‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনই’ রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাপনার মূলনীতি। এ জন্য রাষ্ট্র জনগণের অর্থায়নে নানা ধরনের এজেন্সি লালন-পালন করে। জনগণের অর্থায়নে লালিত এসব বাহিনীর অফিসিয়াল বা নন-অফিসিয়াল ক্ষমতাও অনেক। তাদের কোনোরকম বেআইনি ও বিতর্কিত কর্মকান্ড বা সীমালঙ্ঘন প্রকাশ পেলেও জনগণের কোনো ক্ষমতা নেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ বা জবাবদিহি করতে বাধ্য করার। বরং জনগণের মধ্যে কেউ কোনো কর্মকর্তার কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুললে কর্মকর্তা যদি বিরাগভাজন হন তবে প্রশ্নকারীর চৌদ্দপুরুষের খবর হয়ে যেতে পারে। আর যদি তিনি বিরোধীদলীয় সমর্থক বা নেতাকর্মী হন তাহলে তো কথাই নেই। এটাই স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করতে চলল। পোশাকি বাহিনীর পাশাপাশি সাদা পোশাকি অনেক গোয়েন্দা বাহিনী রয়েছে। এসব গোয়েন্দা বাহিনী কতটুকু পেশাদারিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে তা বিশ্লেষণ ও বিচার-বিবেচনার দাবি রাখে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে স্বাধীন বাংলাদেশের দু’জন প্রেসিডেন্ট নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। অথচ, এ বিষয়ে গোয়েন্দাদের কাছে আগাম কোনো খবর ছিল না।
মাদকে দেশ ছেয়ে গেছে। সরকার কোনোভাবেই মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ, সরিষার মধ্যেই ভূত রয়েছে। স¤প্রতি মডেল, চিত্রনায়িকাসহ অনেকের অনেক কথা প্রকাশ পাচ্ছে, যা শুনতে ও বিশ্বাস করতে মন চায় না। কিন্তু বাস্তবতা এমনই যে, এসব কথা বিশ্বাস না করেও উপায় থাকে না। সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মুজিববর্ষে ঘোষণা করেছে, ‘মাদকমুক্ত বাংলাদেশই মুজিববর্ষের অঙ্গীকার।’ এই বিশেষ ঘোষণা দিয়েও সরকার কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সে বিষয়টিও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় নিতে হবে। মডেল বা নায়িকা চক্রের ছদ্মাবরণে রাজধানীর অভিজাত মাদক আসর বা আড্ডা জমার কথা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। এসব আড্ডার পার্টিসিপেন্ট হচ্ছে ধনীর দুলাল বা দুলালী ছাড়াও উচ্চস্তরের লোকজন যাদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ লোকজনও আছেন। এখানে গোয়েন্দাদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। কারণ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোথায় কী সংঘটিত হচ্ছে তার সংবাদ রাষ্ট্রের কানে গোপনে তুলে দেয়াই গোয়েন্দা বাহিনীর কাজ। কোনো কোনো সময় দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও গোয়েন্দাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রবল। এখনো সে ভূমিকা অব্যাহত নেই, এটা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। রাষ্ট্রের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরা সম্পর্কে গোয়েন্দা বাহিনীর ভূমিকা অনেক প্রশ্নবিদ্ধ।
সম্প্রতি মাদক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে, বোট ক্লাবে বিতর্কিত নায়িকাকে ধর্ষণের চেষ্টাসহ জোর করে মদ পান করানো হয়েছে। অন্য দিকে, র্যাবের প্রাথমিক তথ্য মতে, ওই নায়িকা ২০১৬ সাল থেকেই মাদকে অভ্যস্ত এবং তার বাড়ি থেকে নানারকম দেশী-বিদেশী মাদক ও মাদক সেবনের সরঞ্জাম র্যাব উদ্ধার করেছে। এখন জনমনে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রথম ঘটনা কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরঞ্জিত, নাকি দ্বিতীয়টি? মাদকসেবী মডেল বা নায়িকা ও তাদের মদ্যপ সহযোগীদের গ্রেফতার করে তাদের সাথে সম্পর্কিত ধনাঢ্য ব্যক্তি যাদের সাথে বিদেশ ট্রিপ হয়েছে, কারা তাদের দেহপসারিণী হিসেবে ভোগ করছে এবং কারা ছিল মাদক আসরের খরিদ্দার ও তাদের সহযোগীদের নাম বা ঠিকানা জানার জন্য রিমান্ড চেয়েছে। এখন ডিএমপি কমিশনার বলছেন, এ মর্মে কারো নাম প্রকাশ করা হবে না, কারণ কারো বাসায় কারো যাওয়া কোনো অপরাধ বা আইনবিরোধী কাজ নয়। এখানে জানতে ইচ্ছা করে, মদের পার্টিতে অংশগ্রহণ এবং অনৈতিক মেলামেশার বিষয়টি কমিশনার সাহেব কোন বিবেচনায় দেখেন? নিশি রাতে মাদক ও ধর্ষণ চেষ্টার মামলার সুপারভাইজিং অফিসারের সাথেই নায়িকা গাড়িতে হাতিরঝিলে মদ্যপান ও অবাধ মেলামেশা করেন। এ জন্য সে পুলিশ অফিসারকে ঢাকাতেই অন্যত্র বদলি করা হয়েছে মাত্র (পরে ডিএমপি বলেছে, ওই কর্মকর্তা মামলার সুপারভাইজিং অফিসার ছিলেন না)। এখন ডিএমপি কমিশনার বলছেন, সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ঘটনা যদি পুলিশ অফিসারের সাথে না হয়ে অন্য কোনো সাধারণ নাগরিকের সাথে হতো তাহলে গ্রেফতার ও রিমান্ড ছাড়াও এ ঘটনাটি সম্ভবত ডিএনএ টেস্টসহ ফরেনসিক রিপোর্ট পর্যন্ত গড়াত। পুলিশের নীতিনির্ধারণী মহল এভাবেই পুলিশ বাহিনীকে বিতর্কিত করে তাদের প্রতি জনগণের আস্থার জায়গাটি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মাদকসেবীদের নাম যদি প্রকাশ করা না হয় বা তাদের বিচারের আওতায় না আনা হয়, তবে কেন তাদের (মাদক আড্ডায় যাতায়াতকারীদের) নাম জানার জন্য রিমান্ড চাওয়া হলো?
রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার পাঁচমিশালি নীতিমালা অবলম্বন করায় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে চলমান অনৈতিক কর্মকান্ড ও মাদকের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। মোট জনসংখ্যার ৯২ শতাংশ মুসলমানকে মিথ্যা ও ছেলে ভুলানো সান্ত্বনা দেয়ার জন্য সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে সংযোজিত হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম’। অথচ ইসলাম ধর্মের সচ্চরিত্রতা বিষয়ক অনুশাসন কোথাও অনুসরণ করা হচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা রক্ষার্থে সংবিধানের ১৮(১) (২) অনুচ্ছেদে মদ ও মাদকজাতীয় পানীয়সহ গণিকাবৃত্তি ও জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ, কোন নিষিদ্ধ কাজটি বাংলাদেশে সংঘটিত না হচ্ছে?
ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহার করায় বাহিনীটি পেশাদারি ভূমিকা থেকে সরে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ কর্মী বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, ফলে দুর্নীতি অনৈতিক কর্মকান্ডে তারা পিছিয়ে নেই। গত ১১ আগস্ট ফেনীতে ২০টি স্বর্ণের বার আত্মসাতের অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শকসহ ছয় পুলিশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে, কোনোটা প্রকাশ পায়, বেশির ভাগই প্রকাশ পায় না। ইন্সপেক্টর প্রদীপ দাস শুধু টেকনাফে নয়, এ ধরনের প্রদীপ বাংলাদেশের সর্বত্রই জ্বলছে।
সরকার বাংলাদেশকে ডিজিটাল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে এবং ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ ২০১৮ পাস করে গণমানুষের কণ্ঠ রোধ করে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার খর্ব করেছে। ডিজিটাল ইন্সস্ট্রুমেন্ট মানুষের চরিত্র হননে যে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তা নিয়ন্ত্রণে সরকার বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। আইন যতটুকু কার্যকর করেছে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে। অথচ ফরেনসিক রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পরও বিএনপি করার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এমন ঘটনাও এই সময়েই ঘটেছে।
পুলিশ ১৬০ বছর পুরনো একটি মজবুত সংগঠন। সব সরকারই এ বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করলেও বর্তমান সরকার করেছে নগ্নভাবে। পুলিশ বলছে, তারা জনগণের বন্ধু, কিন্তু জনগণ তা বিশ্বাস করে কি? লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রতিষ্ঠাতা স্যার রবার্ট পিল বলেছেন, ‘জনগণের আস্থাই পুলিশের সফলতা’। দেশবাসী একটি সফল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখতে চায়, দায়িত্ব পালনে যারা থাকবে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন