এক বছর পর ত্যাগের অনুপ্রেরণা ও খুশির বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে কোরবানির ঈদ বলে পরিচিত ঈদুল আজহা। আগামীকাল পূর্ণ মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে সারাদেশে উদযাপিত হবে ঈদুল আজহা। আরবী ঈদ শব্দের অর্থ আনন্দ, খুশি, উৎফুল্লতা ইত্যাদি। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ঈদ নিছকই আনন্দ, খুশি বা উৎফুল্লতা নয়। এর সঙ্গে আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক দিকও ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। ঈদুল আজহা মহান আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ ও আত্মত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। পশু কোরবানির মাধ্যমে মহামহিম আল্লাহর নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও তার সন্তুষ্টি অর্জনই ঈদুল আজহার লক্ষ্য। কোরবানি ঈদুল আজহার প্রধান আমল বা কর্তব্য। এর আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হলো নিজের মধ্যে ওঁৎপেতে থাকা পশুস্বভাবকে কোরবানির মাধ্যমে বিনাশ করা। মহানবী (সা:) এই ঈদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে বলেছেন : এটি তোমাদের পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর সুন্নাত। বলা বাহুল্য, হযরত ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহপাকের প্রতি গভীর আনুগত্য ও তার রাহে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের যে নজির স্থাপন করেন, ঈদুল আজহা তার স্মারক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আ:) তার প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ:)-কে কোরবানি করার যে অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তার নজির মানবেতিহাসে বিরল। আল্লাহপাকের রহমতে ও নির্দেশে হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর স্থলে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। সেই থেকে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে পশু কোরবানির বিধান চালু হয়। হযরত ইব্রাহিম (আ:) যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন প্রতি বছর পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্যের আদর্শ সমুন্নত রাখেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) কোরবানির এই আদর্শ বহাল রাখতে আদিষ্ট হন। তিনিও প্রতি বছর কোরবানি করেন এবং তার উম্মতের জন্য তা অনুসরণের নির্দেশ প্রদান করে গেছেন।
পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহপাকের প্রতি আত্মসমর্পণ ও আত্মত্যাগের সুযোগ নিয়ে আসে ঈদুল আজহা। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, কোরবানির দিন কোনো ব্যক্তির কোরবানির পশুর রক্ত ঝরানোর মতো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় আর কোনো কাজ নেই। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, কোরবানির পশুর গোশত বা রক্ত কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঈদুল আজহার মর্মবাণী হলো এই তাকওয়া। তাকওয়ার অর্থ হলো মুমিনের সেই সংকল্প যাতে প্রয়োজনবোধে সে তার সবকিছু এমনকি প্রাণও আল্লাহপাকের নামে কোরবানি করতে প্রস্তুত। আসলে যে কোরবানিতে তাকওয়া নেই, আল্লাহপাকের দৃষ্টিতে তার কোনো মূল্য নেই। গোশত খাওয়া, সামাজিকতা রক্ষা করা কিংবা অর্থবিত্তের গরিমা প্রকাশ করা কোরবানি নয়। কোরবানির নিয়ত ও লক্ষ্য যদি ঠিক না হয়, তবে সে কোরবানির কোনো ফায়দা নেই। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের দেশে কোরবানির এই দিকটি অনেকেই খেয়াল রাখে না। অনেকেই কোরবানির মর্মবাণী অনুধাবন না করে নানা লক্ষ্য ও উদ্দেশে কোরবানি করে। তাদের কোরবানি তাদের কোনো কাজে আসে না। কোরবানিকে ওয়াজিব করা হয়েছে। যাদের জন্য তা ওয়াজিব রাসূলেপাক (সা:) তাদেরকেই কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছেন। এই মর্মে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন : কোরবানি ওয়াজিব হয়েছে এমন লোক কোরবানি না করলে তারা যেন ঈদগাহে না যায়।
কোরবানির ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যের পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক, মানবিক ও নানা কল্যাণকর দিকও রয়েছে। ধনী-দরিদ্র সবাই যেন ঈদের আনন্দ সমভাবে উপভোগ করতে পারে, সে জন্য স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কোরবানির গোশতের অংশ আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রের মধ্যে বিতরণ আবশ্যক যাতে তারাও ঈদের আনন্দ সমভাবে ভোগ করতে পারে। এমন এক সময় এবার ঈদুল আজহা উদযাপিত হচ্ছে, যখন বিশ্ব মুসলিমের দুঃখ-দুর্দশা ও বিপদাপদের শেষ নেই। যুদ্ধ-সংঘাত, পারস্পরিক বিরোধ ও দ্বন্দ্ব ব্যাপক আকার লাভ করেছে। অমুসলিম দেশগুলোতে মুসলমানরা নানাভাবে বৈষম্য ও নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক দেশে ও জনপদে মুসলমানেরা ঈদ উদযাপনের অবস্থায় নেই। আমাদের দেশেও মানুষ নানা সমস্যা ও সঙ্কটে রয়েছে। অভাব-দারিদ্র্য তো আছেই, সেই সঙ্গে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগ ও আতঙ্ক। স্বীকার করতেই হবে, ধনী ও দরিদ্রের ব্যাপক বৈষম্য থাকার কারণে অনেকেই যথাযথভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারবে না। তাদের দিকে ধনী ও সম্পন্ন মানুষের বিশেষ নজর দেয়া আবশ্যক। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূল নয়। সব ক্ষেত্রেই একটা অনিশ্চয়তা বিদ্যমান। আল্লাহপাক এই সমূহ দুর্ঘটের অবসান করুন, এই কামনা করি। বিশ্ব মুসলিমের এই দুর্দিনের নিরসনসহ তাদের মধ্যে ঐক্য-সংহতি সৌভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধি করুন, এই প্রত্যাশাও করি। পরিশেষে সবাইকে জানাই ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন