সেই সাথে এ বছর যখন পবিত্র ঈদুল আজহা পালিত হতে যাচ্ছে তখন দেশের পরিস্থিতিতেও ভিন্নতা রয়েছে। প্রধানত এই ঈদকে কেন্দ্র করে পোশাক-আশাক কেনাকাটার বাইরেও কোরবানির পশু নিয়ে অন্য রকম ব্যস্ততা থাকে। এ বছর এ আলোচনার বাইরেও সারাদেশে জঙ্গি আলাচনা বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। যদিও এ কথা নতুন করে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই যে, প্রকৃত বিবেচনায় অসরীয় শক্তি তথা একাত্মবাদবিরোধী শক্তি দমনের অঙ্গীকার নিয়েই প্রতিবছর পালিত হয় ঈদুল আজহা। আনুষ্ঠানিকতাতে পশু জবাই থাকলেও ভেতরের চেতনা হচ্ছে, মনের পশুকে কোরবানি দেয়া। এবার এই ঈদকে সামনে রেখে একদিকে যেমনি মনের পশুর আলোচনা স্থান করে নিয়েছে তেমনি উঠে এসেছে কোরবানির পশুর আলোচনাও। এ কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই যে, মানব সমাজের প্রাথমিক স্তর থেকেই কোরবানির প্রচলন ছিল। সে সময়ের কোরবানি আর এখনকার কোরবানির বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। একসময়ে কোরবানি কবুল হলো কিনা তা প্রত্যক্ষ করা যেত। এখন সেভাবে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় না। তবে কোরবানিদাতার কোরবানি কবুল হয়েছে কিনা তা বোঝার উপায় রয়েছে। আধুনিককালে যে কোরবানির নিয়ম ও পদ্ধতি চালু রয়েছে সেটি মূলত হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সময় থেকে প্রবর্তিত। এর মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার বিধানের প্রতি মানুষ অনুগত কিনা সেটি প্রমাণ করাই প্রধান উদ্দেশ্য। কোরবানির পুরো ধারণার সাথেই মনুষ্যত্ব বিকাশের সম্পর্ক রয়েছে। এই ত্যাগের অন্য কোনো উদাহরণ পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে এই মাসে অনুষ্ঠিত হয় পবিত্র হজ। এটিও সেই আদিকাল থেকে প্রচলিত। আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে পবিত্র গৃহের তাওয়াফের কথা ঘোষণা করতে বলেন। তিনি তাই করেন। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর এই ঘোষণা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। আর এই পবিত্র গৃহ তাওয়াফের মাধ্যমে কেবল গুনাহ মাপেরই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সে বিবেচনায় এই মাস এবং বিশেষ করে মাসের প্রথম দশ দিনের তাৎপর্য মুসলিম সমাজে অত্যন্ত বেশি।
যারা কোরবানি করবেন তাদের প্রধান বিবেচ্য, সামর্থ্যরে মধ্যে সুন্দর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী পশু পাওয়া। এ নিয়ে একসময়ে কোনো ভাবনাই ছিল না। এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, এটিই যেন প্রধান ভাবনায় পরিণত হয়েছে। এর কারণ নানাবিধ। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের চামড়া বাজারের প্রধান জোগান আসে এই ঈদ থেকেই। বাস্তবতা হচ্ছে, কোরবানির পশু নিয়ে একসময়কার বাস্তবতায় পরিবর্তন ঘটেছে যেসব কারণে, তা যেমনি খতিয়ে দেখা দরকার তেমনি তদস্থলে যেসব বিষয় স্থান করে নিয়েছে তার সাথে কোরবানির চেতনাকে মিলিয়ে দেখা দরকার। বোধকরি লিখে বা বলে বুঝাবার দরকার নেই যে, অনন্তকাল থেকেই দেশি গবাদিপশুতেই কোরবানির চাহিদা পূরণ হয়েছে। দেশের এসব পশুর চামড়াকেও উন্নতমানের বলা হতো। এটা অনেকেরই জানা, কোরবানির পশু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গ্রামের কৃষকরা প্রতিপালন করতেন। তারাই বাছাই করে রাখতেন এর মান। এখন সে চিত্রে পরিবর্তন হয়েছে। কারণ, দেশে পশু পালনের কোনো বিচরণ ভূমি নেই বললেই চলে। এর কারণ প্রধানত কৃষিতে আধুনিকায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। এখন পশুর প্রাকৃতিক খাদ্য ঘাসের মারাত্মক অভাব দেখা দিয়েছে। বিচরণ ক্ষেত্রের চেয়েও বড় সংকট হচ্ছে, ধানের কুটা ও কুড়ার অভাব। সেই সাথে প্রতিপালনের জন্য স্থান ও নিরাপত্তার অভাব। এসব কারণে গ্রামেগঞ্জে এখন আর আগের মতো বলতে গেলে সেই প্রাকৃতিক উপায়ে গরু পালন করা হচ্ছে না। এই জায়গা দখল করে নিয়েছে কৃত্রিমভাবে লালন-পালন। এখানে এটাও বলে রাখা প্রয়োজন, শুধু যে পশু প্রতিপালনে সংকট তা তো নয়, দেশে মাছ-সবজি এমনকি প্রধান খাদ্য ধানের বেলাতেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ সবকিছুর জন্যই মূলত অর্থনৈতিক বাস্তবতা দায়ী। কোরবানীর আলোচনায় গত বছর থেকে নতুন প্রসঙ্গ স্থান করে নিয়েছে। দেশে গরু উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার প্রেক্ষিতে হয়তো কোন মহল এটা ধরে নিয়েছিল, বৈধ আমদানির সাথে রাতের অন্ধকারে ভারতীয় চোরাই গরু প্রবেশ করিয়ে কোরবানির বাজার ঠিক রাখায় কোনো অসুবিধা নেই। এর দুনিয়াবি দিকটি বাদ দিলে এটা সত্যই ভাববার রয়েছে, কোরবানির মতো এত বড় ত্যাগের উপকরণ কি সরকারিভাবে চোরাই পশুনির্ভর হতে দেয়া সঙ্গত? অনেক দিন থেকেই এ আলোচনা ছিল। বাস্তবত যাই বলা হোক না কেন, চোরাই গরুর প্রসঙ্গ ছিল ওপেনসিক্রেট। সে কারণেই এর কোনো সুরাহা হওয়ার উপায় ছিল না। গত বছর বিষয়টি অন্যভাবে চলে আসে আমাদের দেশে। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের শুরুতে হঠাৎ করে বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত। এমনকি গরু চোরাচালান রোধে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। সীমান্তের কাঁটাতারে বেড়া ও গরু আসার কড়িডোরগুলোতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কঠোর নজরদারি করতে থাকে। ফলে ভারত থেকে গরু আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবছর ভারত থেকে যেখানে ২০-২৫ লাখ গরু আসত, কমে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় দাঁড়ায়। সেই প্রেক্ষিতে নতুন ইতিবাচক ভাবনা ও বিবেচনা স্থান করে নেয়। ভারতীয় এই একরোখামির অত্যন্ত সহজ ও সাবলীলভাবে মোকাবিলা করেছে এদেশের খামারি ও কৃষকরা। দেখা গেছে কোরবানির পশুর কোনো সমস্যা হয়নি। উপরন্তু ভারতের যেসব খামারি বাংলাদেশে গরু রফতানি অথবা চোরাচালানি করবে বলে সীমান্তের কাছে জড়ো করেছিল তারা সে গরুগুলো ফিরিয়ে না নিয়ে সেখানেই মেরে ফেলে। সেই বাস্তবতায় এবার দেশে গত এক বছরে গবাদিপশুর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার। খামারি, চামড়া ও গোশত ব্যবসায়ী সমিতি এবং প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সূত্র উদ্ধৃত করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গবাদিপশু পালন বৃদ্ধি পাওয়ায় আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানিযোগ্য গরু রয়েছে ৪৪ লাখ ২০ হাজার। ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৭০ লাখ ৫০ হাজার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর কোরবানিতে জবাই হয় ৫০ থেকে ৫৫ লাখ গরু। বলা হয়েছে, এ বছর এ ছাড়াও মিয়ানমার থেকেও গরু আসছে। চামড়া ব্যবসায়ী সমিতি ও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর কোরবানিতে ব্যবহৃত পশুর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সরবরাহ করত দেশি খামারিরা। গত বছর ভারত থেকে গরু আসা প্রায় বন্ধ হওয়ার কারণে এ বছর গবাদিপশুতে স্বয়ংম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা-প্রক্রিয়া নেয়ার কারণে গবাদিপশুর লালন-পালনের পরিমাণ বেড়েছে। ফলে বেড়েছে গবাদিপশুর সংখ্যা। সে বিবেচনায় ভারতীয় গরু আসার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে উদ্বেগের জায়গা অন্যত্র। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে নিষিদ্ধ স্টেরয়েড জাতীয় রাসায়নিক ও বিভিন্ন ইনজেকশন ব্যবহার করছে একশ্রেণির অসাধু ডেইরি ফার্মের মালিক ও গরু খামারিরা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এসব স্টেরয়েড ও হরমোনসমৃদ্ধ মাংস খেলে মানুষের কিডনি-লিভার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ক্যান্সারও হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিক রোগীদের মৃত্যুও হতে পারে। এদিকে জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় কোরবানির গরু মোটাতাজাকরণে বিভিন্ন ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহারের পদ্ধতি বন্ধে কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন।
কোরবানির পশু প্রপ্তির এই ইতিবাচক খবরের পেছনের খবর হচ্ছে, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, আগে দেশে সাধারণত প্রতিবছর গবাদিপশুর সংখ্যা দুই থেকে তিন লাখ করে বাড়ত। গত বছর বেড়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার। এর মধ্যে গরু প্রায় দেড় লাখ। আগের বছর গবাদিপশু বেড়েছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে গরু ছিল ৮০ হাজার। এ বছর গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকার একটি পূর্ণচক্রায়ন তহবিল তৈরি করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে খামারিদের ৫ শতাংশ সুদে মোট ৬৫ কোটি টাকার গবাদিপশু ঋণ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, কম সুদে ঋণ গবাদিপশু লালন-পালনের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এর আগে কোরবানির পশু প্রসঙ্গে চোরাকারবারির যে আলোচনা করা হয়েছে, বোধকরি কোরবানির চেতনার বিবেচনায় আলোচ্য সুদের বিষয়টিকেও সহজভাবে নেয়ার কোনো সুযাগ নেই। নিয়মানুযায়ী যিনি বা যারা কোরবানি দেবেন তাদের ক্ষেত্রে চোরাই গরু, সুদের টাকায় প্রতিপালিত বা বিনা সুদের টাকায় প্রতিপালিত গরুতে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ তিনি বাজার থেকে টাকা দিয়ে কিনে কোরবানি দিচ্ছেন। তার জন্য প্রয়োজনীয় হচ্ছে তার টাকা হালাল কিনা। সে যাই হোক, বর্তমান সময়ে কোরবানি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। অনেকে এটাকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করছেন। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক কোরবানির কথাও সমাজে প্রচলিত রয়েছে। ভোটরক্ষায় ও দলীয় নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখার নিমিত্তেও কোরবানির আয়োজন করা হচ্ছে। সেসব প্রসঙ্গ ভিন্ন। যে কথা বলছিলাম তা হচ্ছে, সুদের টাকায় কোরবানির পশু প্রতিপালনের বিষয়টি। এখানে ব্যাংকের যে প্রসঙ্গ রয়েছে তারও নানামাত্রিক আলোচনা রয়েছে। সাধারণভাবে ব্যাংকগুলো যাই বলুক, প্রকৃত বিবেচনায় দেশে প্রচ- বিনিয়োগ সংকট রয়েছে। এমতাবস্থায় কোরবানির পশু প্রতিপালনের বিনিয়োগকে ইতিবাচকভাবে দেখাই স্বাভাবিক। সুদে-আসলে এ টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরো একটি আলোচনা এখানে রয়েছে। প্রকাশ্যত না বললেও দেশের সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ক্রমাগত ঋণ নেয়ার কারণে সেগুলো অনেক আগেই সংকটে পতিত হয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক থেকে নানা উসিলায় টাকা সংগ্রহের যে অপ্রদর্শিত নিয়ম রয়েছে সেক্ষেত্রে তারা আয় তথা লাভ করতে না পারলে দেবে কোত্থেকে? ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে এ ধরনের ঋণের কোনো বিকল্প নেই। সে বিবেচনায় কোরবানির পশুর জন্য ঋণকে অবশ্যই ব্যাংকগুলোর ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। এখানে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে সুদ। এখন ভাবা দরকার সুদবিহীন কোনো পদ্ধতি পাওয়া যায় কিনা। হতে পারে গবাদিপশু বিশেষ করে কোরবানির পশু প্রতিপালনে সরকারের ভর্তুকি দেয়া। আগে যেভাবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গবাদিপশু প্রতিপালিত হতো সেটিকে নার্সিং করা যায় কিনা সেটিও ভেবে দেখা। যেহেতু বিষয়টি কৃষির সাথে সম্পর্কিত তাই করণীয় কিছু রয়েছে কিনা সেটা দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা ভেবে দেখতে পারেন। এ কথা বলার মূল কারণ হচ্ছে, সুদকে বলা হয় শোষণের হাতিয়ার। সুদ ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন যে, জেনেশুনে নিষিদ্ধ টাকায় প্রতিপালিত পণ্যকে ধর্মের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত করা হচ্ছে। এর ফলে কোরবানির প্রকৃত সুফল কতটা পাওয়া যাবে বা পাওয়া সম্ভব এ প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সময়ের সাথে তালমিলিয়ে এর কতটা কী করা যায় তা নিয়ে সকলেরই ইতিবাচক ভাবনা জরুরি।
বোধকরি এখনকার উদ্বেগের দ্বিতীয় গুরুতর বিষয় হচ্ছে, কোরবানির যে পশুগুলো বাজারে আসার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সেগুলোর মান। কারণ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অনেক খামারি মারাত্মক জীবাণু দিয়ে এসব পশু মোটাতাজা করে তুলছে। এগুলো মানবদেহে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এই বাস্তবতায় দুটি বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হতে হবে। প্রথমত. কোরবানি দেয়া হয় আল্লাহর নির্দেশ পালনে। এই গোশতের একটি নির্দিষ্ট অংশের হকদার সাধারণ দরিদ্র মানুষ, যাদের কোরবানী দেয়ার সমর্থ নেই। এখন যদি এসব মাংসের মধ্যে মারাত্মক জীবাণু থাকে তাহলে সেটি তাদের স্বাস্থ্যের জন্য হিতের চেয়ে বিপরীত ভূমিকাই সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে সাধারণত যারা রেড মিট পরিহার করে চলেন তারাও এ সময়ে কোরবানির পশুর গোশত খান। এসব ক্ষতিকারক ওষুধ তাদের শরীরে প্রবেশ করলে সেটিও নতুন সংকটের আশঙ্কাকেই তীব্রতর করে তুলবে বা তুলতে পারে। তারচেয়েও বড় কথা, কোরবানি দেয়া হয় যেহেতু আল্লাহর নিয়তে সে কারণে এই পশুতে ক্ষতিকর ওষুধের প্রয়োগ শুধু অনৈতিকই নয় এক ধরনের গুরুতর অপরাধও। যেসব খামারি অসৎ উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রবণতায় লিপ্ত তাদের এখনই শনাক্ত করা জরুরি। সেই সাথে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাও অত্যন্ত অপরিহার্য। যারা কোরবানির হাট ইজারা নেবেন তাদেরও এ ব্যাপারে পূর্ব থেকেই সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করে দেয়া প্রয়োজন, যাতে এ ধরনের গবাদিপশু হাটে প্রবেশ করতে না পারে। বিশেষ করে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তৎপরতাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনীয় জনবলের স্বল্পতার কথা বলে সংশ্লিষ্টরা প্রতিবছর এক ধরনের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। প্রতিটি মার্কেটে যাতে গবাদিপশু প্রবেশের আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা যায় তার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। ঈদুল আজহায় সামর্থ্যবানদের জন্য পশু কোরবানি অপরিহার্য। এ নিয়ে তামাশা বা ছলচাতুরি করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশে অনেক দিন থেকেই পশু মোটাতাজাকরণের বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। শুধু কোরবানির পশু নয়, সাধারণভাবেও বাজারে যেসব পশু পাওয়া যায় সেগুলোর অবস্থাও এর চেয়ে ভালো কিছু নয়। সে প্রেক্ষিতে বলা যায়, বিষয়টি সারাবছর নজরদারিতে থাকলে বা রাখা গেলে হয়তো কোরবানিতে অতিরিক্ত কিছু না করলেও হতো। বিষয়টি খামারি পর্যায়ে নিশ্চিত করা গেলে কাজটা অনেক সহজ হতে পারত। কোরবানির পশুর জন্য যে ধরনের সার্টিফিকেটের দরকার হয় তার সাথে ক্ষতিকর ওষুধের বিষয়টি যুক্ত করা গেলে যারা কোরবানি দিয়ে থাকেন তাদের একটু হলেও এহসান হতো।
কোরবানির মূল চেতনা হচ্ছে, ভেতরের পশুকে নিয়ন্ত্রণ করা। আনুষ্ঠানিকতা কেবল নিয়ম পালন। ভেতরগত চেতনায় সমর্পিত না হতে পারলে কোরবানির আনুষ্ঠানিকতা থেকে গোটা জাতির যে উপকার অর্থাৎ আল্লাহর রহমতপ্রাপ্তির আশা খুবই কম। এ বছর ঈদুল আজহার পূর্ব থেকেই সারাদেশে অপশক্তি প্রতিরোধের যে প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে তার সাথে কোরবানিকে মেলালে বলতে হবে, প্রকৃত বিবেচনায় সঠিক নিয়তে, সঠিক উদ্দেশ্যে কোরবানি করা গেলেই সমাজকে অপশক্তিমুক্ত করা সম্ভব। ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা পালনে যারা কোরবানি করবেন, তাদের কোরবানি যাতে কবুল হয় সেজন্য সার্বিক প্রস্তুতি প্রয়োজন। বিদ্যমান প্রেক্ষিতে অবশ্যই যে কোনো মূল্যে ভারতীয় গরুর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেশের টাকা দেশে রাখতে হবে। ব্যাপারটি শুধু কোরবানির গরুতেই সীমাবদ্ধ বোধকরি তেমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই বরং ভারতীয় পণ্য বর্জন করতে পারার মানসিকতা রাখাই উত্তম। কোরবানির পশু যাতে কৃত্রিমতা ও সুদমুক্ত থাকে, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না হয় সেটি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট মহলের যথেষ্ট আন্তরিক ও তৎপর হতে হবে। কোরবানির আগেই আঞ্চলিক রাজনীতিতে যে নতুন পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে হয়তো তার বিকাশ হবে ঈদ পরবর্তীতে। এ কথা সকলেরই মনে রাখা দরকার, ইসলাম কেবলমাত্র কোনো আনুষ্ঠানিকতার নাম নয় বরং পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। সে কারণে আলাদা আলাদা কিছু ভাবার নেই। মহান কোরবানির চেতনায় দৃঢ় থাকা বা থাকার চেষ্টা করাই কোরবানির প্রকৃত শিক্ষা। সেই শিক্ষায় সকলে উদ্বুদ্ধ হোক, এটাই কাম্য।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন