রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ১৪ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

খোশ আমদেদ মাহে রমজান। রহমতের মাস, মাগফেরাতের মাস, নাজাতের মাস, বরকতের মাস, সিয়ামের মাস, কিয়ামের মাস, লাইলাতুল কদরের মাস, নুযুলে কুরআনের মাস, আসমানী কিতাবসমূহ নাযিল হওয়ার মাস, তারাবির মাস, তাসাবির মাস, তাকোয়া অর্জনের মাস, জঙ্গে বদর, ফতহে মক্কার মাস, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাসিলের মাস, সবরের মাস, সহানুভূতির মাস, জান্নাত হাসিলের মাস মাহে রমজান তোমাকে স্বাগত।

আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মোবারক মাস প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করেছেন। আমাদের পরম সৌভাগ্য, সেই মহানিয়ামতপূর্ণ মাহে রমজান আমাদের দ্বারে উপস্থিত। আমরা এর শোকর আদায় করব, এর যথাযথ কদর করব। এ মাসের করণীয়গুলো অপূর্ব নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সম্পাদন করব, বর্জণীয়গুলো সর্বাত্মকভাবে পরিহার করব, এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণগুলোর অনুশীলন করে সত্যিকার মানুষ, খাঁটি মোমেন হিসাবে নিজেদেরকে গড়ে তুলব, এর আলোকে বাকি এগারো মাসও পরিচালিত হবো- এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

মাহে রমজান এলে বেহেশতে সাড়া পড়ে যায়। বায়হাকী শরীফে বর্ণিত এক হাদিসের মর্মে জানা যায়:
রমজান মোবারক করিতেই শুভ আগমন
জান্নাতে বহিয়া যায় সুরভিত ¯স্নিগ্ধ সমীরণ
খুলে দেয়া হয় তার যত সব অবরুদ্ধ দ্বার
গায় আগমনী গান সুকণ্ঠী হুরেরা অনিবার
পরম আনন্দভরে ঘোষণা করেন রেদোয়ান
ধরণীর বুকে আজ শুরু হলো মাহে রমজান।

রমজানুল মোবারক পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়ার মাস। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজান ও রোজার হুকুম-আহকামের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেন: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে। যে রূপ ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপরে, যেন তোমরা মোত্তাকী হতে পার। রোজা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনের জন্য। তোমাদের মধ্যে কেউ পীড়িত হলে বা সফরে থাকলে অন্য সময়ে তার এ রোজাগুলো আদায় করে নিতে হবে। আর এটি যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হয় তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খাদ্যদান করবে। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেককাজ করে তা তার জন্য অধিক কল্যাণকর হয়। আর রোজা রাখাই তোমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর। যদি তোমরা জানতে। রমজান মাস হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, যা হচ্ছে মানুষের দিগ-দিশারী ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে সে যেন অন্য সময়ে এর সংখ্যা পূরণ করে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য কঠিনতা চান না। এ জন্য যে, তোমরা সংখ্যা পূরণ করবে এবং তোমাদেরকে সৎপথে পরিচালনা করার জন্য তোমরা তাঁর মহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।’ (সূরা বাকারা: আয়াত: ১৮৩ ও ১৮৪)

কেবলমাত্র পবিত্র কুরআনই এই মাসে নাযিল হয়নি, অন্যান্য আসমানী কিতাব ও সহিফাও এ মাসেই নাযিল হয়েছে। মসনদে আহমদে হযরত ওয়াসেলা সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘হযরত ইবরাহীমের সহিফা রমজানের ১ তারিখে, তাওরাত ১৩ তারিখে, ইনজিল ২৪ তারিখে নাযিল হয়েছে। অন্য এক সূত্রে বর্ণিত আছে যে, যবুর রমজানের ১২ তারিখে নাযিল হয়েছে।’

অনুধাবন করার বিষয় যে, আল্লাহ সুবহানুহু তাআলা বান্দাদের প্রতি তাঁর হেদায়েতের ফরমান প্রেরণের জন্য যে পবিত্র মাহে রমজানকে বেছে নিয়েছেন, তার গুরুত্ব ও ফযীলত কত বেশি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হাশর দিনের মহাসঙ্কট-কালে রোজা এবং কুরআন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সমীপে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে প্রভু আমি তাকে দিনের বেলায় আহার ও ভোগ-লালসা থেকে ফিরিয়ে রেখেছিলাম, অতএব তার ব্যাপারে আপনি আমার সুপারিশ কবুল করুন। আর কুরআন বলবে, আমি রাতে তাকে ঘুমুতে দিইনি (তিলাওয়াতে মশগুল রেখেছি) তাই তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কুবুল করুন। তাদের উভয়েরই সুপারিশই কবুল করা হবে।’ (আহমাদ)

রমজাননের সাথে পবিত্র কুরআনের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। কারণ, কুরআনও নাযিল হয়েছে মাহে রমজানেই। (প্রথম পর্যায়ে লওহে মাহফুজ থেকে সম্পূর্ণ কুরআন প্রথম আসমানে। সেখান থেকে আল্লাহর হাবীবের কাছে জাবালে নূরের হেরা গুহায় সূরা আলাকের প্রথম ৫ আয়াত, পরে ক্রমান্বয়ে ২৩ বছরে সম্পূর্ণ কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে)। জিব্রাইল আমীন আ. রমজানের প্রতি রাতে সে যাবত নাযিলকৃত অংশ তিলাওয়াত করে আল্লাহর হাবীবকে শুনাতেন, আর আল্লাহর হাবীব শুনাতেন জিব্রাইল আ.কে। নবীজীর ইন্তেকালের বছর জিব্রাইল আ. দু’দুবার পূর্ণাঙ্গ কুরআন তিলাওয়াত করে নবীজী সা. কে শুনান এবং নবীজীও তাকে দু’বার তিলাওয়াত করে শুনান। এ ছাড়াও নবীজী সা. অন্যান্য মাস থেকে রমজানুল মোবারকে বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। প্রতি রমজানে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ মসজিদে তারাবিহের জামাতে ও তাহাজ্জুদের নামাযে হাফেজ সাহেবগণ লক্ষ লক্ষ বার কুরআন খতম করে থাকেন।

পবিত্র কুরআনের প্রতি আল্লাহর নেক বান্দাদের কী যে মুহব্বত ও গভীর সম্পর্ক ছিল আর তাঁরা কত অধিক পরিমানে যে কুরআন তিলাওয়াত করতেন তা ভাবলে বিস্ময়াভিভুত হতে হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. রমজানুল মুবারকে প্রতি তিন দিনে এক খতম করে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। হযরত ইমাম মালেক র. রমজান মুবারকে শুধু কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। অনরূপ এ পবিত্র মাসে সুফিয়ান সাওরী র.ও কুরআন তিলাওয়াতে ব্যাপৃত থাকতেন। আমাদের মহান ইমাম হযরত আবু হানিফা রহ. পবিত্র রমজানের প্রতি রাতে নফল নামাজে দু’খতম করে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। এ ভাবে তিনি রমজানের চন্দ্র উদয় হতে ঈদুল ফিতরের চন্দ্র উদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৬২ খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। (তারিখে বাগদাদ)। ইমাম বুখারী রহ. রমজানে প্রতি রোজ ১ খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আবার তিনি এ মাসের প্রতি তিন দিনে নামাজে দাঁড়িয়ে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ওলী আল্লাহদের মধ্যে আরও অনেকে পবিত্র রমজান কুরআন তিলাওয়াত ও নফল ইবাদত-বন্দেগীর মধ্যদিয়ে কাটিয়ে গেছেন। তাঁরা এ মাসের একটি মুহূর্তও বৃথা যেতে দেন নি।

প্রখ্যাত হাদীস গ্রন্থ বায়হাকী শরীফে হযরত সালমান ফারসী রা. বর্ণিত একটি হাদীসে আছে তিনি বলেন: ‘হযরত রাসূলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসের শেষদিনে প্রদত্ত এক খুতবায় বলেন: হে লোক সকল এক মুবারক মাস তোমাদের উপর ছায়া বিস্তার করছে (রমজান মাস)। এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যে রাত (এক রাতের ইবাদত) হাজার মাসের (ইবাদতের) চেয়েও উত্তম। এ মাসে আল্লাহপাক (দিবাভাগে) রোজা রাখা ফরজ করেছেন এবং রাতে জাগ্রত থেকে (তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া) সুন্নত করেছেন। অন্যান্য মাসে একটি ফরয আদায় করলে যে সওয়াব পাওয়া যায়, এ মাসে একটি নফল আদায় করলে সেই পরিমান সওয়াব পাওয়া যায়। এটি হলো সবরের (ধৈর্য্যরে ও সংযমের) মাস আর সবরের পুরস্কার হলো জান্নাত। এ মাস হলো পারস্পরিক সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশের মাস। এ মাসে মুমিন বান্দার রিযক বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি এক জন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার গুনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে সে পরিত্রাণ পাবে। আর সে ঐ রোজাদার ব্যক্তির রোজার সম পরিমাণ সওয়াব লাভ করবে, এতে ঐ রোজাদারের সওয়াব মোটেই হ্রাস পাবে না। এ কথা শুনে আমরা আরয করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমাদের সকলেরই তো রোজাদারকে ইফতার করাবার সামর্থ্য নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহপাক এ রূপ সওয়াব ঐ ব্যক্তিকে দান করবেন যে কোনো রোজাদারকে একটু দুধ বা একটি খেজুর অথবা শুধু এক পিয়ালা পানি দ্বারা ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়াবে আল্লাহপাক তাকে আমার হাওযে কাওসার থেকে এমন শরবত পান করাবেন যে, সে বেহেশতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত আর পিপাসার্ত হবে না। এ মাসের প্রথমভাগ রহমতের, মধ্যভাগ মাগফিরাতের এবং শেষভাগ জাহান্নাম থেকে মুক্তির। যারা এ মাসে দাস-দাসীদের (কর্মচারী) প্রতি সদয় হয়ে তাদের কার্যভার লাঘব করে দেবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে মাফ করে দেবেন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত দেবেন।’ (বায়হাকী)
রমজ থেকে রমজান অর্থাৎ পুড়িয়ে দেয়া। আর সওম ( রোজা) শব্দের অর্থ বিরত থাকা। কবির ভাষায় :

রীপু-তাড়নায় মানুষ করেছে যে পাপ সঞ্চায়ন
বহিতে বহিতে সে বোঝার ভার নুয়ে আসে দেহ মন
রমজান আসে পোড়াতে সে বোঝা পাপের আবর্জনা
মানব-হৃদকে করিতে শুদ্ধ, জাগাতে সংবেদনা।

রমজানের মাহাত্ম্য, গুরুত্ব, ফজিলত, শিক্ষা ও তাৎপর্য সম্পর্কে হাদীস আছে বহু। তার মধ্য থেকে মাত্র কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে। যেমন:

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মানব সন্তানের প্রত্যেকটি নেক আমলের সওয়াব ১০ হতে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হবে। আল্লাহপাক বলেন এ হচ্ছে রোজা ছাড়া অন্য নেক আমলের ক্ষেত্রে কিন্তু বান্দা কেবলমাত্র আমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রোজা রাখে পানাহার-ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করে তাই রোজার পুরস্কার আমি নিজ হাতে বান্দাকে দেব।’ মুহাদ্দিসগণের কেউ কেউ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, বেহেশতে যাওয়ার জন্য যতটা সওয়াব প্রয়োজন হবে ততটা সওয়াব রোজাদারকে দান করে বেহেশতে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে। আল্লাহর হাবীব এ হাদীসে আরও বলেছেন: ‘রোজাদারদের জন্য রয়েছে দু’টি আনন্দ: একটি সে ইফতারের সময় লাভ করে আর একটি লাভ করবে বেহেশ্তে আল্লাহর দীদার পেয়ে।’

আল্লাহ পাকের দীদার, সাক্ষাত বা দর্শন লাভ করা দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় নিয়ামত হতে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এ হাদীসে আল্লাহর হাবীব সা. আরও বলেছেন: ‘নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের ঘ্রান আল্লাহ পাকের নিকট মিশ্ক অর্থাৎ মৃগণাভী-কস্তরির চেয়েও অধিক পছন্দনীয়’। ‘রোজা হচ্ছে (শয়তানের ফেরেব ও রীপুর তাড়না হতে রক্ষা পাওয়ার) ঢাল’। (বুখারী)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে আল্লাহপাক তার অতীত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সওয়াব পাবার আশায় রাত জেগে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের নামায পড়বে আল্লাহপাক তার অতীতের পাপরাশি মার্জনা করে দেবেন। যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সওয়াবের নিয়তে রাত জেগে ইবাদত করবে আল্লাহপাক তার অতীত দিনের গুনাহসমূহ মাফ করে দেবেন।’ (বুখারী ও মুসলিম)

রমজান হচ্ছে ‘শাহরুল মাওয়াসাত’- অর্থাৎ পারস্পরিক সহমর্মিতা, সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশের মাস। দিবাভাগে অনাহারি থাকার দরুন ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ক্ষুধা তৃষ্ণার কী যে জ্বালা তা অন্তত কিছুটা অনুভব করতে পারে। তাই ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা’ সে সব ক্ষুধার্ত, নিরন্ন, বুভুক্ষ, অভাবগ্রস্থ মানুষদের কী যে কষ্ট তা অনুভব করে সে কষ্ট লাঘবের জন্য সচেষ্ট হওয়া রোজার অন্যতম শিক্ষা। এ শিক্ষা যেন আমরা লাভ করতে পারি। আমাদের অনেকেরই দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। সমাজে এখনও হত দরিদ্র লোকের অভাব নেই। বিশেষ করে এ বছর করোনা ভাইরাসের মারাত্মক ছোবলের কারণে ‘যারা দিন আনে দিন খায়’ এমন লোকেরা কর্মহীন, অসহায় হয়ে পড়েছে।

‘মাওয়াসাতের’ শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের দুর্দশা লাঘবে সক্রিয় হতে পারলে রোজার শিক্ষা অনেকটা সার্থক হবে।
বস্তুত রমজান হচ্ছে প্রশিক্ষণের মাস। এই প্রশিক্ষণ তাকোয়া-পরহেজগারীর, সংযম অর্জনের; শয়তান ও কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের; ধৈর্য-সবর ও শুকুরের গুণে গুণান্বিত হওয়ার; পারস্পরিক সহানুভূতি, সমবেদনা, সহমর্মিতার গুণাবলী হাসিল করার। রমজানের পরের ১১ মাসও যদি আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে, সকল কথা ও কাজে তা’ ভাস্বর হয়ে ওঠে তা হলেই বুঝব রোজা আমাদের জীবনে সফল হয়েছে। অন্যথা, আমরা ব্যর্থ হয়েছি ধরে নিতে হবে।

অপর এক হাদীসে আছে, একদা রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববীতে মিম্বরে উঠছিলেন, এ সময় জিবরাইল আ. এসে তিনটি বদদোয়া করলেন, আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমীন। সাহাবায়েকেরাম এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন (তার একটি হলো), জিব্রাইল বলেছেন: যে ব্যক্তি রমজান পেল অথচ গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারল না সে ধ্বংস হোক। আমি তখন বললাম, আমীন।

আল্লাহর হাবীব বলেছেন: রমজানে (আল্লাহর হুকুমে) একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে ‘হে নেককার লোকেরা! নেককাজে অগ্রসর হও, হে বদকার লোকেরা! বদকাজ থেকে বিরত হও’। (তিরমিযী)

আল্লাহু হাযিরী, আল্লাহু নাযিরী, আল্লাহু শা-হেদী, আল্লাহু মায়ী- অর্থাৎ আল্লাহ আমার সামনে হাযির আছেন, আল্লাহ আমাকে দেখছেন, আল্লাহ আমার কার্যাবলী প্রত্যক্ষ করছেন, আল্লাহ আমার সঙ্গেই আছেন; আমার উপর-নিচ, সমুখ-পিছন, ডান-বাম, ভেতর-বাহির- সব কিছু আল্লাহর অসীম ও প্রত্যক্ষ দর্শন-শ্রবণ শক্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত। রোজাদারের মাঝে এ ভাব সদা জাগ্রত থাকে বলেই সে ক্ষুধার্ত, সুস্বাদু খাবারও সামনে মওজুদ, অথচ সে খায় না। সম্ভোগ আকাক্সক্ষা, কাম-কামনা বৃত্তির তাড়া জেগে উঠলেও এবং তা পূরণের সর্বসুযোগ অবারিত থাকলেও রোজা অবস্থায় তা চরিতার্থ করে না। প্রশ্ন হলো, যে ব্যক্তি আল্লার এই অসীম শক্তিতে বিশ্বাস করে এসব থেকে বিরত থাকে, সে ব্যক্তির পরিমাপে কম দেয়া, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয়া, পরস্ব হরণ করা, সুদ, ঘুষ খাওয়া, পরের হক নষ্ট করা ইত্যাদি পাপ কার্যাবলী কি আল্লাহপাক দেখেন না? তার এই দর্শন শ্রবণ পত্যক্ষকরণ কি কেবল রোজার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ? তবে কেন রোজা রেখেও অনেকে এসব করে? প্রিয় নবী সা. এই অনুষ্ঠান সর্বস্বতা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি (এরূপ) মিথ্যাচার পরিত্যাগ করে না তার রোজা আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করেন। তা হয় ব্যর্থতায় পর্যবেশিত।’ (বুখারী)

তিনি আরও বলেছেন, ‘কতক রোজাদারের রোজা এমন- যা শুধু ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কষ্ট ভোগই সার। আর কতক নামাযীর নামায এমন, যা কেবল রাত্রি জাগরণই সার।’ (বুখারী ও মুসলিম) অর্থাৎ অনুষ্ঠান সর্বস্ব নামায রোজার দ্বারা কোনই সওয়াব পাওয়া যায় না।

রমজানুল মোবারকের আকর্ষণীয় তোহফা হলো লাইলাতুল কদর। এটি কুরআন নাযিল শুরুরও রাত। পূর্ববর্তী উম্মতগণ হায়াত পেতেন অনেক বেশি। তাই তারা ইবাদত-বন্দেগীর সুযোগও পেতেন বেশি। তাদের তুলনায় আমাদের হায়াত অনেক কম, ইবাদত বন্দেগীর সুযোগও অনেক কম। নেকের প্রতিযোগিতায় আমরাতো তাদের থেকে পিছে পড়ে যাব। এ ব্যাপারে উম্মত দরদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তান্বিত হন। তখন পরম দয়ালু আল্লাহ সূরা কদর নাযিল করে জানিয়ে দেন: ‘আমি লাইলাতুল কদরে কুরআন নাযিল করেছি। এ রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।’ অর্থাৎ অন্যান্য যমানার উম্মতগণ হাজার মাস (৮৪ বছর ৪মাস) নিরবিচ্ছিন্ন ইবাদত করে যে সওয়াব লাভ করত, উম্মতে মুহাম্মাদী তার চেয়ে বেশি সওয়াব লাভ করতে পারবে কেবলমাত্র কদরের একটি রাতের ইবাদতের মাধ্যমে। তাই আমাদের সচেতন হতে হবে যেন এ সুযোগ হেলায় না হারাই।

রমজান যেমন আভ্যন্তরীন দুশমন, যথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মাৎসর্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাস- তেমনি দৃশ্যমান দুশমন কাফির শক্তির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করে বিজয় অর্জনের মাস। ১৭ রমজান অনুষ্ঠিত হয় জঙ্গে বদর। প্রায় নিরস্ত্র মুষ্টিমেয় মুসলিম ফৌজের কাছে চরম পরাজয় বরণ করে বিপুল অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত বিশাল কাফির বাহিনী। রাষ্ট্র শক্তি রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ইসলাম। আর এক ১০ রমজানে অর্জিত হয় ‘ফতহে মুবীন’- মক্কাবিজয়। এর দ্বারা ইসলাম আত্মপ্রকাশ করে আন্তর্জাতিক শক্তি রূপে। আমরা যদি পবিত্র রমজানের শিক্ষা উত্তম রূপে গ্রহণ করতে পারি তবে সেই হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবো। আল্লাহ বলেন: ‘তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখিতও হয়ো না, বিজয় তোমাদের হবেই, যদি তোমরা মোমেন হও’। (সূরা আর ইমরান: আয়াত: ১৩৯)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন