বাস থেকে সিরাজগঞ্জ শহরে নেমেই আলীশান হোটেলে ব্যাগ রেখেই ছুটে চললাম যমুনা নদীর দিকে। যুমনা নদীর চায়না গেইট পয়েন্টে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছেন স্থানীয় এক রাজনৈতিক কর্মী। তিনি আমাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচ দিয়ে যমুনা নদীর বুকে ঘুরে বেড়াবেন। বাসে আসার সময় দেখেছি বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচে মাত্র কয়েকটি পিলার পানির নিচে। সবগুলো পিলার বালুর ওপর দাঁড়িয়ে। সেতুর দুই ধারের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চর। ধান ক্ষেত ও বীজতলা চোখে পড়েছে বাস থেকেই। বিকেলের গোধূলির আলোয় ব্রিজের নিচে হাটবো আহা কত্ত মজা! বাইক চলছে আপন গতিতে। চালকের মুখে চলছে লাগামহীন খোশগল্প আর বেসুরো গান!
বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচে এসে যমুনার কিনারে বাইক থামল। তাকিয়ে দেখতেই কেঁপে উঠল বুক। হায়রে নমুন নদী? তোর এই দশা! চৈত্র মাসের প্রথম সাপ্তাহে পানি শুকিয়ে চৌচির। অথচ ২২ থেকে ২৩ বছর আগে সেতু নির্মাণের সময় নদী শাসন এবং পিলার দেয়ার জন্য পানি সরিয়ে নিতে শত শত কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। যমুনা নদীর মূল শ্রোত বোঝাই কঠিন হয়ে গেল। তবে স্থানীয় জেলেরা জানালেন প্রবাহিত পশ্চিমের দিকটাই যমুনার মূল শ্রোত। অন্যগুলো কার্যত চর পড়ে শাখা নদীতে পরিণত হয়েছে। যমুনায় পানির প্রবাহ না থাকায় খাঁ খাঁ করছে নদী।
যমুনা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে আমরা দু’জন ছিলাম হাঁটার দলে। ওই যে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচে শত ভ্রমণার্থী। সবাই হাঁটছি ব্রিজের দিকে...। কিন্তু চর আর পানি পেরিয়ে আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছি...। শেষ বিকেলের সূর্যের রঙিন আলোয় নদীর বুকে বঙ্গবন্ধু সেতুকে যেন আরো বিস্ময় মনে হচ্ছিল। উপরে হেলানো সূর্যটা রঙধনুর মতো আলো ছড়াচ্ছিলো! নদীর পানি শুকিয়ে চর আর চর, তার ওপর সেতু পড়ন্ত বিকেলে বেশ চমৎকার লাগছিল চারপাশ। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতুর নিচে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছি; অথচ নদীতে পানি নেই। ঘটনা যেন নেংটো রাজার মতোই। রাজা কোট টাই পরিহিত; অথচ ন্যাংটো।
পরের দিন সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালি, শাহজাদপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার প্রবাহিত যমুনা নদীর কয়েকটি পয়েন্টে ঘুরে মনে হলো পানির অভাবে নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। যমুনার বুকজুড়ে জেগে উঠেছে হাজারো আবাদি জমি। জমির মালিকরা জেগে ওঠা চরে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ করছেন। উৎপাদিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ফসল। এতে কিছু কৃষক হাসলেও ভরা নদীতে যেসব নৌ-শ্রমিক নৌকা চালিয়ে এবং জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, নদী পাড়ের হাজারো নৌ-শ্রমিক এবং জেলেরা বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ছেন।
সিরাজগঞ্জের পুরনো স্টীমার ঘাটে বাঁধের ওপর কয়েক বছর ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন মো: দেলোয়ার হোসেন। বললেন, আমরা কাউয়াখোলা ইউনিয়নের মানুষ। বন্যায় নদী ভাঙনে কয়েক বছর আগে সবকিছু যমুনায় বিলীন হয়ে গেছে। বাড়িঘর হারিয়ে তখন থেকে বাঁধে বাস করছি। অথচ এখন চর পড়ে শুকিয়ে গেছে। চর বেরাকোনা, চাÐাল বয়রা, বয়াল পাইক, জিয়ার পাড়া, দোগাছি পাড়া, ছোট কইরা সবগুলো গ্রাম নদীর পেটে গেছে। সেই নদী এখন পানির অভাবে মরুময়। বেলুটিয়া গ্রামের আমজাদ হোসেনের পুত্র মো. জালাল দোকানদার বললেন, আমরা মাছ ধরতাম। পানি না থাকায় মাছ ধরা পেশায় হাজারো জেলে রোজগার বন্ধ হওয়ায় দাদন ব্যবসায়ী এবং এনজিও’র কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাড়িতে খোরাকি দিয়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন রোজগারের জন্য। শহরে এসে (সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা) অনেকে রিকশা, ভ্যান, টেম্পু, সিএনজি, বাস-ট্রাক হেলপার, গার্মেন্টেস শ্রমিক, রাজমিস্ত্রির কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। বেলুটিয়া গ্রামের আছের শেখের ছেলে মো: আশরাফুল ইসলাম শেখ বললেন, এ গ্রামে ৬০ থেকে ৭০ ঘর মানুষ বাস করেন। সবার পেশা মাছ ধরা। অথচ যমুনায় পানি না থাকায় এখন মাছ পাওয়া যায় না।
সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলায় বøক ফেলে নদী ভাঙন ঠেকানো হয়েছে। তবে বর্তমানে পানি না থাকায় নদীর বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভ‚মি। তারপরও প্রতিবছর নদী ভাঙে। যমুনা তীরবর্তী নাটুয়ারপাড়া, শুভগাছা, পাইকপাড়া ও ঘোনাপাড়া চরের কয়েকজন জানালেন, যমুনা নদীর বিভিন্ন এলাকায় চর পড়ায় এখন আর জাল ফেলে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে বাপদাদার পেশা ছেড়ে দিয়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েছে। কাজিপুরের মেঘাই নৌ-ঘাটের নৌ-শ্রমিক মো: আল-আমিন, সাইফুল ইসলাম, নাটুয়ারপাড়া নৌ-ঘাটের সেলিম উদ্দিন বললেন, ২০ থেকে ২৫ বছর আগে প্রায় সারা বছরই নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যেত। এখন শুষ্ক মৌসুম শুরুর সাথে সাথেই যমুনা নদী বিভিন্ন এলাকায় শুকিয়ে নালায় পরিণত হয়েছে। নৌকা চলে না। তাই নৌকা বিক্রি করে দিয়ে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে সংসার পরিচালনা করছি। কাজিপুর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলের কমপক্ষে এক হাজার নৌ-শ্রমিক এবং জেলে বেকার হয়ে পড়েছে। ওই সব নৌ-শ্রমিক এবং জেলেরা বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিয়ে অতিকষ্টে জীবনযাপন করছেন।
যমুনার ভাঙন রোধে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্নিবাড়ি থেকে চন্দনবাইশা পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ৩টি ইউনিয়নের ১৮টি গ্রামের মানুষের জন্য বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়েছেন। সারিয়াকান্দি রক্ষা বাঁধের ওপর যখন পৌঁছি তখন ভরদুপুর। দূর দূরান্তের চর থেকে নৌকায় করে মানুষ হাট-বাজার করতে আসছেন। আবার দিনের বেলা থাকতেই তাদের ফিরে যেতে হবে। ঘুঘুমারি মধ্যপাড়া গ্রামের মো. শরিয়ত উল্লাহ বললেন, ‘১৮ বিঘা ধানি জমি ছিল। বসতভিটা, মাছভরা পুকুর ও গাছভরা ফল ছিল। যমুনা সব গিলে ফেলেছে। এখন সেই নদীতে পানি নেই। বঙ্গবন্ধু সেতুর দক্ষিণে চৌহালির বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার সময় ভেঙে গেছে। অথচ এখন মাইলের পর মাইল ধুধু বালুচর।
যমুনাপাড়ের মানুষ জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের ডান তীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে সারিয়াকান্দির রোহদহ থেকে দড়িপাড়া পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করে পাউবো। নি¤œমানের কাজের কারণে ২০১৪ সালের বাঁধটির ৩০০ মিটার ধসে যায়। ধসে যাওয়া অংশে নতুন করে ‘বিকল্প রিং বাঁধ’ নির্মাণ এবং সেখানে ৭৫ হাজার জিও ব্যাগ ফেলতে পাউবো ওই সময় আরো প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা ব্যয় করে। দুই দফায় প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয় করার পর রোহদহ বাজারের কাছে বাঁধ ধসে যায়। পরে ২০১৫ সালে কর্নিবাড়ি থেকে চন্দনবাইশা পর্যন্ত বিকল্প বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। জমি অধিগ্রহণ না করেই ২১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধটি তৈরি করা হয়। এতে করে চন্দনবাইশা ইউনিয়নের চন্দনবাইশা, চরচন্দনবাইশা, ঘুঘুমারি শেখপাড়া, ঘুঘুমারি দক্ষিণপাড়া, ঘুঘুমারি মধ্যপাড়া ও নিজ চন্দনবাইশা, কামালপুরের রোহদহ, ফকিরপাড়া, ইছামারা, আকন্দপাড়া, গোদাখালি, বয়ড়াখালি, হাওড়াখালি এবং কুতুবপুরের ধলিরকান্দি, ছোট কুতুবপুর, বয়রাকান্দি, নিজ কর্নিবাড়ি, বরইকান্দি, কর্নিবাড়ি ও বয়রাকান্দি হুমকির মুখে পড়ে। বাঁধ নির্মাণের অর্থ ব্যয় ও মহাকান্ডে মানুষ ত্যাক্ত বিরক্ত। চন্দনবাইশা ইউনিয়নের ঘুঘুমারি শেখপাড়া বয়োবৃদ্ধ মো. রজব আলী বললেন, বাঁধ দিয়ে কি হবে; নদীতে পানিই নেই। চর পড়ে সবকিছু খাঁ খাঁ করছে। অথচ বাঁধ নির্মাণের নামে সরকারি টাকা লুটতরাজ করা হয়েছে।
যমুনা পাড়ের সাংবাদিকদের মতে এবার যমুনার পানি অতীতের যে কোনো সময়ের শুকনা মৌসুমের চেয়ে কম। নদী এইভাবে প্রতিবছর শুকাতে থাকলে ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রয়োজন পড়বে কি না সন্দেহ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন