আবদুল আউয়াল ঠাকুর
শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদ-। সে বিবেচনায় একটি জাতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে হলে অবশ্যই মেরুদ- শক্ত করা প্রয়োজন। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সংখ্যায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও প্রকৃত মেধাবীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষা খাতে ব্যয় দিন দিনই বাড়ছে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, দেশে যে ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি চালু রয়েছে তাতে সাধারণ বা মধ্যবিত্তের পক্ষে শিক্ষা ব্যয় চালানো অনেকটাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই বিবেচনায় অবশ্যই ভাববার রয়েছে, প্রকৃতই কি জাতি হিসেবে আমাদের মেরুদ- শক্ত হচ্ছে নাকি অন্য কিছু।
এক সময়ে প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষার নিয়ম ছিল। প্রতিটি স্কুল থেকে পরীক্ষার ফলাফল এবং মেধার মানের ভিত্তিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ বৃত্তি পরীক্ষার জন্য প্রার্থী যাচাই-বাছাই করে দিতেন। এদের থেকে যারা বৃত্তি পেত তাদের সামাজিক অবস্থান তখন থেকেই পাল্টে যেতে থাকত। মনে করা হতো, যারা প্রাথমিকে ভালো বৃত্তি পায় তাদের যে মান নির্ধারিত হয় তার সাথে আরো একটু যুক্ত করলে অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়াও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। বৃত্তিপ্রাপ্তিকে দুভাবে বিবেচনা করা হতো। প্রথমত, দেখা হতো ভালো বা কৃতিত্বের অধিকারী হিসেবে। দ্বিতীয়ত দেখা হতো, শিক্ষা ব্যয় মেটানোর বিবেচনায়। একসময়ে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় ইংরেজি তুলে দেয়ার পর গ্রামে শিক্ষার্থীদের বৃত্তিপ্রাপ্তির হার বেড়ে গিয়েছিল। সে সময়ে বৃত্তিধারী শিক্ষার্থীরা বিনে পয়সায় পড়ার সুযোগ পেত। এমনকি যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্কুলকে অধিক পরিচিত করাতে চাইত তারা বৃত্তির ফলাফল প্রকাশের শুরু থেকেই ছাত্রের অভিভাবকের সাথে লবিং করত। বিনে পয়সায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও তাদের দেয়া হতো। এখন দেখা যাচ্ছে, মেধা তালিকায় ভালো ফল করার পরও তারা বিনে বেতনে পড়তে পারবে কিনা এ নিয়ে হরহামেশাই প্রশ্ন উঠছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও বলা হচ্ছে, সরকারি নির্দেশেরও তোয়াক্কা করছেন না অনেকেই। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে তাতে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণিতে এত বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী ফলাফল ভালো করছে যে, তাদেরকে যদি আলাদা বিবেচনায় দেখতে হয় তাহলে অনেক স্কুলের আয়-উন্নতি নিয়েই হয়তো প্রশ্ন দেখা দেবে বা দিতে পারে। আবার এমনও ভাবা হচ্ছে মেধাবী বলে যারা স্বীকৃতি পাচ্ছে তাদের মেধা-মনন নিয়ে হয়তো প্রশ্ন রয়েছে। কথা যে একেবারে অসঙ্গত নয় সে আলোচনাই উঠেছে সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো কোনো রিপোর্টে। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, টাকার বিনিময়ে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়ার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। ফলাফল জালিয়াতির জন্য অর্থের লেনদেনের বিষয়ে দীর্ঘ ফোনালাপ উদ্ধার করা হয়েছে। রিপোর্টে একটি সুনির্দিষ্ট ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, ফলাফল টেম্পারিং করা হয়েছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এ কাজ হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি এবারই প্রথম নয়, এর আগেও হয়েছে। ফলে জরুরি বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন ঘটনা কি কেবলমাত্র সেখানেই ঘটেছে না আরো কোথাও হয়েছে। যাই হোক না কেন, অর্থের বিবেচনার চেয়েও প্রকৃত বিবেচনায় মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা অসম্ভব জটিলতা সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক। যার সম্পর্কে এই অভিযোগ, তার অফিসে যে কেউ যখন তখন ভিজিট করলে দেখতে পাবেন কম্পিউটার অপারেটর ছাড়া অফিসে কেউ থাকেন না। কাউকে খুঁজতে গেলে ওই অপারেটর সংশ্লিষ্টের ফোন নম্বর দিয়ে দেন। বোধকরি অভিযোগের আঙ্গুল যে অপারেটরের বিরুদ্ধে তিনিই হয়তো সেই ব্যক্তি। যাই হোক জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য তদবির বা এ জন্য টাকা-পয়সার খেলার কথা যেভাবে বলা হয়েছে তার বাইরেও আরেকটি চিত্র রয়েছে। সেটি হচ্ছে, যে ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্রশ্নপত্র করা হচ্ছে তা শিখতে প্রতিটি শিশুকেই সেই সকালে উঠে শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। সাথে থাকেন অভিভাবক। এ জন্য ব্যয় করতে হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। যাদের, বিশেষ করে সাধারণ বা মধ্যবিত্তের, সামর্থ্যে কুলাচ্ছে না, তাদের সন্তানরা স্বাভাবিকভাবেই ঝরে পড়ছে মেধাবীদের তালিকা থেকে। সে বিবেচনাতেও বলা যায় মেধাবী হওয়াটা এখন অর্থবিত্তনির্ভর হয়ে পড়েছে, যা প্রকৃত পক্ষে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ব্যাপারটি কেবল প্রাথমিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ, বোধকরি সে কথা বলা সঙ্গত নয়। অন্যভাবে হলেও এ নিয়ে কথা বলেছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেছেন, দেশের বেশির ভাগ কলেজে বেলা ১১টার পর শিক্ষক-শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া যায় না । প্রসঙ্গিক আলোচনায় তিনি আরো বলেছেন, শিক্ষকরা মনে করেন ক্লাসে পড়ালে কোচিং-প্রাইভেটে শিক্ষার্থীরা আসবে না। শিক্ষার্থীরা সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে আসে। তারা আসে কোচিং করতে। সকালে যে শিক্ষার্থী আসে সে কোচিং করে ক্ষুধার্ত হয়ে বাড়ি চলে যায়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, ব্যাপারটি কেন হচ্ছে বা এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম কিনা। অবশ্যই দেশের শিক্ষার মান বিবেচনায় শিক্ষামন্ত্রীর পর্যবেক্ষণ এবং বক্তব্য সবিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার মানোন্নয়নের বিষয়টিকে ইতিবাচকতায় দেখতে গিয়েই নোটবই থেকে সৃজনশীল প্রশ্ন না করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, কেউ নোটবই থেকে প্রশ্ন করলে তা বাতিল হবে এবং তাকে শাস্তি পেতে হবে। নোটবই থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে মেধা-মনন সম্পন্ন করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের যতটা না উপকার হয়েছে তার থেকে আর্থিকভাবে উপকৃত করেছে অন্যদের বেশি। এর ফলে শিক্ষাব্যয় বৃদ্ধি এবং মেধা-মননের অপচয় ছাড়া বোধকরি অন্য কিছুই হয়নি বা হতে পারেনি। যদি পুরনো পদ্ধতিকে মিলিয়ে দেখা যায় তাহলে বোধহয় এ কথা বলা যাবে, আগেই ভালো ছিল। কেন এ অবস্থা বা এর জন্য কে কোথায় দায়ী তা যদি সঠিকভাবে খুঁজে বের করা না যায় তাহলে গোটা জাতি যে চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শিক্ষামন্ত্রী যে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন, কিছুদিন আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানও অনুরূপ অভিযোগ করেছেন। এ ধরনের অভিযোগ ঢালাও না হলেও এর ভিত্তি রয়েছে। সেই সাথে সুনির্দিষ্ট কারণও রয়েছে। প্রথমত এ কথা বলতে হবে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে স্কুল-কলেজগুলোতে যে ধরনের পরিচালনা কমিটি রয়েছে তাদের ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের গলদ রয়েছে। যারা এগুলো পরিচালনা করেন তারা শিক্ষার মান রক্ষার চেয়ে নিজেদের ঢোল পেটানো বাহিনী পুষতেই বেশি পছন্দ করেন। অন্যদিকে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সদস্যরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনেকটা তাদের বাসাবাড়ি বানিয়ে নিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকদের তারা অনেকটাই যেন নিজেদের হুকুম পালনের লোক বলেও মনে করেন। নিজেদের আখের গুছানোর বিষয়টিও এক্ষেত্রে এড়িয়ে যাবার নয়। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও পাওয়া যাবে যেখানে সরকার নির্ধারিত বেতনের বাইরে কার্যত কিছুই দেয়া হয় না উপরন্তু নানা ইস্যুতে কেটে নেয়া হয়। অন্যদিকে সরকারের থেকে বেতন দেয়ার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থানের বিবেচনায় নিয়োগের বিপরীতে অবৈধ অর্থের লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুষ্ঠু ও সঠিকভাবে পরিচালনার জন্যই পরিচালনা পরিষদ গঠনের বিধান রয়েছে। এর মূল চেতনা হচ্ছে শিক্ষার মানরক্ষা এবং উন্নয়ন। এখন দেখা যাচ্ছে, কমিটিও রয়েছে অথচ শিক্ষাঙ্গনের অধোগতি হচ্ছে। তাহলে এ জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী কারা? অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। তাতে বাস্তবত পরিস্থিতির খুব একটা হেরফের হয়েছে, বোধকরি বলা যাবে না। কারণ এখানে প্রকৃত জবাবদিহিতার যে বিষয়টি রয়েছে তা মূলত নির্ভর করে ব্যক্তির সততা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার ওপর। জমির ফসল রক্ষা করতে বেড়া দেয়া হয়। বেড়ায় যদি ক্ষেত খায় তাহলে সে ফসল কীভাবে রক্ষা করা যাবে, সে ভাবনাই এখন প্রধান হয়ে উঠেছে।
দেশে শিক্ষার মানোন্নয়নের ভাবনা থেকেই উচ্চশিক্ষার অনুবর্তী কিছু ভাবনা করা হয়েছিল। এসব ভাবনা থেকেই একসময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার নীতগত সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে বলা যায়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চলছে এক হ-য-ব-র-ল বাস্তবতা। নীতিগতভাবে দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই সারা জীবন মনে করা হয়েছে সাধারণ ও মধ্যবিত্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক প্রভাবে এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণের শিক্ষা গ্রহণ কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তা প্রমাণিত হয়েছে রাজরাড়ীর ছেলেটির মৃত্যুতে। গ্রামের সাধারণ নি¤œবিত্ত ঘরের এই ছেলেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে সরকারি ছাত্রসংগঠনের নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত মারা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। বিষয়টি আসলে গরু মেরে জুতাদানের সমান। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে তদারকি করা। তারাই এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবক। এক্ষেত্রে তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার কারণে অন্যদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ হুমকিতে পড়েছে। ঢাকায় যাদের কোনো আশ্রয় নেই অথচ ভর্তি হবার যোগ্যতা রয়েছে তাদের এই অসহায় অবস্থার যদি অবসান করা না যায় তাহলে শিক্ষার মানোন্নয়নের চিন্তা অমূলক। মূলত দেশের প্রকৃত মেধা-মননের বিবেচনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি উপযোগী করা না যায় তাহলে মেধাবীদের খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তায় অত্যন্ত বিপজ্জনক। এখানে বলা দরকার, পাবলিক পদ্ধতিতে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়ও রয়েছে। বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এগুলো চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। নীতিগতভাবে এগুলো পাবলিক হলেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ব্যয় দামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। অন্যদিকে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীর পোষ্যদের যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে অন্যদের বেলায় তা নেই। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শৃঙ্খলার দিক থেকে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা হলেও সাধারণের মেধা বিকাশের অনুবর্তী নয়। অন্যদিকে দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন সেশন জটের অবসান এবং সবার জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করার লক্ষ্য নিয়ে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে সেখানে ভিন্ন বাস্তবতা স্থান করে নিয়েছে। দেশের সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা একই মতো না হলেও অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেই শিক্ষার মান নিয়ে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বিরুদ্ধেও এমন অভিযোগ রয়েছে যে, সেখানে প্রাকটিক্যাল পর্যন্ত করানো হয় না। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষার সুযোগ না থাকা, নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকা, যত্রতত্র ক্লাস নেয়া, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি না থাকার পাশাপাশি সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। এসব অভিযোগের পাশাপাশি গুরুতর এক অভিযোগে বলা হয়েছে বর্তমানে চালু থাকা ৮৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৭টিতেই ভিসি নেই। প্রোভিসি নেই ৬৮টিতে। আর কোষাধ্যক্ষ নেই ৫১টিতে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে, ২৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি, প্রোভিসি, কোষাধ্যক্ষ পদে কেউ নেই। মাত্র ৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি পদ পূর্ণ। এমনও বলা হয়েছে, বর্তমানে যারা কর্মরত রয়েছেন তাদের অনেকেরই যোগ্যতা নেই। ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদিত ভিসির মাধ্যমে ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। অথচ নিয়মানুযায়ী বোর্ড এটা করতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে মনোনীত নামসমূহ প্রেসিডেন্ট তথা পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানো বাধ্যতামূলক। তিনি সেখান থেকে মনোনয়ন ঠিক করে দেবেন। নিয়মানুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ চালিয়ে নিতে একজন ভিসির মেয়াদ পূরণের পর আরেকজন নিয়োগ পাবার পূর্ব পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কাজ চালিয়ে নিতে পারবেন। অবশ্যই একজন ভিসির নিয়োগ পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চ্যান্সেলরের অনুমতিলাভের সময় এক মাসের বেশি হওয়ার কথা নয়। শিক্ষাবিদ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, ট্রাস্টিবোর্ড সাধারণত ভিসি ও প্রোভিসি নিয়োগের বেলায় এক ধরনের সময়ক্ষেপণ নীতি অনুসরণ করছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ কবির হোসেন জানিয়েছেন, আলোচ্য তিন পদে যোগ্য লোক পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উচ্চ শিক্ষায়তনে এ ধরনের অভিযোগ শিক্ষার মান বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুতর। এটা বলা হচ্ছে, অর্থ লুটপাটে ব্যস্ত বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা লুটপাটের রাস্তা নির্বিঘœ রাখতেই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো খালি রাখছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে এসব পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা রয়েছেন তারাও অনেকটা ক্ষমতাহীন। তাদের কাজে পদে পদে বাধা দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের একজন সাবেক অধ্যাপককে সম্প্রতি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ ছাড়তে হয়েছে। এই শিক্ষক জানিয়েছেন, কার্যত তার কোনো ক্ষমতা ছিল না। চোখের সামনে শিক্ষাবিরোধী এবং আর্থিক শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ দেখতে হচ্ছিল। একপর্যায়ে প্রতিবাদ করায় তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তার মতে, তার অন্য যেসব সহকর্মী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছেন বা দায়িত্ব পালন করে আসছেন তাদের অভিজ্ঞতাও কম-বেশি অভিন্ন। দেশের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় রাজনৈতিক নয়তো অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়েছেন সুতরাং তারা কাউকে তোয়াক্কা করেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি মনে করেন, যখন সরকার অনুমতি দিচ্ছে তখন এর দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। তিনি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন, যারা আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
দেশের শিক্ষার মানের এই বেহালদশার মাশুল দিতে হচ্ছে জনগণকেই। একদিকে যখন শিক্ষার মান নিয়ে চরম বিতর্ক চলছে ঠিক সে সময়ে দেশের নামিদামি এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এক ধরনের অপপ্রচারের শিকার। অনেক বড় বড় হত্যাকা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে। এ জন্য কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে খুনিদের বিশ্ববিদ্যালয় বলে না, বলার কোনো কারণও নেই। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দেশের কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিরূপ প্রচারণার শিকারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে শিক্ষা সমাপ্ত করেছে যারা, তারা চাকরির বাজারে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন হুমকির মুখে পড়েছে। এটা সবারই মনে রাখা দরকার, একটি অবিন্যস্ত সমাজের ফাঁকফোকর দিয়ে অনেক কিছুই প্রবেশ করতে পারে। বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে শিক্ষার মানোন্নয়নের বা মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা যাক না কেন, শিক্ষামন্ত্রী কোনো না কোনোভাবে শিক্ষার মানের প্রতিই গুরুত্ব দিয়েছেন। ব্যাপারটি তার একার নয় এবং তার একার পক্ষে এটি করাও সম্ভব নয়। প্রকৃত বিবেচনায় সবাকেই শিক্ষার মানের ব্যাপারে আপসহীন হতে হবে। এ জন্য আন্তরিকতা ও মানসিকতাই যথেষ্ট।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন