বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুক্তাঙ্গন

কোরবানির ইতিহাস ও আমাদের শিক্ষা

প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মাহবুব আলম
ঈদ অর্থ আনন্দ। এখানে ঈদ শব্দের সাথে আরেকটি শব্দ যুক্ত রয়েছে তা হলো আজহা। যার অর্থ হলো ত্যাগ বা কোরবানি। পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় ত্যাগের আনন্দ। পৃথিবীর ইতিহাসে কোরবানি একটি বিরল ঘটনা। ত্যাগের মাধ্যমে আনন্দ এটা শুধু কোরবানিতে রয়েছে। পৃথিবীতে আনন্দ হয় ভোগের মাধ্যমে। ইসলাম মুসলমানদের ত্যাগের মাধ্যমে আনন্দের শিক্ষা দিয়েছে, ভোগের মাধ্যমে নয়। আনন্দ, ফূর্তি, অপচয়, অপব্যয়ের জন্য আগমন ঘটেনি ঈদুল আজহার। ত্যাগের মাধ্যমে, কোরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রতি বছর আগমন ঘটে মহান ঈদুল আজহার। ঈদুল আজহা বয়ে নিয়ে আসে অনুপম, অনন্য ত্যাগের মাধ্যমে নির্মল আনন্দ।
ত্যাগাশ্রয়ী এই আনন্দ পৃথিবীর অনেক দেশে ঈদুল কোরবানি নামেও পরিচিত। আল্লাহর নবী ইব্রাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতি বিজড়িত এই ঈদুল আজহা। আল্লাহর সামনে কিভাবে নিজেকে উজাড় করে দিতে হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য স্থান দখল করে আছেন নবী ইব্রাহীম (আ.)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বপ্নের মাধ্যমে নবী ইব্রাহীম (আ.)কে বলেছেন তাঁর প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় কোরবান দেওয়ার জন্য। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সরাসরি ওহী নাযিল না করে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রিয় বস্তু কোরবানির নির্দেশ দেওয়ার কারন সম্ভবত ইব্রাহীম (আ.)-এর আকিদা বা বিশ্বাস পরীক্ষা করা, যে ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নটাকে কতটুকু গুরুত্ব প্রদান করেন। স্বপ্নটাকে কি স্বাভাবিক ভাবে উড়িয়ে দেন, না তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে বলে বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্তক চেষ্টা করেন। বাস্তবে দেখা গেলো ইব্রাহীম (আ.)-এর আকীদা বড় শক্ত আকিদা।
তিনি আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজেকে কোরবান করে দিলেন। পরদিন সকালে কিছুসংখ্যক উট কোরবান করে দিলেন। কিন্তু না, তাঁর কোরবান কবুল করা হলো না। তার পরদিন স্বপ্নের মাধ্যমে বলা হল প্রিয় বস্তু কোরবানের জন্য। তিনি মোরাকাবায় বসে গেলেন। আল্লাহর অলীগণ যে মোরাকাবা করেন তা তাদের আবিষ্কৃত না বরং তা নবীগণের আমলের একটি অংশ। ইব্রাহীম (আ.) দেখলেন আসমানের নিচে জমিনের উপর একমাত্র পুত্র ইসমাঈল ছাড়া প্রিয় আর কেহ নাই। বুড়ো বয়সের সন্তান হিসাবে ইব্রাহীম (আ.) ইসমাঈল (আ.) কে অনেক বেশি মুহাব্বত করতেন, ভালবাসতেন। আর আল্লাহ চাইলেন তাঁর প্রিয় সেই ইসমাঈলকে তাঁর রাস্তায় কোরবান করার জন্য। তখন ইব্রাহীম (আ.) বললেন, পুত্র আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে এই স্বপ্ন ইব্রাহীম (আ.) কে পর পর তিনদিন দেখানো হয় (তাফসীরে কুরতুবী)।
নবীগণের স্বপ্নও অহীর অন্তর্ভুক্ত। এ স্বপ্নের অর্থ ছিল এই যে, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইব্রাহীম (আ.) এর প্রতি একমাত্র পুত্রকে জবাই করার হুকুম হয়েছে। কিন্তু স্বপ্নে দেখানোর তাৎপর্য ইব্রাহীম (আ.) এর আনুগত্য পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পাওয়া। স্বপ্নের মাধ্যমে প্রদত্ত আদেশে মানব মনের পক্ষে ভিন্ন অর্থ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ইব্রাহীম(আ.) ভিন্ন অর্থের পরিবর্তে আল্লাহর আদেশের সামনে মাথা নত করে দেন (তাফসীরে কবীর)। আল্লাহ তাআলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ইসমাঈল (আ.)কে যবেহ করা ছিল না কিংবা ইব্রাহীম (আ.)কেও আদেশ দেয়া ছিল না যে প্রাণপ্রতিম পুত্রকেই যবেহ করে ফেল। বরং উদ্দেশ্য ছিল যে, নিজের পক্ষ থেকে যবেহ করার সমস্ত আয়োজন সমাপ্ত করে যবেহ করতে উদ্যত হয়ে যাও।
অনেক কামনা বাসনা ও দোয়া প্রার্থনার পর পাওয়া এই প্রাণপ্রতিম পুত্রকে কোরবানি করার নির্দেশ এমন সময় দেয়া হয়েছিল যখন পুত্র পিতার সাথে চলাফেরার যোগ্য হয়ে গিয়েছিল এবং লালনপালনের দীর্ঘ কষ্ট সহ্য করার পর এখন সময় এসেছিল আপদে বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়ানোর। তাফসীরবিদগণ বলেছেন যে, তখন ইসমাঈল (আ.)-এর বয়স ছিল তের বছর। কেউ কেউ বলেছেন যে, তিনি সবেমাত্র সাবালক হয়েছেন (তাফসীরে মাযহারী)। ইব্রাহীম (আ.) পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর মতামত জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসা করে বলেলন, বাবা এ ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? ইব্রাহীম (আ.) পুত্র ইসমাঈল (আ.)কে এ জন্য জিজ্ঞাস করেননি যে তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালনে সন্দিহান ছিলেন।
বরং তিনি প্রথমত পুত্রের পরীক্ষা নিতে চেয়েছিলেন যে, এ পরীক্ষায় সে কতদূর উত্তীর্ণ হয়? দ্বিতীয়ত নবীগণ আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকেন কিন্তু আনুগত্যের জন্য সর্বদা উপযোগী ও সহজ পথ অবলম্বন করেন (তাফসীরে রুহুল মায়ানী, বয়ানুল কোরআন)। কিন্তু সে পুত্র ছিলেন খলীলুল্লাহরই পুত্র ও ভাবী নবী। তিনি কোরআনের ভাষায় জবাব দিলেন, হে পিতা, আপনাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সেরে ফেলুন। এতে ইসমাঈল (আ.)-এর অতুলনীয় বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা ও আত্মনিবেদনের পরিচয় পাওয়া যায়। এত কচি বয়সে আল্লাহ তাআলা তাকে কি পরিমাণ মেধা ও জ্ঞান দান করেছিলেন যে, ইব্রাহীম (আ.) তার সামনে আল্লাহর কোন নির্দেশের কথা বলেননি, বরং একটি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন মাত্র। কিন্তু ইসমাঈল (আ.) বুঝে নিলেন নবীগণের স্বপ্নও ওহী বটে। কাজেই এ স্বপ্নও আল্লাহর একটি নির্দেশ। অতএব জবাবে তিনি স্বপ্নের পরিবর্তে নির্দেশের কথা বললেন।
ইসমাঈল (আ.) সাথে সাথে পিতাকে এ আশ্বাস দিলেন যে, ইনশাআল্লাহ আপনী আমাকে ধৈর্যশীলদের মাঝে পাবেন। এখানে ইসমাঈল (আ.) চূড়ান্ত আদব ও বিনয়ের পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমতঃ তিনি ইনশাআল্লাহ বলে বিষয়টি আল্লাহর কাছে সমর্পণ করে দেন এবং এ ওয়াদায় দাবীর যে বাহ্যিক আকার ছিল, তাও খতম করে দিলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি এ কথাও বলতে পারতেন যে, ইনশাআল্লাহ আপনী আমাকে সবরকারী পাবেন কিন্তু এর পরিবর্তে বললেন সবরকারীদের মধ্যে পাবেন। তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন যে, এ সবর ও সহনশীলতা একা আমারই কৃতিত্ব নয়; বরং দুনিয়াতে আরো সবরকারী হয়েছেন। ইনশাআল্লাহ আমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।
এভাবে তার অহংকার ও অহমিকার নাম-গন্ধটুকু পর্যন্ত খতম করে দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের বিনয় ও বশ্যতা প্রকাশ করেছেন (তাফসীরে রুহুল মায়ানী)। এর থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, মানুষ কোন ব্যাপারে নিজের উপর যত আত্মবিশ্বাসই পোষণ করুক না কেন, গর্ব ও অহংকার প্রকাশ পেতে পারে এমন দাবী করা মোটেই উচিত নয়। কোথাও এমন পরিস্থিতির শিকার হলে ভাষা এমন হওয়া উচিত যাতে নিজের পরিবর্তে আল্লাহর উপর ভরসা প্রকাশ পায়। ইতিহাস ও তাফসীরভিত্তিক কোন কোন রেওয়ায়েতে জানা যায় যে, শয়তান তিন তিন বার ইব্রাহীম (আ.)কে প্রতারিত করার চেষ্টা করে এবং ইব্রাহীম (আ.) প্রত্যেক বারেই তাকে সাতটি কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। তাঁর এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতি মীনায় হাজীগণ তিনবার সাতটি করে কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে উদযাপন করেন।
অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য কোরবানির স্থানে উপস্থিত হলেন তখন ইসমাঈল (আ.) পিতা ইব্রাহীম (আ.)কে বললেন, পিতা, আমাকে খুব শক্ত করে বেঁধে নেন, যাতে আমি বেশি ছটপট করতে না পারি। আপনার পরিধেয় কাপড় সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা তাতে না পড়ে। এতে আমার সাওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এছাড়াও রক্ত দেখলে আমার মাও ঘাবড়ে যেতে পারেন। আপনার ছুরিটাও ভাল করে ধার দিয়ে নিন এবং তা আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। কারণ মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার। আপনি আমার মায়ের কাছে পৌঁছে আমার সালাম জানাবেন। যদি আমার জামা তার কাছে নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন। হয়তো তাতে তিনি কিছুটা সান্ত¡না পাবেন।
একমাত্র সন্তানের মুখে এসব কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কি হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। কিন্তু ইব্রাহীম (আ.) দৃঢ়তার অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, হে পুত্র, আল্লাহর নির্দেশ পালনে তুমি আমাকে চমৎকার সহায়তা করছো। অতঃপর তিনি পুত্রকে চুম্বন করলেন ও অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকে বেঁধে নিলেন। অতঃপর ইব্রাহীম (আ.) তাকে সোজা করে শুইয়ে দিলেন কিন্তু বারবার ছুরি চালানো সত্ত্বেও কাটছিল না। কেননা আল্লাহ তাআলা স্বীয় কুদরতে পিতলের একটি টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিলেন। তখন পুত্র পিতাকে আবদার করে বলেন- পিতা, আমাকে কাত করে শুইয়ে দিন। কারণ আমার মুখম-ল দেখে আপনার মধ্যে পৈতৃক স্নেহ উথলে উঠে। ফলে গলা সম্পূর্ণরূপে কাটা হয় না এছাড়াও এত বড় ছুরি দেখে আমি ঘাবড়ে যাই। সে হিসাবে ইব্রাহীম (আ.) তাকে কাত করে শুইয়ে ছুরি চালাতে থাকেন (তাফসীরে মাযহারী)। অতঃপর আসমান থেকে আওয়াজ আসলো, হে ইব্রাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আল্লাহর আদেশ পালনে ইব্রাহীম (আ.) এর যা করণীয় ছিল তিনি তা করে দেখিয়েছেন। স্বপ্নে সম্ভবত এ বিষয়টিই দেখানো হয়েছিল যে, ইব্রাহীম (আ.) যবেহ করার জন্য পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন।
এখন এই পরীক্ষা পূর্ণ হয়ে গেছে, আসমান থেকে আওয়াজ আসলো- ইব্রাহীম, তাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কোন বান্দাহ যখন আল্লাহর আদেশের সামনে নতশির হয়ে নিজের সমস্ত ভাবাবেগকে কোরবান করতে উদ্যত হয়, তখন আল্লাহ পরিশেষে তাকে পার্থিব কষ্ট থেকেও বাঁচিয়ে রাখেন এবং পরকালেও এর বিশেষ প্রতিদান প্রদান করেন। ইব্রাহীম (আ.) আসমানী এ আওয়াজ শুনে উপরের দিকে তাকালে হযরত জিবরাঈল আমিন ফিরিস্তাকে একটি বকরী নিয়ে দাঁড়ানো দেখলেন। এই জান্নাতী বকরী ইব্রাহীম(আ.)কে দেয়া হলে তিনি আল্লাহর নির্দেশক্রমে পুত্রের পরিবর্তে সেটি কোরবানি করলেন। এই বকরীকে কোরআনের ভাষায় আজীম বলার কারণ হলো, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছিল এবং এর কোরবানি কবুল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না।
কোরবানির মূলকথা হলো তাকওয়া। তাকওয়ার চূড়ান্ত অর্থ হলো মুমিনের সেই সংকল্প যাতে প্রয়োজনবোধে মুমিন তার সবকিছু, এমনকি নিজের জীবনটি ও আল্লাহর পবিত্র নামে কোরবানি করতে সদা প্রস্তুত। কোরআনুল কারীমে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে : কোরবানিকৃত পশুর রক্ত, মাংস কিছুই আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না, বরং আল্লাহর কাছে পৌঁছায় কোরবানি আদায়কারী মুমিন বান্দাহর তাকওয়া। ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ (আ.) ও ইসমাঈল যবীহুলল্লাহ (আ.) এর মহান ও নজিরবিহীন আত্মত্যাগ, মহান আল্লাহর প্রতি তাদের দ্বিধাহীন, অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণ মানুষকে শিখিয়েছে যে, এই পার্থিব জীবনের সুখ শান্তি নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে আখেরাতের শান্তিই হচ্ছে অনন্ত, নিরবচ্ছিন্ন চিরন্তন। পিতা-পুত্রের সেই সঙ্ঘে মাতা হাজেরার ও অবিস্মরণীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা আরো শিক্ষা দেয় যে, আমাদের জীবন-মরণ, সুখ-শান্তি, ব্যথা-বেদনা, আনন্দ-আহ্লাদ, নামাজ-ইবাদত সকল কিছুই শুধুমাত্র এক আল্লাহ তায়ালার জন্য।
ষ লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মাসিক রেনেসাঁ, চাঁদপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন