রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে নানাবিধ অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখা যাচ্ছে। আসল ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে যেমন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তেমনি সুযোগ নিচ্ছে ভুয়া ডিবি পুলিশও। আসল ও নকল ডিবি পুলিশে একাকার হয়ে গেছে। নকল ডিবি চক্রে জড়িত আছে অপকর্মের দায়ে চাকরিচ্যুত কিছু পুলিশ সদস্যও। আসলের আদলে ভুয়া পুলিশের সংগ্রহে রয়েছে ক্ষুদ্রাস্ত্র, হ্যান্ডকাফ, ওয়াকিটকি ও মাইক্রোবাস। অনেক ক্ষেত্রে তাদের পরনে থাকছে ডিবি পুলিশের আদলে জ্যাকেট। ডিবির মুষ্টিমেয় অসৎ সদস্যের বাইরে প্রতারক চক্র ডিবি পরিচয়ে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণে জড়িয়ে পড়ায় অনেকের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, আসল-নকল চিহ্নিত করা অনেক ক্ষেত্রেই কষ্টকর।
গত ৮ নভেম্বর ভোরে রাজধানীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকা থেকে শিল্প পুলিশের এক এএসআইসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। এএসআইয়ের সঙ্গের তিনজন ভুয়া ডিবি পুলিশ বলে নিশ্চিত করেছেন আশুলিয়া থানার ওসি আবদুল আউয়াল। আটককৃতরা হলেন, শিল্প পুলিশ-১ এর আশুলিয়া জোনের এএসআই মকবুল হোসেন, তার সহযোগী বিপ্লব হোসেন, স্বপন হোসেন ও হাসমত আলী শেখ। এ সময় তাদের জিম্মিদশা থেকে শামীম হোসেন, রায়হান, আতিয়ার ও মেহেদী হাসান নামে চারজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এএসআই মকবুল নিজেকে ডিবি পুলিশের ওসি ও তার সহযোগীরা সদস্য বলে পরিচয় দিতেন। তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনায় ব্যবহৃত মাইক্রোবাসটির মালিক তাজুল মন্ডল। তাজুল আশুলিয়া থানার ধামসোনা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি লতিফ মন্ডলের চাচাত ভাই।
গত ২৫ অক্টোবর ভোরে কক্সবাজারের টেকনাফে এক ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে ফেরার সময় সেনাবাহিনীর হাতে আটক হয় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৭ সদস্য। টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে সেনাবাহিনীর তল্লাশির সময় ডিবি পুলিশের এক এসআই গাড়ির গøাস ভেঙে পালিয়ে গেলে সেনাসদস্যরা গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ অবশিষ্টদের আটক করে। বিষয়টি র্যাব ও পুলিশকে জানানো হয়। পরে পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। আটক ৭ জনকে পুলিশ সুপারের জিম্মায় দিয়ে ১৭ লাখ টাকা ওই ব্যবসায়ীকে ফেরত দেয়া হয়।
রাজধানীর কাফরুলে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে একটি ক্লাবে র্যাব পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে ফেরার সময় ঢাকা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ১১ সদস্য। সেই ঘটনার তদন্তে দোষী ডিবির সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন, পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন, এসআই জাহিদুল ইসলাম, এএসআই লুৎফর রহমানসহ ১১ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির সুপারিশ করা হয়।
ডিবি পুলিশ সেজে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে গত ২৪ অক্টোবর রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ পাশের গেটের সামনের রাস্তা থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পূর্ব বিভাগের একটি দল। এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত গুলিভর্তি বিদেশি পিস্তল, মাইক্রোবাস, ডিবি পুলিশের পোশাক (ডিবি জ্যাকেট) টর্চলাইট, ওয়্যারলেস সেট, লাঠি ও গামছা উদ্ধার করা হয়। এর দুদিন আগে ২২ অক্টোবর সাভারের আশুলিয়ার বাইপাইল থেকে ভুয়া গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে প্রতারণার সময় একজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে এলাকাবাসী। এ সময় তার কাছ থেকে পুলিশের ভুয়া পরিচয়পত্রও উদ্ধার করা হয়।
১৮ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে পুলিশের গোয়েন্দা (পূর্ব) বিভাগ গ্রেপ্তার করে ১২ জন ভুয়া ডিবি সদস্যকে। তারা স্বীকার করেছিল যে, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী গ্রাহকদের জিম্মি করে তাদের সব কিছু লুটে নিত। তাদের কাছ থেকে দুটি পিস্তল, ছয় রাউন্ড গুলি ভর্তি দুটি ম্যাগজিন, একটি কাঠের লাঠি, একটি প্লাস্টিকের তৈরি কালো রঙের ওয়াকিটকি, দুটি হাতকড়া, দুটি স্টেনলেস স্টিলের ধারালো চাকু, একটি চওড়া স্কচটেপ, একটি গামছা, একটি ডিবি জ্যাকেট এবং একটি সিলভার কালারের নোহা মাইক্রোবাসও উদ্ধার করা হয়।
গত ১৯ অক্টোবর জয়পুরহাটে পাঁচ ভুয়া ডিবিকে আটক করে জনতা। তাদের ব্যবহৃত গাড়িতে আগুনও ধরিয়ে দেয় তারা। ৯ অক্টোবর সিরাজগঞ্জে ভুয়া ডিবি পরিচয়ে টাকা ছিনতাইকালে আটক করা হয় চারজনকে। এ সময় ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস জব্দ করে পুলিশ।
বিভিন্ন সময় র্যাবও আটক করেছে ভুয়া ডিবি পুলিশকে। ১৬ জুন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভুয়া ডিবি চক্রের ৮ সদস্যকে আটক করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে বিদেশি পিস্তল, ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি ও গাড়ি উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ৩ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরায় এক অভিযানে চার ভুয়া ডিবি পুলিশ আটক করে র্যাব-১০। তাদের কাছ থেকে একটি ৭.৬৫ এমএম বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, দুই রাউন্ড গুলি, ওয়াকিটকি সেট, হ্যান্ডকাফ, সিগন্যাল লাইট, নগদ চার লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা ও ১১টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
গত ২০ জুন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দুই ব্যক্তিকে আটক করায় জেলা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) তিন কর্মকর্তাকে অবরুদ্ধ করে স্থানীয়রা। স্থানীয়দের অভিযোগ, সুমন গাজী ও শামীম গাজী গ্যারেজে বসা ছিল। এ সময় ডিবির টিম তাদের কাছে ইয়াবা দিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অন্যথায় টাকা দাবি করে। ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রামে ডিবির আট সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করে এক দোকান কর্মচারী। অভিযোগে বলা হয়, মঈন উদ্দিন নামে এক দোকান কর্মচারীকে তুলে নিয়ে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এমনকি তার মানিব্যাগে থাকা তিন হাজার ৯০ টাকা ও একটি মুঠোফোন কেড়ে নেন ওই পুলিশ সদস্যরা। তবে ডিবি পুলিশ জানায়, মঈন উদ্দিন জাল স্ট্যাম্পসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ভুয়া ডিবি সদস্যদের আটক করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। তাদের ধরতে অভিযান চলমান।
দেশ ও দেশের মানুষের সেবার কাজে নিয়োজিত বাহিনীর যেসব সদস্য অপরাধে জড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যবস্থা নিতে হবে প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধেও। মানুষ যখন কোন বিপদে পড়ে তখন আশ্রয় ও নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর দ্বারস্থ হয়। মানুষের ধারণা থাকে এমনই যে, আইনশৃৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সুরক্ষা দেবে। এমতাবস্থায়, নিরাপত্তার হুমকি যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়েই আসে তবে মানুষ যাবে কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন