মানুষের জীবন ও শান্তিশৃঙ্খলার সুরক্ষা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। জনগণের উপর গুলি চালোনো তার কাজ নয়। আমরা এখন উল্টোটা দেখছি। কথায় কথায় গুলি চালানো হচ্ছে। আগে পত্র-পত্রিকায় দেখতাম ম্যাজিস্ট্রেট গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেই গুলি চালানো হতো। তবে নিহতের সংবাদ শোনা যেত না বললেই চলে। আহত হওয়ার কথা শুনতাম। আজকাল আর সেসব দেখা যায় না। বরং গুলি চালানোর বিষয়টি এখন অনেকটা ডালভাতে পরিণত হয়েছে। যে কারও ওপর গুলিবর্ষণ করা একটি গর্হিত অপরাধ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লজ্জার। মানুষ মারা সহজ। কিন্তু মানুষের জীবন বাঁচানো কিংবা রক্ষা করা অনেক কঠিন। করোনার নিষ্ঠুরতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে পুরো বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছে বেঁচে থাকার লড়াই কত কঠিন। অথচ কিছু মানুষ পোশাকের জোরে কিংবা ক্ষমতার জোরে দিব্যি অন্যায় জুলুম করতেও কুন্ঠাবোধ করছে না। এই অপংস্কৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে বিতাড়িত করা জরুরী। পুলিশের গুলির ঘটনা বেড়ে যাওয়া কোন সুলক্ষন নয়। যেকোনো গোষ্ঠীর দাবিদাওয়া, শ্রমিক অসন্তোষ, বিক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদ দমনের গুলি করে হত্যা করার অপসংস্কৃতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
পুলিশ কখন মানুষের উপর গুলি চালাতে পারে তা পুলিশ রেগুলেশনস বেঙ্গল (পিআরবি) বিধানে উল্লেখ আছে। এটি পুলিশ বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ আচরণ বিধান। পুলিশের সকল সদস্য এ আচরণ-বিধান মেনে চলতে বাধ্য। অথচ কিছু সংখ্যক তা মানছে না। যার ফলে গুলির ঘটনা বাড়ছে। এই বিধানের চতুর্থ অধ্যায়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গোলযোগের সময় পুলিশ কখন, কীভাবে, কতটা গুলি ব্যবহার করবে তা বর্ণনা করা আছে। এমনকি ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের কিছু ধারাতেও উল্লেখ আছে। পুলিশ প্রবিধানের আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিরোনামের ১৫৩ ধারায় পুলিশকে তিনটি ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে: (১) ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগে (২) বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে এবং (৩) কতিপয় পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার কার্যকর করার জন্য (ধারা ১৫৩-ক)। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৯৬- ১০৬ ধারাবলে পুলিশ নিজের বা অন্যের জানমাল রক্ষায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সেটা তখনই করতে পারবে যখন জানমাল বেআইনিভাবে ধ্বংসের উপক্রম হবে। সেক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আঘাত যতটুকু প্রতিকারও ঠিক ততটুক করতে পারবে। এর বেশি নয় (ধারা ১৫৩-খ)। এই ধারার ভাষ্যমতে বেআইনি সমাবেশে গুলিবর্ষণ একটি চরম ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা নেতৃত্বদানকারী পুলিশ কর্মকর্তা (ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে) দাঙ্গাকারী জনতাকে বারবার ছত্রভঙ্গ হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাবেন। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে গুলিবর্ষণের হুমকি দিবেন। কিন্তু গুলি ছুঁড়তে পারবে না। এরপরও যদি উত্তেজিত জনতা সরে না যায় কিংবা জনগণের জানমাল যায় যায় অবস্থা এবং আর কোনো বিকল্প থাকে না তখনই কেবল গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, ম্যাজিস্ট্রেট বা উচ্ছপদস্থ কর্মকতা (ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে) নির্দেশ ছাড়া কোনো পুলিশ অফিসার বেআইনি সমাবেশে গুলিবর্ষণ করতে পারে না। সংবিধানও পুলিশকে সে অধিকায় দেয়নি। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত: আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
পুলিশ কখন কোন ধরনের শক্তি প্রয়োগ করবে তা আইনের বিধানে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে। যা উপরে উল্লেখ করেছি। জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার যখন কোন পথ খোলা থাকবে না তখনই কেবল গুলি করা যায়। এর আগে নয়। যৌক্তিক কারণে গুলি ছুঁড়ে কাউকে মারা হলেও পুলিশকে তা প্রমাণ করতে হবে। যদি যৌক্তিক প্রমাণ দিতে পুলিশ ব্যর্থ হয়, তাহলে তা হত্যাকান্ড বলে বিবেচিত হবে। অস্ত্রের ভাষা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না। বরং হিতে বিপরীত হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বেড়ে যায়। পুলিশ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় কিছু সদ্যসের ভূমিকার কারষে পুরো বাহিনীর সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অথচ করোনাকালে এ বাহিনীর সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রশংসিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য, যেকোনো মানুষের ন্যায় পুলিশেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং সকল উপায় যখন ব্যর্থ হয় তখন পুলিশ আত্মরক্ষার স্বার্থে গুলি চালাতে পারে। তবে এর আগে অবশ্যই জনতাকে সতর্ক করে দিতে হবে। গুলি চালানোর উদ্দেশ্য কিন্তু আঘাত করা না। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা। জনতা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সাথে সাথে গুলি থামাতে হবে। এমনকি আহত ব্যক্তিদের দ্রæত হাসপাতালে নিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলাম। গত ৩১ জুলাই ২০২০ সালে টেকনাফ থানার আওতাধীন মেরিন ড্রাইভ এলাকায় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী কর্তৃক গুলিবর্ষণে মেজর (অব.) সিনহা মো.রাশেদ খান নিহত হন। পত্রিকান্তে খবরে প্রকাশ গুলি করার পরও মেজর (অব:) সিনহা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিকভাবে পা দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদের সময় সারা দেশে ২০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এখানেও পুলিশের গুলি চালানোর বিষয়টি সমালোচিত হয়েছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গন্ডামারায় এস আলম গ্রæপের মালিকানাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১৭ এপ্রিল শনিবার সকালে বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের গুলিতে ৫ জন শ্রমিক নিহত এবং ৬ পুলিশসহ ৫০ জনের অধিক শ্রমিক আহত হয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল কারখানার জমি অধিগ্রহণ নিয়েও পুলিশের গুলিতে ৬ জন নিহত হয়েছিল। কিন্তু বাবস্তবতা হচ্ছে পুলিশের গুলিতে নিহত বা আহত হওয়া মানুষ কতটুকু প্রতিকার পেয়েছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক দেশে পুলিশের এমন মনোভাব কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না।
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসনের ব্যতয় ঘটে তখন সেখানে কেউ নিরাপদ থাকে না। আইনের শাসন এমনি এমনি আসে না। রাষ্ট্রকেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। আইনের শাসনে উঁচু নিচু, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাউকে ভিন্ন চোখে দেখা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে আইনের শাসনের সংজ্ঞা দুরকম। শাসকদলের দৃষ্টিতে সর্বত্র আইনের শাসনের সুবাতাস বইছে। বিরোধীদল তা মনে করছে না। তাদের ভাষ্যমতে, এই সরকার ভিন্নমত দমনের নামে নিপীড়নের স্টীম রোলার প্রয়োগ করছে, যা আইনের শাসনের অন্তরায়। এই বির্তকের সুরাহা করতে হলে আইন প্রয়োগের সকল ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের নাগরিককে ভিন্ন ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক দেশে কেবল ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধি হয়ে বিরোধীমত দমন করা পুলিশের কাজ নয়। পুলিশ কেবলমাত্র আইনে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরন করতে পারে। আইনের বাইরে যা খুশি তা করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি নির্যাতনে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকারীর বিচার হচ্ছে। সেখানে অপরাধটা শুধু একজন পুলিশ হিসেবে দেখা হয়নি। বরং রাষ্ট্রের অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আর এজন্য ফ্লয়েডের ছোট্ট ছেলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা চেয়েছেন। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এরকম দৃষ্টান্ত যদি আমাদের দেশে স্থাপিত হতো তাহলে গুলি ছোঁড়ার প্রবণতা অনেকটাই কমে যেত।
লেখকঃ কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন