শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

কোরবানির পশু নির্বাচনের মানদন্ড

প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ

পাষবিকতা দমন, ত্যাগের শিক্ষায় এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরীক্ষায় সাফল্যের জন্য প্রিয়বস্তু, প্রিয়প্রাণ, প্রিয়সম্পদ উৎসর্গের মহোৎসব ‘কোরবানি’। উজুহিয়্যা, জাবাহা, হাদিঈ, ইহরাকিদ-দাম ইত্যাদি কোরবানির সমার্থক। আর শরি’আতের পরিভাষায় ‘মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পশু জবাই করাকে কোরবানি বলে’ (শামি ৫ম খ-)। আরবি কোরবান, কুরবত, কিরবান অর্থ ত্যাগ, নৈকট্য, উৎসর্গ। সুরা বাকারা, আল-ইমরান, মায়েদা, আনআম, হজ, কাওসার প্রভৃতি সুরায় কোরবানির বিবরণ পাওয়া যায়। আর সুরা সাফ্ফাতে ইব্রাহিমের (আ.) কাহিনীর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এবং প্রিয়নবী (স.) বলেছেন “সুন্নাতা আবিকুম্ ইব্রাহিম” অর্থাৎ ‘এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের (আ.) আদর্শ” (মেশকাত)।
কোরবানির উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জন। তাই কোরবানির পশুটিকে হতে হবে প্রিয় ও পছন্দনীয়। হেদায়া ৪র্থ খ-ে আছে ছয়টি বিশেষ পশু দ্বারা কোরবানি আদায় করতে হবে এবং এগুলোর মধ্যে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক বছর, গরু, মহিষ দু’বছর এবং উট পাঁচ বছরের কম হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে না। পশুগুলোও হতে হবে যথাসম্ভব ত্রুটিমুক্ত।
হযরত মুসার (আ.) যুগের একটি হত্যারহস্য উন্মোচনে গরু কোরবানি বা জবাইয়ের বর্ণনার কারণে আল কোরআনের সর্ববৃহৎ সুরার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাকারা’ বা গরু। এ সুরার ৬৭-৭১ নম্বর আয়াতে ঐ গরুর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। যা কোরবানির পশু নির্বাচনের আদর্শ মানদ- হতে পারে। যেমন- (ক) মধ্যম বয়সী হওয়া, (খ) হলুদ উজ্জ্বল গাঢ় বর্ণের হওয়া, (গ) আকর্ষণীয় ও দর্শকনন্দিত হওয়া, (ঘ) পরিশ্রমক্লান্ত না হওয়া এবং (ঙ) সুস্থ ও নিখুঁত হওয়া।
কোরবানির পশু মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও অনুপম সৃষ্টি নৈপুণ্যের নিদর্শন। পরিবেশ, প্রতিবেশগত কারণে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হলেও বিপুল উৎসাহে প্রতি বছর অসংখ্য উট, গরু ইত্যাদি কোরবানি হলেও এগুলো টিকে আছে আপন অস্তিত্বে। এজন্যই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “কোরবানির উট-গরুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ বানিয়েছি” (হজ: ৩৬)।
হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রিয়পুত্র কোরবানির জন্য পেশ করবার মধ্য দিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন কোরবানি করতে হবে প্রিয়বস্তু। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করা ছাড়া তোমরা কখনোই সৎকর্মশীলতায় পৌঁছবে না” (আল-ইমরান: ৯২)। এতে বোঝা যায় কোরবানির পশু হতে হবে দোষমুক্ত। কেননা, প্রিয়নবীর (স.) নির্দেশনা “কোরবানির পশুতে চারটি দোষ সহনীয় নয়Ñ (ক) স্পষ্টত অন্ধ, (খ) মারাত্মক অসুস্থ, (গ) দুর্বল-হাড্ডিসার এবং (ঘ) চার পায়ে চলতে পারে না এমন অক্ষম বা খোঁড়া”(তিরমিযি)। অন্য বর্ণনায় আছে “ইবনু ওমর (রা.) এমন পশু কোরবানি করতে নিষেধ করেছেন যার দাঁত নেই এবং যা সৃষ্টিগতভাবেই পঙ্গু” (মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মদ)। অন্যদিকে পশুগুলোর জন্মের পবিত্রতা নিশ্চিত হওয়াও জরুরি। এজন্যই কৃত্তিম প্রজননের প্রাণী, বন্যপ্রাণী, চারণভূমিতে অবাধবিচরণশীল প্রাণী কোরবানির ক্ষেত্রে পরিহার করা উচিত এবং ধর্মভীরুতার (তাকওয়া) শিক্ষা। এমনকি ফতোয়ায়ে শামি গ্রন্থে আছে পবিত্র খাবার খায়িয়ে পশুগুলোর শরীর থেকে অপবিত্রতা দূর করবার জন্য এবং অপবিত্র খাবার থেকে মুক্ত রাখবার জন্য উট ৪০ দিন, গরু মহিষ ২০ দিন, ছাগল ভেড়া ১০ দিন বেঁধে রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। আসল কথা হলো কোরবানির পশু মহান আল্লাহর শাহি দরবারে পেশ করা হয় তাই তা হতে হবে যথাসাধ্য ত্রুটিমুক্ত এবং পুত্রের ন্যায় প্রিয়-পবিত্র।
ফিকহ গ্রন্থে ত্রুটিমুক্ত পশু প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যাতে নি¤েœাক্ত বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়Ñ ১. দু’চোখ বা এক চোখ এক-তৃতীয়াংশের বেশি অন্ধ পশু কোরবানি চলবে না । ২. তিন পায়ে চলে বা চার পায়ে ভর দিতে পারে না এমন পশু কোরবানি করা বৈধ নয়। ৩. পশুর কান বা লেজ এক-তৃতীয়াংশের বেশি কাটা থাকলে কোরবানি হবে না। ৪. মজ্জা শুকিয়ে গেছে এমন হাড্ডিসার পশুতে কোরবানি হবে না। ৫. শিং উঠেই নি অথবা শিং অগ্রভাগ বা সামান্য ভাঙ্গা হলে চলবে তবে শিং যদি মূল থেকে ভেঙ্গে থাকে তাতেও কোরবানি শুদ্ধ হবে না। ৬. যে পশুর চামড়া, পশম নষ্ট বা চর্মরোগের কারণে গোশত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন পশু কোরবানি করা যাবে না।
বাচ্চা প্রসবের সময় অত্যাসন্ন এমন পশু কোরবানি করা মাকরূহ। কেননা, ইবাদত ত্রুটিমুক্ত হওয়া জরুরিÑ কোরবানি একটি উচ্চমর্যাদার ইবাদত তাই এর পশু হতে হবে নিখুঁত। কেননা, হাদিসের বিবরণে রয়েছে, কোরবানির পশু হাশরের ময়দানে শিং, কান, চোখ, লেজ ইত্যাদিসহই হাজির করা হবে।
বস্তুত দয়াময় আল্লাহর কতই না অনুগ্রহ পশুটি উৎসর্গ করা হয় মহান আল্লাহর জন্য কিন্তু তার স্বাদভোগ করে মানুষ এবং তা হয়ে যায় সামাজিক সম্পদ ও সম্প্রীতির বাহন। মহান আল্লাহ বলেন, “তা হতে তোমরা নিজেরা খাও এবং ধৈর্যশীল, অভাবী ও মুখাপেক্ষীদের খেতে দাও... আল্লাহর কাছে না তাদের গোশত পৌঁছে না তাদের রক্ত বরং পৌঁছে যায় তোমাদের ধার্মিকতা” (হজ: ৩৬, ৩৭)।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন