বিলুপ্তপ্রায় কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম জাতের ধান
নজির হোসেন নজু, সৈয়দপুর (নীলফামারী) থেকে
সৈয়দপুরে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম জাতের ধানের আবাদ ফিরিয়ে আনতে ও ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক বিশেষ পদ্ধতিতে পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করা হচ্ছে। উপজেলার ১ নম্বর কামারপুকুর ইউনিয়নের অসুরখাই গ্রামে সজীব সীড্স নামে স্বনামধন্য একটি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ জৈব কৃষি প্রযুক্তিতে ওই পরীক্ষামূলক চাষের তিনটি প্রদর্শনী প্লট করেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম জাতের ধান চাষের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এধানের জাতগুলো চাষাবাদ করে কৃষকরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলন এবং ভালো দাম পেতেন। কিন্তু আজ কালের বির্বতনে উল্লিখিত জাতের ধানগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে হাঁটছে। নতুন নতুন ধানের জাত উদ্ভাবনের ফলে বর্তমানে পুরাতন জাতের ধান চাষাবাদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার সজীব সীড্স নামের একটি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তপ্রায় জাতের ধানের চাষাবাদ ফিরিয়ে আনতে এবং ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ওই প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী এক বিশেষ পদ্ধতিতে বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম ধান প্রদর্শনী প্লট করেছে। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগে “জধরংবফ নবফ ঋঁৎৎড়ি ্ ঞরিহ ঢ়ষধহঃধঃরড়হ ঞবধপযহরয়ঁব” ঞড় ওহপৎবধংব ুরবষফ. নতুন এ পদ্ধতিতে উল্লিখিত তিন জাতের ধানের চাষ করা হয়েছে এবারের চলতি আমন মৌসুমে। এ পদ্ধতির উদ্ভাবক হচ্ছে ঞ. শধঃধুধসধ. ওই জাপানিজ শস্য বিজ্ঞানী ১৯৫১ সালের এই পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেন। চাষাবাদের এ পদ্ধতি উদ্ভাবনকালে তিনি একটি ধানের চারা জমিতে লাগানোর পর ৮৪টি কুশি পান। ফলনও মেলে আশানুরূপ। সজীব সীড্স নামের প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী মো. আহসান-উল-হক বাবু জানান, ইন্টারনেটে কৃষিবিষয়ক ওয়েবসাইট থেকে “জধরংবফ নবফ ঋঁৎৎড়ি ্ ঞরিহ ঢ়ষধহঃধঃরড়হ ঞবধপযহরয়ঁব” ঞড় ওহপৎবধংব ুরবষফ. পদ্ধতি খুঁজে পান তিনি। সেটি ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে তা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে অধ্যয়ন করেন। পরবর্তীতে তিনি সে অনুযায়ী আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম জাতের ধান চাষাবাদের মনোস্থির করেন। যেই চিন্তা, সেই কাজ। তিনি বীজ সংগ্রহে নেমে পড়েন। সিলেটের এবি কৃষি প্রকল্প এবং ঢাকার গীতাঞ্জলী অর্গানিক নামের অপর একটি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বিলুপ্ত জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করেন বলে তিনি জানান। সিলেটের এবি কৃষি প্রকল্প নামের প্রতিষ্ঠানটির মালিক হচ্ছেন আব্দুল বাছিত সেলিম। সংগৃহীত বীজ বপনের ১৪ দিনের মধ্যে তা জমিতে লাগানো হয়। তিন জাতের ধানের চারা ৫৫ শতক নিজের জমিতে লাগান আহসান-উল-হক। এর মধ্যে কাটারিভোগ ১৫ শতক, কালিজিরা ১৫ শতক ও বালাম ২৫ শতক জমিতে লাগানো হয়েছে। গত ২২ জুন বীজতলা থেকে তুলে জমিতে ওই চারা লাগানো হয়। একটি করে “জধরংবফ নবফ ওপর সারিবদ্ধভাবে চারা লাগানো হয়েছে। বেডের সাইজ প্রস্থে ৩ ফুট। একটি সারি থেকে অপর সারির দূরত্ব ১ দশমিক ৮ ফুট। চারা থেকে চারার দূরত্ব ১ দশমিক ৩ ফুট। রোপণের সময় “জধরংবফ নবফ ওপর একটি করে চারা লাগানো হলেও ইতোমধ্যে একটি চারা থেকে কাটারিভোগ ও কালিজিরা জাতে সর্বোচ্চ ১৫২টি কুশি এবং বালাম জাতে ১২২টি কুশি বের হয়েছে। এ প্রদর্শনী প্লটে বায়োগ্যাস স্লারী, মেহগনি খৈল, ভার্মি কম্পোট, হাড়ের গুঁড়া প্রয়োগ করা হয়। এছাড়াও স্বল্প পরিমাণে প্রয়োগ করা হয় ডিএপি, এমওপি এবং ইউরিয়া সারও। চারা রোপণের ১৪০দিন থেকে ১৪৫ দিনের মধ্যে ধান কেটে ঘরে তোলা যাবে এবং ফলনও মিলবে আশাতীত। “জধরংবফ নবফ এর ফাঁকা জায়গায় সেচ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নিচু জায়গায় অ্যাজোলা দেয়া হয়েছে। অ্যাজোলা মূলত উদ্ভিদের এক ধরনের খাবার। ময়লাযুক্ত পানিতে অ্যাজোলা জন্মলাভ করে। অ্যাজোলায় উদ্ভিদের ১৪টি খাদ্য উপাদান বিদ্যমান। অ্যাজোলা প্রাকৃতিকভাবে নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে ওই নাইট্রোজেন ফসলে খাবার হিসেবে যোগান দেয় বলে কৃষি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। সজীব সীড্স’র স্বত্বাধিকারী মো. আহসান-উল-হক জানান, তার মূল উদ্দেশ্য বিলুপ্ত জাতের ধান চাষাবাদ ফিরিয়ে আনা। তাছাড়াও আধুনিক এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে বেশি ফলনের পাশাপাশি তিনি বীজ সংরক্ষণ করে তা সাধারণ কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান। যাতে করে এ অঞ্চলের চাষিরা আবারো উল্লিখিত ঐতিহ্যবাহী জাতের বিলুপ্তপ্রায় ধান চাষের প্রতি বেশি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেন। এদিকে, গত ২৫ আগস্ট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) কৃষিবিদ মো. হামিদুর রহমান সজীব সীড্স’র কাটারিভোগ, কালিজিরা ও বালাম জাতের ধানের প্রদর্শনী প্লট পরিদর্শন করেছেন। তিনি বিলুপ্তপ্রায় জাতের ধানের চাষাবাদ দেখে মুগ্ধ হন এবং এর উদ্যোক্তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর পরিদর্শনকালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কৃষিবিদ শাহ্ আলম, রংপুরের তাজহাট কৃষি ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ কৃষিবিদ মো. মনিরুজ্জামান, নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক (ডিডি) কৃষিবিদ মো. আফতার হোসেন, সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোছা. হোমায়রা ম-ল হিমু, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বাসুদেব দাস ও আসাদুজ্জামান আশা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন