শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

মুসলিম না হয়েও এই মাসে রোজা রাখেন যারা

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ১১:৪৭ এএম

মুসলিমদের কাছে রমজান মাসের আদালা গুরুত্ব সব সময় থাকে। আর এই সময়টাতে তারা অন্য মাসের চেয়ে নিজের আলাদাভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। এটা দেখে বিশ্বের অনেক অমুসলিমও রোজা রাখেন।

রেহান জয়াবিক্রমে একজন রাজনীতিবিদ। তিনি শ্রীলংকার প্রধান বিরোধীদলে একজন তরুণ রাজনীতিবিদ।

গত ১৩ই এপ্রিল তিনি বিস্ময় সৃষ্টি করেন এক ঘোষণা দিয়ে।

"আমি একজন বৌদ্ধ এবং আমি আমার জীবনে বৌদ্ধ দর্শন মেনে চলার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করি" - টুইটারে এক বার্তায় লেখেন তিনি।

"একথা বলার পরেও জানাতে চাই, আমি আমার মুসলিম ভাই ও বোনদের সাথে পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য অপেক্ষা করছি। এটাই হবে আমার জীবনে প্রথম রোজা রাখা - সুতরাং আমার জন্য প্রার্থনা করবেন।"

তার এই টুইটের পর দিন থেকেই রমজান মাস শুরু হয় - এবং তখন থেকে মি. জয়াবিক্রমে দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত আছেন।

তিনি শ্রীলংকার দক্ষিণাঞ্চলীয় ওয়েলিগামা শহরের আরবান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।

শ্রীলংকা একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এবার রমজান যেদিন থেকে শুরু হয়েছে - সেদিনই আবার দেশটির সিনহালা ও তামিল জনগোষ্ঠী তাদের নববর্ষ পালন করছে।

কিন্তু শ্রীলংকার এই বহু-ধর্মবিশ্বাসের সমাজে একটা বড় আঘাত লাগে দু'বছর আগে - যখন ইসলামপন্থী জঙ্গিরা ইস্টারের দিন কয়েকটি গির্জায় আত্মঘাতী আক্রমণ চালায়।

এতে প্রায় ২৭০ জন মানুষ নিহত হয়।

মি. জয়াবিক্রমে বলছিলেন, তিনি যে একমাসব্যাপী একটি ইসলামী আচার পালন করছেন এর একটা লক্ষ্য হলো, সেই আক্রমণের পর দেশে যে মুসলিম-বিরোধী মনোভাব জেগে উঠেছে - তার মোকাবিলা করা।

রেহান জয়াবিক্রমের টুইটার ফিডে তার রোজা রাখার ঘোষণার পর তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রচুর মন্তব্য-জবাব পড়েছে।

তবে এতে আরো প্রকাশ পেয়েছে যে একজন অমুসলিম হিসেবে রমজান পালন যে তিনিই প্রথম করছেন তা মোটেও নয়।

শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে থাকেন ম্যারিয়ান ডেভিড - যিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি জানালেন, তিনি বেশ কিছু কাল ধরেই এটা করে আসছেন।

"আমি একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং আমিও রমজানের সময় রোজা রাখি। এর ফলে আমার মনে একটা দারুণ স্পষ্টতা, সচেতনতা, সহমর্মিতা এবং শৃঙ্খলা আসে। আশা করি মি. জয়াবিক্রমে যেন ভালোভাবেই এটা করতে পারেন" - বলেন তিনি।

অনুরাধা কে হেরাথ হচ্ছেন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আন্তর্জাতিক বিষয়ক মহাপরিচালক। তিনি বলছেন, তিনিও একবার রমজান মাস পালন করেছেন।

"অনেক দিন আগে আমি যখন মোরাতুয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন আমিও একবার রোজা রেখেছিলাম" - টুইটারে লেখেন অনুরাধা।

"আমার বন্ধু সিফান আমাকে অনেক ভোরে জাগিয়ে দিতো খাওয়ার জন্য। বিকেল বেলা লেকচারের ফাঁকে রোজা ভাঙার সময় সে আমার সাথে তার হালকা খাবার ভাগ করে নিতো। আমি আশা করি আপনার (জয়াবিক্রমে) এ অভিজ্ঞতাটা চমৎকার লাগবে।"

রেহান জয়াবিক্রমে বলছিলেন, "আমাদের দেশের কিছু নেতা যে বর্ণবাদকে উস্কে দিচ্ছেন তার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ হিসেবেই আমি এটা করার চিন্তা করি।"

"রোজা রাখার অর্থ এই নয় যে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমি বর্ণবাদের প্রতিবাদ করছি" - বলেন জয়াবিক্রমে।

বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, ইস্টার সানডের আক্রমণের পর থেকে শ্রীলংকায় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দানব হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে।

শ্রীলংকার জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ। বাকিরা হিন্দু, মুসলিম ও ক্যাথলিক খ্রিস্টান।

"আমি যখন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দেখাই যে তাদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে আমাদের মমত্ববোধ আছে এটা তাদের একটা নিরাপত্তার বার্তা দেয়" - বলেন তিনি।

রেহান জয়াবিক্রমের কিছু সমালোচক অভিযোগ করেছেন যে এর উদ্দেশ্য মুসলিমদের ভোট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

এর জবাবে মি. জয়াবিক্রমে টুইটারে দেয়া তার এক সমর্থকের বার্তা উদ্ধৃত করেন, যাতে বলা হয়, ধর্মীয় সম্প্রীতি উৎসাহিত করে ভোট পাওয়াটা ঘৃণা সৃষ্টির চেয়ে অনেক ভালো।


অন্যদের খাওয়ানো
সাংবাদিক ম্যারিয়ান ডেভিড - যিনি একজন ক্যাথলিক - গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রমজানের রোজা রেখে আসছেন।

তিনি বলছেন, এ সময়টাকে তিনি ব্যবহার করেন তার মনসংযোগ এবং সত্যিকারের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার জন্য।

"কি খাবো তা নিয়ে সার্বক্ষণিক চিন্তা, খাদ্যের জন্য মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাওয়া, এবং অকারণে একটু পর পর খাওয়া - এগুলো থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া যায় উপবাস করার ফলে। এটা দিনটাকে একটা শৃঙ্খলার ভেতর নিয়ে আসে।"

তিনি মনে করেন এই রোজা তার মনঃসংযোগকে শাণিত করে এবং নিজেকে অনেক স্বাস্থ্যবান মনে হয়।

বিবিসিকে তিনি বলেন, "যারা জীবনমান ও চাকরির কারণে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করছেন - তাদের জন্য দিনের বেলা না খেয়ে থাকাটা বিরাট কোন ত্যাগ নয়।"

"যে মানুষরা কায়িক শ্রম করেন বা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বাইরে কাজ করেন, যাদের উন্নত বা স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অর্থ নেই - তাদের জন্য এই সময়টা সবচেয়ে কষ্টকর।"

তার মতে, রমজানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শ্রীলংকায় যাদের একবেলার খাবার জোটাতে কষ্ট করতে হয় - তাদের কথা চিন্তা করা।

তিনি জোর দিয়ে বলছেন, দান করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

"আমার মনে হয় উপবাস করার পাশাপাশি যতটা পারা যায় দান করা, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের খাওয়ানো, এবং তাদের রোজা রাখতে সহায়তা করাটা সমানভাবে প্রয়োজনীয়।"


সংহতি
পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা নাদিন পার। তিনিও আরেকজন অমুসলিম যিনি রমজান পালন করেন।

তিনি একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান - এবং তাকে রমজানের কথা জানিয়েছিলেন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী একজন মুসলিম নারী।

"এটা আমার মুসলিম বন্ধুদের সাথে সংহতি প্রকাশের একটা উপায়, তা ছাড়া যীশুর অনুসারী হিসেবে আমার নিজের ধর্মবিশ্বাসেরও একটি বহিঃপ্রকাশ।

নাদিন একজন লেখক, ব্যবসা প্রশিক্ষক এবং একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি থাকেন মিশিগান অঙ্গরাজ্যের গ্র্যাণ্ড র‍্যাপিডসে।

"গত সাত বছর ধরে পানি পানের বিধিনিষেধটির ক্ষেত্রে একটা রফা করে আমি রমজানের উপবাসের নিয়ম মেনে চলছি। তখন আমি সকালের খাবার খাই সূর্যোদয়ের আগে আর সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত সবরকম খাওয়া থেকে বিরত থাকি।"


তিনি বলছেন, এটা তার কাছে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বন্ধুদের সাথে সেতুবন্ধনের শামিল।

নাদিনের মতে মানবতা সবক্ষেত্রেই সমান।

"ইচ্ছাকৃত শারীরিক সংযমের ফলে একটা আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি হতে পারে - এই ভাবনায় বছরের একটা সময় পানাহার থেকে দূরে থাকা, এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কতটা পরস্পরের সাথে যুক্ত। আমি সেটাই উদযাপন করি।"


সবার সাথে মিলিত হবার সময়
শ্রীলংকার ম্যারিয়ান ডেভিড বলছেন, এটা শুধুই ত্যাগ বা শৃঙ্খলার সময় নয়। এটা সবার সাথে সময় কাটানো এবং প্রিয়জনদের সাথে উদযাপনেরও সময়।

"আমরা যখন বাইরে যাই , বন্ধু বা পরিবার নিয়ে একসাথে রোজা ভাঙার জন্য বসি তখন এটা একটা ডিনার পার্টির মতই লাগে- শুধু মদ্যপান ছাড়া। আমরা নতুন নতুন খাবার চেখে দেখি - অনেক মজা করি, যদিও খাওয়ার পরিমাণ কিছুদিন বাদেই অনেকটা কমে যায়। "


"তবে আপনি সত্যি সত্যি যে জিনিসটার অভাব অনুভব করবেন তা হলো পানি- বিশেষ করে এই আবহাওয়ায়। তবে এর সুফল - এই ত্যাগের চাইতে অনেক বেশি। প্রথম দিকে আমি পানির অভাবটাই বোধ করতাম। বাকি সবকিছুই সহজ, যদি আপনার এটা করার সংকল্প থাকে। "

নাদিনের জন্য এই উপবাস এখন তার আধ্যাত্মিক জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে।


"যারা ক্লান্ত এবং উত্তর খুঁজছেন - তাদের জন্য এটা চাই। যদি আমরা সবসময়ই আমাদের ইচ্ছা পূরণের চেষ্টায় থাকি, আমরা হয়তো পবিত্র মুহূর্ত বা স্থানগুলো হারাতে পারি। যা স্বয়ংক্রিয় তার মধ্যে ঢুকে যাওয়া এবং ঈশ্বরের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করার কথা ভুলে যাওয়াটা খুবই সহজ।"

তিনি মনে করেন, খাদ্য ও পানি ছাড়া থাকার ফলে তার ধর্মবিশ্বাস এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী পেয়েছে।

তার মতে: "আমরা যখন আমাদের প্রয়োজনকে অতিক্রম করে দেখতে শিখি তখন আমাদের চাহিদাগুলো অন্যরকম হয়ে যায় - আমরা ঈশ্বরকে অনুভব করি।"

সহজ নয়
অবশ্য রেহান জয়াবিক্রমের জন্য এই নতুন নিরীক্ষা খুব সহজ হয়নি।

"আমি ভোর চারটায় উঠে কিছু খেজুর, দই এবং ফল খেয়েছি। তার পর সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত কিছুই খাইনি।

বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, নতুন এই অভিজ্ঞতার পর তার দিন শেষে নিজেকে বেশ সতেজ লেগেছে।

কিন্তু পুরো এক মাস ধরে তিনি এটা চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তার সন্দেহ আছে।

"যতদিন পারি আমি চালিয়ে যাবো" - বলছিলেন এই বৌদ্ধ রাজনীতিবিদ ।

তবে তিনি সমবেদনার সাথেই বলছেন, "পানি পান না করে থাকাটা সত্যি কষ্টকর।"

বিবিসি বাংলা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Dadhack ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ১২:১৭ পিএম says : 0
May Allah [SWT] give them strength and accept them in Islam so that Allah will give them jannatule ferdous. Ameen
Total Reply(0)
Md Naim Sharif ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ১:৩১ পিএম says : 0
আল্লাহু আকবর
Total Reply(0)
Shahinoor Islam Ferdous ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ১:৩১ পিএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ
Total Reply(0)
নাজিম ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ১:৩২ পিএম says : 0
আল্লাহ তাদেরকে কবুল করুক, আমিন
Total Reply(0)
সাইফুল ইসলাম ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ১:৩২ পিএম says : 0
লেখাটি পড়ে খুব ভালো লাগলো
Total Reply(0)
শাহারিয়ার ইসলাম ২৭ এপ্রিল, ২০২১, ৯:২৩ পিএম says : 0
ইসলাম পন্থি টেরোরিস্ট আবার কি রকম? টেরোরিস্ট কখনো ইসলাম পন্থি হয় না।এখানে লেখা উচিত ছিল তথাকথিত ইসলাম পন্থি।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন