আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সংবিধানভিত্তিক। কোথাও কোথাও রাজতন্ত্র আছে বটে, তবে সব রাজতন্ত্রই শুধু রাজা বা রাণীর নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। রাজতন্ত্রেও অবাধ গণতন্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক দেশেও গণতন্ত্র নেই। ব্রিটেন কাগজে কলমে একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, কিন্তু বাস্তবে রয়েছে অবাধ গণতন্ত্র। সেখানে লিখিত কোনো সংবিধান নেই, সে রাষ্ট্রের কনভেনশন অনেক বড় শক্তিশালী সংবিধান, যা মেনে চলতে রাণী নিজেও বাধ্য। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রাজপরিবার ব্রিটেনের সিংহাসন দখল করে আসছে প্রায় ৮০০ বছর ধরে এবং অলিখিত সংবিধান দিয়েই গোটা পৃথিবীকে ব্রিটিশরা শাসন করেছে। প্রবাদ ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ ও ভারতসহ অনেক রাষ্ট্রই লিখিত সংবিধান দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশের সংবিধান রক্তের অক্ষরে লিখিত। গানে গানে বলা হয়, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের জন্ম। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ভিন্নমতধারীদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে কতটুকু ছাড় দিয়েছে? সংবিধান হলো রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে একটি লিখিত চুক্তিনামা। যে চুক্তিনামা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে রাষ্ট্র বাধ্য। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতায় বসেই সংবিধানে জনগণের জন্য যে অধিকার দেয়া হয়েছে, সেগুলো যাতে জনগণ প্রয়োগ করতে না পারে, এ জন্য নানাবিধ আইন করছে। সরকারের প্রধান দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, কিন্তু সরকার এখন নিজেদের রক্ষার জন্য কঠিন কঠিন আইন প্রণয়ন করছে, যা কঠিনভাবে প্রয়োগ হচ্ছে শুধু ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর।
মৌলিক অধিকার মানুষের জন্মগত। সাংবিধানিক অধিকার একজন নাগরিকের প্রাপ্য। সে অধিকার প্রয়োগে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষ এখন বঞ্চিত। বাংলাদেশে আইন প্রয়োগ হচ্ছে এখন দুই ভাগে। যারা সরকারি দলের তারা আইন ভঙ্গ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা উদাসীন থাকে। অথচ কোনো বৈধ দাবি বা অধিকার আদায়ের জন্য বিরোধী মতাবলম্বীরা যখন রাজপথে নামে তখন বিনা উসকানিতে শুরু হয় তাদের ওপর স্টিমরোলার। তখন সাংবিধানিক অধিকারগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। জাতিসংঘ শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করে, কার্যত কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে না। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার কেবল মুসলমান হওয়ায় রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। সেই সু চি এখন নিজেই সে রাষ্ট্রের সামরিক জান্তার নির্যাতনের শিকার। মোটকথা, পৃথিবীতে খুব কম জায়গায়ই সাধারণ নাগরিকরা তাদের মৌলিক অধিকার, জন্মগত অধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে পারছে।
পৃথিবীতে বেশির ভাগ রাষ্ট্রেই ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে শত-হাজারো অভিযোগ থাকলেও তাদের ক্ষমতা থেকে সরানো যায় না। কারণ, সরকার পরিবর্তনের সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। যেমন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য সংবিধানে যা কিছুই লিপিবদ্ধ থাকুক না কেন, সেখানে সংবিধান অকার্যকর করে রাখছে তারা, যারা সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য শপথ নিয়েছেন।
রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা আছে নাগরিকদের কাছে। নাগরিকদের মতামতের প্রতিফলনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, এটিই সংবিধানের মূলনীতি। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে যে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতায় প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ এতে আরো বলা হয়েছে যে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোনো আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে জোরদারের নিশ্চয়তা দিলেও জনগণ সে অধিকার বাস্তবে ভোগ করতে পারে না। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা স্বয়ং সরকার কর্তৃক ভূলুণ্ঠিত। জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য সরকার ন্যূনতম ভূমিকা গ্রহণ করে না; বরং শপথ নিয়ে শপথের অমর্যাদা করছে।
জনগণের দায়বদ্ধতা যেমন রাষ্ট্রের প্রতি রয়েছে, রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েছে জনগণের কাছে। জনগণ বলতে শুধু সরকারি দলকে বোঝায় না। জনগণ বলতে দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু ক্ষমতাসীন দলের সেবায় নিযুক্ত।
উন্নয়নের প্রশ্নে বাংলাদেশে পিছিয়ে আছে তা বলা যাবে না। কারণ, সরকারেরই দায়িত্ব হলো জনগণের চাহিদা মোতাবেক উন্নয়ন। শেরশাহের আমলেও উন্নয়ন হয়েছে। দাবি করা হয় যে, সোনারগাঁও থেকে লাহোর পর্যন্ত গ্রান্ডট্রাংক রোড, ডাক চালু করা প্রভৃতি শেরশাহের আমলে হয়েছে। ওই আমলে বিজ্ঞানের উন্নয়ন তথ্যপ্রযুক্তি যা ছিল তা দিয়েই উন্নয়ন হয়েছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হলো, সব নাগরিককে নিজ নিজ অধিকার নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে বর্তমানে নাগরিকদের মূল অধিকার বাস্তবায়িত হওয়া তো দূরের কথা, সংবিধান মোতাবেক ক্ষেত্র বিশেষে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার নাগরিকরা ভোগ করতে পারছে না। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধূলিসাৎ করা হয়েছে। অথচ, রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা যে প্রচার প্রোপাগান্ডা করা হচ্ছে তাতে স্পষ্টই মিথ্যাকে সত্যে এবং সত্যকে মিথ্যায় প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণকে ধোঁকা দিচ্ছে। সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’
যারা রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করেন, তারা কি সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন? সংবিধানে যেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ হবে, সেখানে সার্বিকভাবে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য রাষ্ট্রের কোনো প্রকার পদক্ষেপ বা কার্যকর ভূমিকা রয়েছে কি? গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা ইত্যাদি রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা কোথায়?
সংবিধান মোতাবেক নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে, তা পূরণে সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রোধে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে, যা বিলুপ্ত করার জন্য সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া নির্বাচনী ব্যবস্থা স্বচ্ছ, নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য সব রাজনৈতিক দল (সরকারি ঘরানার ছাড়া) নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য জোর গলায় দাবি জানাচ্ছে। সরকার এ দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করছে না, বরং বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে দাবি বাস্তবায়নে অনীহা প্রকাশ করছে। প্রতীয়মান হচ্ছে, সরকারের বদ্ধমূল ধারণা, নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তারা জয়লাভ করতে পারবে না।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন