শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

অনাবৃষ্টি আর অতিমাত্রার হিটশকে হাজার হাজার হেক্টর বোরো ধানে কৃষকের স্বপ্নভঙ্গ

ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারী সহযোগিতা চান ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা

মো. শামসুল আলম খান | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০২১, ৩:২৮ পিএম

ময়মনসিংহে টানা রবি মৌসুমজুড়ে অনাবৃষ্টি, খরা আর অতিমাত্রায় সূর্য্যরে প্রখরতা দিন দিন বাড়তে থাকায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেই সাথে গত কয়েক দিন আগে প্রকৃতিতে হঠাৎ গরম বাতাসে অতিমাত্রার হিটশকে বোরো ধানের পরাগায়ন নষ্ট হয়ে এ অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর বোরো আবাদের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। এতে স্বপ্নভঙ্গ কৃষকদের এখন মাথায় হাত পড়েছে। দুঃশ্চিন্তার ভাঁজ যেন তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট।

এ অবস্থায় ক্ষতিপুশিয়ে নিতে সরকারী সহযোগীতা চান ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা। তাদের ভাষ্য, ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা এখন দিশেহারা। সামনের দিনগুলিতে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার দু’শ্চিন্তা এখন কৃষক সমাজের আষ্টেপৃষ্টে ভর করেছে। আশা করছি সরকার এবিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করবেন।

জেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানায়, এ বছর ময়মনসিংহ জেলায় দুই লাখ ৬৩ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েক দিন আগে হঠাৎ শিলা বৃষ্টি আর গরম বাতাসে ধানের পরাগায়ন নষ্ট হয়ে হাজার হাজার হেক্টর বোরো ধানের জমি যেন পুড়ে যাওয়া ফসলেল ধংস্বস্তুপ।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানায়, জেলার সদর উপজেলার চর দূর্গাপুর, চর ভবানীপুর, কোনাপাড়া, আনন্দীপুর, সিরতাসহ বিভিন্ন গ্রামের ধান নষ্ট হয়। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের ৩১ নম্বর ওর্য়াডের চর গোবিন্দপুরে কয়েকশ’ হেক্টর ধান নষ্ট হয়েছে। চর গোবিন্দপুরের কৃষক মিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘৮০ শতাংশ জমিতে আমি হাইব্রীড ধান চাষ করেছিলাম। গত রোববার সন্ধার সময় গরম বাতাসে সব ধান নষ্ট হয়ে গেছে। ৮০ শতাংশ জমিতে ৮ মন ধান পাব বলেও মনে হয় না।’ ওই গ্রামের কৃষক বাদশা মিয়া বলেন, ‘৯০ শতাংশ জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। ৯০ শতাংশ জমিতে যে পরিমাণ ধান পাওয়ার কথা ছিল। তার মধ্যে তিন ভাগের একভাগ ধানও পাব না। প্রতি ১০ শতাংশে জমির মালিককেই দিতে হবে দুই হাজার টাকা। ঋণ করে ধানের আশায় চাষ করেছিলাম। এখন আবার ঋণ করে জমির মালিককে ভর্তুকি দিতে হবে।’ একই এলাকার মো. আক্কাস আলী বলেন, ‘ঋণ নিয়ে ৫৫ শতাংশ জমিতে ধান চাষ করেছিলাম। ধান এমনভাবেই নষ্ট হয়েছে। যা দেখে মনে হয়, পাঁচ মণ ধানও পাব না। এখন খাব কি, ঋণ কোথা থেকে দেব?- তাই ভেবে পাচ্ছি না।
গৌরীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুর নাহার লিপি বলেন, ‘উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাসহ ২০ হাজার ৬ শ’ ১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছিল। যা গত বছরের তুলনায় বেশি জমিতে বোরো ধান চাষ হয়। ক্ষক্ষতির বিষয়টি আমাদের উর্ধতন কতৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’

জেলার নান্দাইল উপজেলার কৃষক মানিক বলেন, ‘ধারদেনা করে অপরের কিছু জমি চাষ করছিলাম। প্রতি ১০ শতাংশে দুই হাজার টাকা জমির মালিককেই দিতে হবে। এখন জমির মালিককেই কি দেব। পরিবার নিয়ে সারা বছর নিজেই কিভাবে চলব। নান্দাইল উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘মাঠ পর্যায়ে ঘুরে খোঁজ খবর নিচ্ছি। কোথাও আংশিক কোথাও সম্পূর্ণ রূপে ফসল নষ্ট হয়েছে। ঝড়ো হাওয়ায় এমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’

স্থানীয় কৃষকরা আরো বলেন, এবার উচ্চ ফলনশীল জাতের হাইব্রিড ধানের ফলন ভালো হয়েছিল। স্বল্প জীবনকাল(১৪০দিন) এবং খেতে সুস্বাদু ,বাজারে চাহিদা থাকায় বেশী করে বিআর ২৮ ও ২৯ ধানের চাষ করেছি। এখন দেখছি এই ধানগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যে অবস্থা দেখছি তাতে হতাশা বাড়ছে । যা খরচ করেছি তাই আসবে না।
তবে কৃষকদের চিন্তিত না হয়ে হিট শকের হাত থেকে ফসল রক্ষায় মনোযোগী হতে পরামর্শ দিয়েছে তারাকান্দা কৃষি অফিস। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কাওছার আহমেদ খাঁন বলেন, ধানে চিটা হবার পেছনে অন্যতম একটি কারণ হলো অসহনীয় তাপমাত্রা। যদি তাপমাত্রা কোন কারণে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার উপড়ে হয় তবে হিট শকে ধানে চিটা হতে পারে। ধানের পরাগায়নের সময় যদি ১/২ ঘন্টা এমন গরম বাতাস থাকে তবে ধানে চিটা হবেই। এর কারণ হলো প্রচন্ড গরম ঝরো বাতাসের কারণে গাছ থেকে পানি প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেড়িয়ে যায়। এর ফলে গর্ভধারণ,পরাগায়ণ ও চালের বৃদ্ধিতে সমস্যা হয়। গত কয়েকদিন আগে যে গরম বাতাস বয়ে গেছে, তাতে এমনটিই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।

জানা যায়, কোন কোন কৃষি কর্মকর্তা ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের এ অবস্থা থেকে উত্তোরনের জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের মতে, জমিতে সবসময় পর্যাপ্ত পানি রাখতে হবে। মিউরেট অব পটাশ সার ১০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম মিশিয়ে ৫ শতাংশ হিসেবে স্প্রে করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনে ম্যাটিভো ৬ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করার পরামর্শ দেন তিনি। এসময় তিনি আরও বলেন, রোরো ধানের জন্য এই সময়টা অত্যন্ত মারাতœক। এ সময়ে ব্লাস্ট সহ আরো অনেক রোগে বোরো ধান নষ্ট হতে পারে। তাই সরকারী কৃষি অফিসের পরামর্শ ও সহযোগীতা নিয়ে কাজ করা ভালো।
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাধন কুমার গুহ মজুমদার জানান, উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে প্রায় ৫শ হেক্টর বোরো ধানের সোনালি শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে এ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারন করেছে ৩শ হেক্টর।’ কিন্তু চাষিদের দাবি এ ক্ষতির পরিমাণ ৫শ হেক্টর ছাড়িয়ে যেতে পারে।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষক কর্মকর্তা ড. মোছা: নাসরিন আক্তার বানু জানান, চলতি রবি মৌসুমে এ জেলায় বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্র ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার এক’শ হেক্টর। এর মধ্যে হাইব্রীড জাতের ধান ছিল ৫৫ হাজার হেক্টর, ইফসি জাতের ধান ছিল ২ লাখ ৬ হাজার হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের (হরি, বিরই সহ ইত্যাদি) ধান ছিল এক’শ হেক্টর। তবে লক্ষ্য আরো বেশি অর্জিত হয়ে এ জেলায় মোট বোরো ধানের চাষ হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে।

ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, ‘অনাবৃষ্টি, খরা আর পরাগায়নের সময়ে গরম বাতাসে অতিমাত্রার হিটশকের কারণে ধানে চিটা হয়েছে। এ অবস্থায় ফসলি জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখা ছাড়া আর কোন পথ নেই। যে কোন মূল্যে জমি নিয়মিত পানি ধরে রাখতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রথম দিকে সরকারী হিসেবে ক্ষতির পরিমান ছিল ২৬শত হেক্টর। কিন্তু বর্তমানে এ ক্ষতির পরিমান দাড়িঁয়েছেন ৪ হাজার ২শত হেক্টরে।’

তবে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপচারিতায় অসংখ্য কৃষকদের দাবি, ময়মনসিংহ জেলার সবকটি উপজেলার প্রতিটি গ্রাম সরেজমিনে জরিপ করলে এ ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমপক্ষে ২০ হাজার হেক্টর বা তারও অধিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন