জামালউদ্দিন বারী
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পশ্চিমা অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থে যুদ্ধবিগ্রহ ও গণহত্যায় লিপ্ত হচ্ছে। পশ্চিমাদের শিল্পায়ন এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শিল্পায়নের চাকাকে সচল রাখতে তারা আমদানিনির্ভর ফসিল জ্বালানির (পেট্রোলিয়াম) ওপর নির্ভরশীল। ইতোমধ্যেই হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ এবং সোলার ও বায়ুবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির নানাবিধ বিকল্প উৎসেরও বিকাশ ঘটতে শুরু করেছে। তবে মানুষের খাদ্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সুপেয় পানির কোনো বিকল্প আপাতত কারো কাছে নেই। নানাভাবে নানা কারণে কৃষিজমি এবং উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, পক্ষান্তরে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখে ষাটের দশকে পশ্চিমা বহুজাতিক এগ্রো ও পেট্রো-কেমিক্যাল কোম্পানিগুলো তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশ খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কার মধ্যে পড়েছিল, সবুজ বিপ্লবের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক (গ্রিন রেভ্যুলেশন) স্লোগান তুলে সেখানকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মহাপরিকল্পনা গ্রহণের প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়েছিল। সেসব প্রেসক্রিপশন অনুসারে সরকারগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার বড় বড় সেচ প্রকল্প, নদীতে বাঁধ ও ড্যাম নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, আইডিবিসহ পশ্চিমা ঋণদাতা এবং ইঞ্জিরিয়ারিং কোম্পানিগুলোর সাথে হাজার হাজার কোটি ডলারের চুক্তি হয়। অন্যদিকে সেচের জন্য লাখ লাখ সেচযন্ত্র, লাখ লাখ টন রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, হার্বিসাইড, ফাঙ্গিসাইড ওষুধ এবং প্রয়োজনীয় পেট্রোল আমদানির ক্ষেত্রেও সেসব কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এভাবেই এক কেজি ধান ফলাতে কয়েক হাজার লিটার পানি, আমদানিকৃত অথবা ল্যাবরেটরিতে উদ্ভাবিত উফশি ধানবীজ, সার, কীটনাশকের পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। একসময় প্রতি বিঘা জমিতে ৮-৯ মণ ধান ফলনের পরও নবান্নে কৃষকের মুখে হাসি ফুটত। এখন প্রতি বিঘায় ২০ মণ (দ্বিগুণের বেশি) ফলনের পরও কৃষকের মুখে হাসি থাকে না। বাজার মূল্যে ধান, আলু, ভুট্টা বা টমেটোর উৎপাদন খরচ না ওঠার কারণে প্রতিবছরই বাংলাদেশের কৃষকরা রাস্তায় ফসল ঢেলে প্রতিবাদ জানায়। বাম্পার ফলনের পরও কৃষকরা পুঁজি হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই খাদ্য ঘাটতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির প্রেসক্রিপশনে আমাদের দরিদ্র কৃষকরা আরও দরিদ্র হয়ে প্রকারান্তরে জিম্মিদশায় পতিত হচ্ছে। একদিকে উজানের ফারাক্কা, গজলডোবা ড্যামের কারণে আমাদের সুজলা সুফলা নদীগুলো শুকিয়ে গেছে, অন্যদিকে হাইব্রিড ধান উৎপাদনের জন্য হাজার হাজার নলকূপ ও সেচপাম্প বসিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি করা হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানিতে ইতোমধ্যেই ভয়াবহ আর্সেনিক বিষের দূষণ ঘটেছে। এ ছাড়া দেশের অধিকাংশ স্থানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ায় হাজার হাজার নলকূপ এবং সেচপাম্প অকেজো হয়ে পড়ছে। আগামী দশকগুলোতে অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভেবে শিউরে উঠতে হয়। হাজার নদীর অববাহিকার দেশ বাংলাদেশকে এ অবস্থার মুখোমুখি হওয়ার প্রেক্ষাপট ইতোমধ্যে কিঞ্চিৎ উল্লিখিত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশই এখন এ ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি নয়, আগামী দশকগুলোতে বিশ্বের বহু জনপদ পানি ও পরিবেশগত সংকটের কারণে অস্তিত্বের মুখোমুখি দাঁড়াবে। জ্বালানি ও বাণিজ্য প্রভাবিত বিশ্বঅর্থনীতির গতানুগতিক প্রেক্ষাপট থেকে বেরিয়ে একবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপট অনেকটাই বদলে যাবে। কেউ কেউ আগামী দিনের যুদ্ধ এবং আঞ্চলিক সম্পর্কের নিয়ামক হিসেবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নদ-নদীর প্রবাহ ও সুপেয় পানির বণ্টন বা হিস্যার কথা বলছেন। গত শুকনো মৌসুমে আমন ধান চাষের সময় আমরা পদ্মা ও তিস্তাপাড়ের হাজার হাজার কৃষক পরিবারের মধ্যে পানির জন্য হাহাকার দেখেছি। এখন বর্ষার সময় আন্তর্জাতিক নদীর ওপর ভারত সরকারের নির্মিত অবৈধ ড্যামগুলোর সব গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণের লাখ লাখ বাড়িঘর উজানের পানিতে তলিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে।
ফারাক্কা যে বাংলাদেশের জন্য মরণফাঁদ, একজন অশিক্ষিত অতি সাধারণ বুদ্ধির মানুষও তা বোঝেন। আমাদের ক্ষমতাসীন দলের কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য শুনলে মনে হয় তারা কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী। অথবা তারা ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে তাদের স্বার্থে বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, মন্ত্রীত্ব করেন। ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতের অন্তত চারটি রাজ্যে বড় ধরনের বন্যা দেখা দেয়ার পর সম্প্রতি এসব রাজ্যের রাজনৈতিক নেতা, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীরাও দিল্লির কাছে ফারাক্কা বাঁধ তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। গঙ্গায় সাংবাৎসরিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচতে সম্প্রতি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার ফারাক্কা ড্যাম সরিয়ে ফেলার দাবি তুলেছেন। একইভাবে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা এবং ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায়ও নিজ নিজ রাজ্যের জনগণের পক্ষ থেকে একই রকম দাবি তুলেছেন। তবে বাংলাদেশের বানভাসি মানুষ অবাকবিস্ময়ে শুনলেন আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের ভিন্ন সুর। বাংলাদেশ ও ভারতের কোটি কোটি মানুষের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রী ভারতের কাছে ফারাক্কা বাঁধের কুফল এবং গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিকে আরো জোরালো তোলবেন, জনগণের এমন প্রত্যাশার মুখে ছাই দিয়ে তিনি যখন দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা হয়নি। তখন এ দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, তিনি বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী হয়ে আসলে কার স্বার্থ রক্ষায় কথা বলছেন? শুধু তিনিই নন, আরো কয়েকজন এমপি-মন্ত্রী বন্যা ও ফারাক্কা প্রশ্নে ভারতের পক্ষ হয়ে কথা বলছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফারাক্কা, তিস্তা ও প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ ও কথিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা, বসবাসযোগ্যতা তথা অস্তিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের বাস্তবতায় কোনো সরকার, দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তি চুপ থাকতে পারে না। জাতির সামনে এমন অস্তিত্ববিনাশী হুমকি রেখে তারা একপাক্ষিক কিসের বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চায়? বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়, ভারতের অনিচ্ছায় যৌথনদী কমিশনের কোনো বৈঠক হয় না। ত্রিপুরার রাজ্যপাল তথাগত রায় যখন ত্রিপুরার জনগণের স্বার্থে ফারাক্কা তুলে দেয়ার কথা বলেন, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা অথবা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার তাদের জনগণের স্বার্থে ফারাক্কা তুলে দেয়ার দাবি জানাতে পারলেও বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী কেন দিল্লির পানিসম্পদ মন্ত্রীকে বলতে পারেন না, অনেক হয়েছেÑ এবার ফারাক্কা সরিয়ে নাও এবং অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে আসো। অন্যথায় আমরা আন্তর্জাতিক ফোরামে ও আদালতে তুলব। জাতির স্বার্থে মেরুদ- সোজা করা এমন সরকার এবং মন্ত্রী আমরা কবে পাব। যিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলবেন, আমার দেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার এবং পানিতে ডুবিয়ে মারার ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা ত্যাগ করুন। ভারতের সহযোগিতায় আমরা মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাসের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলাম। পাকিস্তানের কারাগার থেকে সেই ভারতের মাটিতে নেমেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে নাকি বলেছিলেন, আমার দেশ থেকে আপনার সেনাবাহিনী কবে ফিরিয়ে আনবেন? এতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বা কংগ্রেসের সাথে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরিরা শুধু তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতেই ব্যর্থ হচ্ছেন না, শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী পরিষদের কোনো কোনো সদস্য যেন ভারতের পক্ষে ইকোনমিক হিটম্যানের (ইএইচএম) দায়িত্ব পালন করছেন।
আমাদের পাঠকদের কাছে ‘ইকোনমিক হিটম্যান’ সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। মার্কিন অর্থনীবিদ জন পারকিনস ২০০৪ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনী ‘কনফেশান অব অ্যান ইকোনমিক হিটম্যান’ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সমাজে ইকোনমিক হিটম্যানদের সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের জরিপে দীর্ঘদিন ধরে বেস্টসেলার বই হিসেবে এই গ্রন্থটি সারা বিশ্বে লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে এবং বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এই গ্রন্থে পারকিন্স কীভাবে চেস টি. মেইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির পরামর্শক ও প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির (এনএসএ) পক্ষ হয়ে কাজ করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। তার ভাষায়Ñ “ইকোনমিক হিটম্যান আর হাইলি পেইড প্রফেশনালস হু চিট কান্ট্রিজ এরাউন্ড দ্য গ্লোব আউট অব ট্রিলিয়ন ডলার্স...” বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার এবং রাজনৈতিক নেতাদের বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে মার্কিন কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ বাস্তবায়ন এবং বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএইডের মতো অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শত শত কোটি ডলারের লোন নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ত্রিমুখী স্বার্থ উদ্ধার করাই ইকোনমিক হিটম্যানদের কাজ। এ জন্য তারা সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। জন পারকিনস তার গ্রন্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম দিকের ইকোনমিক হিটম্যান হিসেবে পঞ্চাশের দশকে কেরমিট রুজভেল্ট জুনিয়রের নাম উল্লেখ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬তম প্রেসিডেন্ট (১৯০১-১৯০৯) থিওডর রুজভেল্টের নাতি কেরমিট রুজভেল্টকে প্রথম সফল ইকোনমিক হিটম্যান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন পারকিন্স। বৃটিশ-ইরানিয়ান তেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করার কারণে বিক্ষুব্ধ বৃটিশ সরকারের অনুরোধে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ইরানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডা গ্রহণ করেছিল। ইরানি জনগণকে বিক্ষুব্ধ না করে, কোল্ড ওয়ারের প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নকে হস্তক্ষেপের সুযোগ না দিয়ে সিআইএর পক্ষ থেকে একটি রক্তপাতহীন ক্যু সূচারুভাবে বাস্তবায়ন করেন কেরমিট। এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ইরানি সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোতে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়েছে। সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই রক্তপাতহীনভাবে ইরানের গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে মার্কিনিদের অনুগত পাহলবি শাহদের আবারো ক্ষমতায় বসানোর কৃতিত্বের জন্য কেরমিট রুজভেল্টকে ১৯৫৩ সালের টাইমস ম্যাগাজিনে বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল বলে পারকিনস উল্লেখ করেছেন। প্রথমত. পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর স্বার্থ রক্ষার জন্য তৃতীয় বিশ্বের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সম্ভাবনাময় ও দেশগুলোতে নিজেদের বশংবদ সরকারকে ক্ষমতায় রাখা এবং বসানো, দ্বিতীয়ত. বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করতে সেসব সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা, এসব প্রকল্পের কাজ মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা এবং বড় ঋণের দায়দেনার সুযোগ নিয়ে মার্কিন জিও-পলিটিক্যাল স্ট্রাটেজিতে বাড়তি সুবিধা আদায় করে নেয়ার বন্দোবস্ত করাই ইকোনমিক হিটম্যানদের কাজ। সময়ের বিবর্তনে বিশ্বের নতুন নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরাশক্তির উদ্ভবের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীন, ভারতের মতো দেশগুলোও এখন এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোতে ইকোনমিক হিটম্যান নিয়োগ করছে কিনা আমার তা জানা নেই। তবে বিশ্বরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রায় সবকিছুই এখন বাণিজ্য এবং আগামীদিনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কৌশলগত দিক বিবেচনা করেই নির্ধারিত হচ্ছে।
একটি ভালোলাগা উদ্ধৃতির সূত্র ধরে জন পারকিনসের পরিচয় এবং তার কনফেশান অব ইকোনমিক হিটম্যান সম্পর্কে জানার আগ্রহ জন্মেছিল। সেই কোটেশনটি হচ্ছেÑ “No constitution, no court, no law can save liberty when it dies in the hearts and minds of men. - John Perkins ” অর্থাৎ- মানুষের চেতনা ও মনোজগতে লিবার্টি বা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মরে গেলে, কোনো সংবিধান, কোনো আদালত বা কোনো আইনই তার স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে না। আমরা কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছেছি? আমার দৃষ্টিতে এই প্রশ্নের জবাব হবে ‘না’। তবে মতভিন্নতা সত্ত্বেও এ বিষয়ে সকলকেই স্বীকার করতে হবে যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক বিশ্বমানচিত্রে নড়বড়ে ও অনিশ্চিত অবস্থান থেকে নিজের অস্তিত্বকে সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছে। ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জনসম্পদের দক্ষতা, বিশ্বাস ও আকাক্সক্ষার নিরিখে বাংলাদেশ তার কাক্সিক্ষত সামাজিক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাফল্য লাভে এখনো ব্যর্থ হচ্ছে। বাংলাদেশের কর্মক্ষম নাগরিকের সংখ্যা কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণের বেশি, প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি তরুণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। যেখানে আরব, অনারব ও ইহুদি মিলে ইসরাইলের জনসংখ্যা ৮০ লাখ, কুয়েতের ৬০ লাখ, আয়ারল্যান্ড ৬৩ লাখ, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশেরই জনসংখ্যা বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজারে কর্মরত শ্রমিকদের সংখ্যার অর্ধেক। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার পরও ভারতীয় নাগরিকদের বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিটেন্স আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের উপরে। ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার ভারতে পাঠাচ্ছে। ২০১৪ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, সে বছর বাংলাদেশি শ্রমিকরা সারা বিশ্ব থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয়রা ৪ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছে। গত দু-তিন বছরে এ অঙ্ক আরো অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের পক্ষে আকাশ-পাতাল বাণিজ্য বৈষম্যের কথা বাদ দিলেও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইতালি বা দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে ভারতীয়রা বেশি রেমিটেন্স আয় করে বাংলাদেশ থেকে। প্রতিবেশী দেশের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষায় তাদের কাক্সিক্ষত সব রকম সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পরও ভারতীয় নেতাদের কণ্ঠে মাঝে-মধ্যেই হেজিমনিক সুর শোনা যায়। আমাদের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে, সমমর্যাদার ভিত্তিতে মেরুদ- সোজা করে দাঁড়াতে পারলে বাংলাদেশকে অগ্রাহ্য করার শক্তি কোনো পরাশক্তিরই নেই। মার্কিন লেখক পল ক্রেইগ রবার্টস তার ‘হাউ আমেরিকা ওয়াজ লস্ট’ গ্রন্থের ভূমিকার শুরুতেই লিখেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেপুটেশন বৃদ্ধি এবং বিশ্বের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার মূলশক্তি হিসেবে পরিগণিত করতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘ডেমোনাইজ’ (অপশক্তি) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতির মূলভিত্তি...।’ বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সাথে আইএস ও জঙ্গিবাদ দমনের নামে সামরিক পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে চাচ্ছে এবং বিশ্বরাজনীতির পুরনো মেরুকরণ পাল্টে দিয়ে ইন্দো-মার্কিন সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক চুক্তি হচ্ছে, তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রজ্ঞা, সাহস ও দূরদৃষ্টির ঐতিহাসিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। যে দেশের মানুষ লাখো প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে, সে দেশের মানুষ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের কাছে, কোনো প্রতিবেশী বা পরাশক্তির কাছে বশ্যতা মানবে না। চীন-মার্কিন, ভারত-পাকিস্তান বা রাশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ কোনো বাফার স্টেট হবে না। এদেশের মানুষ সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক হেজিমনি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাদের ক্ষমতার মোহে আত্মঘাতী রাজনীতি পরিহার করতে হবে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন-বৈরিতার সুযোগ নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী শক্তির হিটম্যানরা ফায়দা হাসিল করলেও শেষ পর্যন্ত তা তাদের জন্য বুমেরাং হতে পারে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন