বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

দক্ষিণ চীন সাগরের অধিকার নিয়ে সংঘাতের আশংকা

প্রকাশের সময় : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
কয়েক দিন ধরে নানাবিধ সংবাদ মাধ্যম জানান দিয়ে চলেছে, ধরনীর একটি বিশেষ জলভাগ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই জলভাগ দক্ষিণ চীন দরিয়া অভিধায় সুপরিচিত, যদিও ভিন্নতর নামও আছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কূটনীতি, সামরিক স্পর্ধা, আস্ফালন, এসবে বলীয়ান হয়ে ওঠা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের এই জলভাগটি নিয়ে সোচ্চার ও প্রকট অধিকার ঘোষণার পাশাপাশি প্রতিস্পর্ধাস্বর শোনা যাচ্ছে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে। ভিয়েতনাম, ফিলিপিনস, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বক্তব্য চীনের দাবির বিপ্রতীপে অবস্থান করে। জলভাগটির ওপর সরাসরি রাষ্ট্রীয় দাবি-দাওয়া না রাখলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উন্মুক্ত সাগরে অবাধ গতিবিধির স্বাধীনতার প্রশ্ন তুলেছে। নানা আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীন এই বক্তব্য পেশ করেছে যে, দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর তার কর্তৃত্বের তত্ত্ব ও দাবির ভিত্তি খুঁজতে হবে ইতিহাসের আলোকে। ইতিহাসই নাকি দক্ষিণ চীন দরিয়ার ওপর চীনের বিশেষ অধিকারের উপযুক্ত সাক্ষ্য দেবে।
এই জটিল এবং বিতর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে আগে এলাকাটির ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিচয় নিয়ে কিছু আলোচনা করা দরকার। পৃথিবীর বৃহত্তম জলরাশি প্রশান্ত মহাসাগরের অন্তর্গত এই দক্ষিণ চীন দরিয়ার আয়তন ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটার। এটি চীনের মূল ভূখ-ের দক্ষিণে। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয় উপদ্বীপ ও সুমাত্রার পূর্বে এর অবস্থান। এর পূর্বতম সীমায় আছে ফিলিপিনস, দক্ষিণতম সীমায় আছে জাভা সমুদ্র এবং বেলিতুং দ্বীপ। এই বেলিতুংয়ের কাছে সমুদ্রগর্ভ থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে নবম শতকের এক জলযানের ধ্বংসাবশেষ। উত্তরতম সীমানা চিহ্নিত করছে তাইওয়ানের প্রণালী। যদিও দক্ষিণ চীন সাগর প্রশান্ত মহাসাগরের অংশবিশেষ তবুও ভারত মহাসাগরের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ থাকে মালাক্কা প্রণালীর মাধ্যমে। একটু ভিন্নভাবে বলা যায়, ভারত মহাসাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরের ভিতর এক যোগসূত্র তৈরি করে আছে দক্ষিণ চীন সমুদ্র। গোটা দুনিয়ার জাহাজ চলাচলের এক-তৃতীয়াংশই ঘটে এই সমুদ্রটির জলরাশির মধ্যে দিয়ে। জাপান, চীন এবং কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত, বাণিজ্যবিস্তারী দেশের জন্য অপরিহার্য জ্বালানির জোগানের এক বৃহদাংশ পশ্চিম এশিয়া থেকে জলপথে পরিবাহিত হয় দক্ষিণ চীন সাগর দিয়েই। তার ওপর ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ এই যে, সাগরটির গর্ভে রয়েছে পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল ভা-ার। তাই এই জলরাশির ওপর আগ্রহ চীনসহ আরও বহু দেশেরই। সাগরটির ওপর অধিকার কায়েম করতে পূর্ব এশিয়ার প্রায় কোনো রাষ্ট্রই পিছপা নয়। তার মধ্যে চীনের ক্ষমতা ও দাপট প্রতিবেশীদের তুলনায় অনেক বেশি। তাই তার দাবি-দাওয়াও সবচেয়ে সোচ্চার।
চীন এই দাবির পাশাপাশি ইতিহাসের নিরিখে বৈধতা প্রতিষ্ঠার অহরহ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চৈনিক-তথ্যসূত্রে এই সাগর নান্-হাই বা দক্ষিণ সাগর নামে পরিচিত। জলরাশিটির বাণিজ্যিক ইতিহাসে দীর্ঘমেয়াদি তাৎপর্য তুলে ধরেছিলেন ওয়াঙ্গ গঙ্গ, তার প্রসিদ্ধ গ্রন্থ দ্য নান্-হাই ট্রেড-এ। আর ভারত মহাসাগর হলো সি-হাই বা পশ্চিম সমুদ্র। নান্-হাই নামটি প্রাচীন চীনা সাহিত্যে সুপরিচিতও বটে। নান্-হাই নামক জলরাশিতে চীনের ইতিহাসাশ্রয়ী ভূমিকা অবশ্যই বিচার্য। তবে তার আগে খেয়াল রাখা উচিত, এই সাগরের আরও নাম আছে। সেই নামকরণ করেছে অন্যান্য দেশ। কম্বোডিয়ার তরফে তার নাম চম্পার সমুদ্র। কম্বোডিয়ার প্রাচীন চম্পা এলাকাও এই সমুদ্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক কারণে জড়িত। ভিয়েতনামের দিক দিয়ে তার অভিধা পূর্ব সাগর। নিছকই ভৌগোলিক বাস্তবতা মেনে এই নামকরণ। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া আবার এই জলরাশিকে চিহ্নিত করে বিয়েন দঙ বলে। ফিলিপিনসের কাছে এই সাগরের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় পশ্চিম ফিলিপিনস সাগর। অতি নিকট অতীতে এই অভিধাটি মানচিত্রে স্পষ্ট করে উল্লেখ করার নির্দেশ দিয়েছে ফিলিপিনো সরকার।
মানচিত্র তৈরি করে কোনো এলাকার ওপর ইতিহাসসম্মত মান্যতা দেবার তাগিদ জাতিরাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়। অতীতের ব্যাখ্যা দেবার জন্য যতটা, তার চেয়েও বেশি আগ্রহ জাতিরাষ্ট্রগুলোর তরফে দেখা যায় বর্তমানের কোনো নীতি বা পদক্ষেপকে বৈধতা দেবার উদ্দেশ্যে ইতিহাসকে ব্যবহার করার প্রয়াসে। সাম্প্রতিক ভারতীয় ইতিহাসচর্চাতেও এর নজির বেড়েই চলেছে। তবে নিছক ইতিহাসের তথ্যরাজি দেখলে মনে হয়, আলোচ্য জলরাশির নামকরণে চীনের অনুষঙ্গ অধিকতর পরিচিত। অবশ্য তার দ্বারা এই সাগরের ওপর চীনের বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক দাবির ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। চীনের সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে, তাতে এটুকু বোঝা যায়, চীনের সমাজ ও রাষ্ট্র পরদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য সমুদ্র ও উপকূলের দরজা কখনো হাট করে খুলেছে, আবার কখনো বা সমুদ্র থেকে নিজেকে হটিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ রেখেছে। একাদশ-দ্বাদশ শতক ধরে চীনে যখন সুং বংশের শাসন চলছিল, তখন এক উন্মুক্ত সাগর নীতি চোখে পড়বে। তারই সুবাদে আরবীভাষী মুসলমান বণিককুল, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণধর্মাবলম্বী ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা বণিক চীনের দরবারে হাজির হতেন। চোল, শ্রীবিজয়, পাগান দেশ থেকে কূটনৈতিক ও চীনে যেতেন নিয়মিত। আর চীনা তৈজস, বিশেষ করে চিনেমাটির বাসনপত্র-দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া, এমনকি ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাতে বহুল পরিমাণে পৌঁছতো সাগর পাড়ি দিয়েই। এই সমুদ্রবাহিত বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ে চীনের ভূমিকা যেমন স্মরণীয়, তেমনই তাৎপর্যপূর্ণ দক্ষিণ চীন দরিয়ার অবস্থান। তবে এই পর্যায়ে রাষ্ট্রের তরফে সাগর-শাসনের বাসনা, তার সমর্থনে তাত্ত্বিক কাঠামো প্রণয়ন এবং সর্বোপরি আগ্রাসী পদক্ষেপ নেবার নজির যৎসামান্য।
ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে চীন সমুদ্র বিষয়ে খানিকটা নিজেকে গুটিয়ে রাখার পর পনেরো শতকের প্রথম তিন দশক ধরে অভূতপূর্বভাবে সমুদ্রবিহারী হয়ে ওঠে। তখন চীনে মিং বংশের শাসন। চীনা সম্রাটের প্রত্যক্ষ মদদে ১৪০৪ থেকে ১৪৩৩ পর্যন্ত মহানাবিক জাংহার চেং হো বলেও বর্ণিত নেতৃত্বে চীনা নৌবহর দক্ষিণ চীন সাগরে অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় তো বটেই, দক্ষিণ চীন দরিয়া পেরিয়ে মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে জাং হা-র নৌবহর একাধিকবার আসে ভারত সাগরে। তার সুবাদে জাঙ্ক নামক বিশাল চীনা জাহাজগুলো ভেড়ে শ্রীলঙ্কায়, উপমহাদেশের কালিকটে, পূর্ব আফ্রিকা উপকূলের মালিন্দিতে, লোহিত সাগরের মুখে অবস্থিত এডেন বন্দরে এবং পারস্য উপসাগরের বন্দর হোরমুজে। মনে রাখা ভালো, চীনা নৌবহর এই বিস্তীর্ণ এলাকায় পাড়ি জমায় ভাস্কো ডা গামার অভিযানের অন্তত ৬৫ বছর আগে। এসব সত্ত্বেও কেন ডে ভান্কো ডা গামা এবং কলম্বাসের অভিযানকে ‘আবিষ্কারের যুগ’-এর সূচক ধরা হয়, লেখক সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘তা কেবল খোদায় মালুম’। মজার কথা, যেমন হঠাৎই চীনের এই সমুদ্রবিহারী রূপ প্রকট হয় পনেরো শতকের প্রথম তিন দশকে, তেমনই আচমকা চীনা নৌবহর ১৪৩৩-এর পর সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায়। আরও অর্ধ শতাব্দী এই নৌবহর যদি দক্ষিণ চীন সাগরে ও ভারত মহাসাগরে টহল চালাত, তা হলে জলভাগের ওপর ষোলো শতক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ইউরোপীয় দাপট আদৌ ঘটত কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
অনেক পুরনো আমলের কথা ওঠার কারণ, চীনের ঘোষিত নীতি ও দাবি। দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর তার অধিকার ঐতিহাসিক। বর্তমানের প্রয়োজনে অতীতকে অর্থাৎ ইতিহাসকে ব্যবহার/অপব্যবহার করার প্রবণতা জাতিরাষ্ট্রের মজ্জাগত, বিশেষত জাতিরাষ্ট্রটি যদি ক্রমান্বয়ে বলীয়ান ও উচ্চাশী হয়ে উঠতে থাকে। ২০০৪ সালে চীনের তরফে জাং হার অভিযানের ছ’শ বছর পূর্তি উদযাপিত হয় মহাসমারোহে। চীন বারবার দাবি করেছিল জাং হা তিন দশক ধরে বিস্তীর্ণ নৌ-অভিযান চালানো সত্ত্বেও পর দেশের সূচ্যগ্র মেদিনী দখল করেননি, বরং তৎকালীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সম্ভাবনা বহু গুণে বাড়িয়েছিলেন; তার নেতৃত্বে নৌ-অভিযানটি তাই সাগরে অবাধ স্বাধীনতা ও সমুদ্রবাহিত কূটনৈতিক মৈত্রী ও শান্তির দ্যোতক। কিন্তু জেফ ওয়েডের মতো চীনা ইতিহাসের বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ এই কীর্তিকীর্তনের ঘোর বিরোধী।
সমকালীন দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে জেফ ওয়েড বলতে চান, এই নৌবহর ব্যবহারের পিছনে আসল তাগিদ ছিল দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাপট প্রতিষ্ঠা; বিশেষ করে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রয়োগসহ সহিংস, জঙ্গি পদক্ষেপ নিয়ে মিং শাসক ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, আন্নাম, সুমাত্রাকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছিলেন, প্রতিবেশীদের দাবিয়ে রাখা এই তিন দশকব্যাপী নৌবহর ব্যবহারের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবহর সহিংস পদ্ধতি না-নিলেও ১৪১১-তে শ্রীলঙ্কার শাসককে গ্রেফতার করে চীনে পাঠিয়ে দেয়, তার সাক্ষ্যপ্রমাণও চীনা তথ্যসূত্রে ওয়েড দর্শিয়েছেন। তার ধারণায় জাং হার অভিযানে শান্তির ললিতবাণী বিশেষ নেই। মিং শাসক নৌ-অভিযান চালিয়ে অন্তত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায়-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন।
পূর্বোল্লিখিত ঐতিহাসিক পটভূমিতে বর্তমান অবস্থার সংক্ষিপ্ত সমীক্ষা করা যায়। উৎপাদন ব্যবস্থায়, বিপণন প্রক্রিয়ায়, সমরসজ্জায় বর্তমানে চীন তার প্রতিবেশীদের তুলনায় বহু প্রাগ্রসর। হালফিল দুনিয়ার ওপর অন্তত কূটনৈতিক ও আর্থিক আধিপত্য বিস্তারেও তার আগ্রহ কম নয়। এই প্রেক্ষিত থেকে দক্ষিণ চীন দরিয়ার ওপর চীন তার ঐতিহাসিক সম্পর্কের দাবিতে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী। এই সমুদ্রে আছে বহু দ্বীপ। তার বেশির ভাগই জনবসতিহীন। এই দ্বীপগুলোকে জনঅধ্যুষিত করার তাগিদে চীন ইতোমধ্যেই ২৯০০ একর জমি নিজের আওতায় এনেছে। এই প্রবণতায় প্রমোদ গুনছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, প্রশান্ত মহাসাগরে যাদের কায়েমি স্বার্থ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের মতো মার্কিনদের বিশেষ অধিকারের কোনো দাবি বা তত্ত্ব নেই। কিন্তু তারা অবাধ, উন্মুক্ত সাগরে অব্যাহত গতিবিধির নীতি প্রতিষ্ঠায় চীনের অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন।
চীনের আস্ফালনে ও দক্ষিণ চীন দরিয়ায় নিয়মিত চীনা নৌবাহিনীর মহড়ায় ত্রস্ত হয়ে ফিলিপিনস জাতিসংঘের সামুদ্রিক আইনবিষয়ক যে কনভেনশন আছে, তার কাছে ২০১৩ সালে চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিল। পাল্টা জবাবে চীন ১৩৯০০ শব্দের একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে ফিলিপিনসের বক্তব্যকে অসত্য ভাষণ, বিকৃত তথ্য, আইনের অপব্যাখ্যা বলে নস্যাৎ করে দেয়। পাশাপাশি চীন দক্ষিণ চীন দরিয়ায় নৌবহরকে সক্রিয় রেখে দিয়েছে। মার্কিন রণতরীর সঙ্গে তার সংঘাতের উপক্রম ঘটলেও শেষ পর্যন্ত তা এড়ানোও গিয়েছে। দুই তরফেই হুঁশিয়ারি দেওয়া এখন পর্যন্ত অব্যাহত। আজ থেকে কয়েক সপ্তাহ আগে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালত সমুদ্র আইনের ভিত্তিতে জাতি তাদের স্থায়ী সালিশীতে চীনের বিপক্ষেই রায় দিয়েছে। অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের বিশেষ কোনো অধিকার নেই। এই জলরাশির ওপর চীনের ঐতিহাসিক অধিকারের দাবিরও যে কোনো ভিত্তি নেই, তাও জাতিসংঘের রায়ে ঘোষিত। চীন স্বভাবতই এই রায়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। চীনা সরকারি সংবাদ মাধ্যমে এই রায়কে বলেছে, একটি বাজে কাগজ, গোল্লায় যাওয়াই যার একমাত্র ভবিতব্য। এই জলরাশিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ, সংকট ও আগামী দিনে সংঘর্ষের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, এশিয়া অঞ্চলের অন্যান্য দেশ আন্তর্জাতিক আইনের পথে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট নিরসনের পক্ষপাতী। অন্যদিকে, চীনের এই দাপটের সামনে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ভিয়েতনাম। ভিয়েতনাম ইদানীং মার্কিন মদদের পানে চেয়ে আছে। যে মদদে ভিয়েতনাম আশা করে আঞ্চলিক শক্তিসাম্য বজায় থাকবে। ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের লজ্জাজনক ইতিহাস ভিয়েতনাম কি নিজেই শিকেয় তুলে রাখল? সমুদ্র শাসনের দাপট সমেত চীনের দাপটের আশঙ্কায় ভিয়েতনাম হয়তো ক্রমাগত মার্কিনের মুখাপেক্ষী হয়ে উঠবে। ভিয়েতনাম যে চীনের স্পর্ধিত সমুদ্র অবস্থানের বিরোধিতা করছে, এই সম্ভাবনা মাথায় রেখে অতিসম্প্রতি ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে আগ্রহ দেখিয়েছে। লক্ষণীয়, এখানেও দক্ষিণ চীন দরিয়া জড়িত আছে। ২০১১-তে ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগরে ভূগর্ভস্থ তেল অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। চীনের তরফে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এসেছিল, বিশেষত প্রশ্ন উঠেছিল। এই সমুদ্রে ভারতীয় ক্রিয়াকর্মের কোনো এখতিয়ার আছে কিনা। কিন্তু ভিয়েতনাম ১৯৮২ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক আইনের সাহায্যে চীনের আপত্তিকে খারিজ করে দেয়। ইদানীং ভারত-রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে বানানো ব্রহমোস ক্ষেপণাস্ত্র ভিয়েতনামকে বিক্রি করতে ভারত উদ্যোগী হয়েছে। ভিয়েতনাম এই ব্যাপারে ২০১১ থেকেই আগ্রহী, কিন্তু চীনের তরফে এতে বিরাগ উপস্থিত হবে এই অনুমানে ভারত কিছুটা দোনামোনা করেছিল। এই দোলাচল কাটিয়ে ভারত ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করার জন্য যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, তা সম্ভবত চীনের ওপর চাপ বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই। দক্ষিণ চীন দরিয়াতে আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে ভারত হয়তো ভিয়েতনামকে এক পাল্টা শক্তিস্থল হিসেবে দেখতে চায়।
ভারত এই জাতীয় মনোভাব ও পদক্ষেপ নিলে সবচেয়ে স্বস্তি পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও দাপট বৃদ্ধির কারণে এশিয়াতে নির্ভরযোগ্য মিত্র খোঁজায় মার্কিনের আপন স্বার্থ অত্যন্ত সক্রিয়। এই রকম অনুগত মিত্র হিসেবে মার্কিন মহল দীর্ঘদিন পাকিস্তানকে পাশে পেয়েছে। কিন্তু চীনের প্রশ্নে পাকিস্তানের সমর্থন পাওয়া আমেরিকার পক্ষে কার্যত অসম্ভব। তাই ভারত সম্বন্ধে সদর্থক মনোভাব এখন ক্রমশ প্রকাশ্য। এশিয়ায় আগামী দিনে দুই মহাশক্তিধর দেশ হিসেবে চীন ও ভারতের উঠে আসার দিকে অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ অসংখ্য সমস্যা ও প্রতিকূলতার মোকাবিলা না করে দক্ষিণ চীন দরিয়ায় অত্যুৎসাহী নাক গলানো সমীচীন হবে কিনা, সেটা একটা বড় বিবেচ্য।
তবে এই অত্যন্ত জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে চাকা হঠাৎ হঠাৎ কোন দিকে ঘুরবে তার আগাম হদিস পাওয়া বেশ শক্ত। সাম্প্রতিকতম খবর হলো, বিতর্কিত দক্ষিণ চীন দরিয়ায় চীন ও রাশিয়া যৌথ নৌবহর মহড়া চালাবে। চীনের সঙ্গে রাশিয়ার নানা আকচা-আকচি অজানা নয়। এতদসত্ত্বেও এই দুই শক্তির দক্ষিণ চীন-সাগরে হাত মেলাতে চাইছে। হয়তো দুই শক্তির ধারণা, আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্র আইনের যে রায় ফিলিপিনসের পক্ষে গেল, তার নেপথ্যে মার্কিন মদদও হাত আছে। এই যৌথ মহড়া চালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আপসহীনতার বার্তা পাঠানোই হয়তো এর প্রধান উদ্দেশ্য।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন