শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মে দিবস : শ্রমিকদের অধিকার এতদিনে কতটা অর্জিত হয়েছে

অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২১, ১২:০৩ এএম

১৮৮৬ থেকে ২০২১। শ্রমের মর্যাদা, মূল্য ও ন্যায্য মজুরি শুধু নয়, যুক্তিসংগত কার্র্যসময় নির্ধারণের আন্দোলনের ১৩৫ বছর। গত ১৩৫ বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার। কিন্তু এই প্রশ্নের আজো উত্তর খুঁজতে হয়, এতো উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হলেও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? শ্রম ছাড়া কোন কিছুই উৎপাদন করা যায় না এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কর্মঘন্টা কতক্ষণ হবে? কতক্ষণ কাজ করলে একজন শ্রমিক কত মজুরী পাবে? শ্রমিক জীবন শেষে তার সন্তানের জীবন কেমন হবে? এরকম অসংখ্য প্রশ্নের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকে দাবি উঠেছিলো ৮ ঘন্টা কর্মদিবস চাই। এই দাবির অন্তরালে ছিলো আর একটি দাবি, ৮ ঘন্টা কাজ করে এমন মজুরি চাই যেনো তা দিয়ে আমার পরিবার নিয়ে মানসম্মত জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু শ্রমিকদের দাবি যতোই ন্যায়সঙ্গত মনে হোক না কেনো, মুনাফা ও মজুরির সংঘাত এতো তীব্র যে, আলোচনার পথে নয় বরং নিষ্ঠুর দমন ও রক্তাক্ত পথে সরকার ও মালিকরা সেই আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলো।

৮ ঘন্টার কর্ম দিবসের দাবি এবং কর্ম পরিবেশ কিছুটা উন্নত হলেও আজো শ্রমিকদের পেশাগত জীবনে নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারগুলো অর্জিত হয়নি। চলমান করোনা মহামারিতে আবারও স্পষ্ট হয়েছে, এ দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা, মৌলিক মানবিক অধিকারগুলো কতটা ভঙ্গুর। তৈরি পোশাক শিল্পের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বেতনের দাবিতে সমবেত হচ্ছে, বিক্ষোভ করছে।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা সচরাচর মে দিবস নামে পরিচিত। প্রতি বছর পহেলা মে তারিখে বিশ্বব্যাপী এই দিবস পলিত হয়। এটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের উদযাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারি ভাবে পালিত হয়।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার- পুলিশের গুলিতে শ্রমিকদে আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লভিনে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এর পরপরই ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের সময় নির্ধারনের দাবি আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পহেলা মে তারিখে মিছিলের শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিকসংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহবান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসে ১ তারিখে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকর হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং কিছু কট্টর সংগঠন তাদের দাবি জানানোর জন্য মে দিবসকে মূখ্য দিন হিসেবে বেছে নেয়।

কোনো কোনো স্থানে শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে আগুনও জ্বালানো হয়ে থাকে। পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়া, চিন, কিউবাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই পহেলা মে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সেসব দেশে এমন কি এ উপলক্ষে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। আমেরিকা ও কানাডাতে অবশ্য সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিন পালনের উদ্যোক্তা। হে মার্কেটের হত্যাকান্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন পহেলা মে তারিখে যেকোন আয়োজন হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সেবা ও নিরাপত্তা সুবিধা ও প্রত্যেক শ্রমিকের বৈধ ও আইনগত অধিকার। শ্রম আইন বাংলাদেশ ২০০৬ এর অধীনে অর্ন্তভুক্ত স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলো হলো: পরিচ্ছন্নতা, বায়ু চলাচল এবং তাপমাত্রা ব্যবস্থা, কৃত্রিম আর্দ্রকরণ, জনবহুলতা, আলোর ব্যবস্থা, অগ্নিসংক্রান্ত ঘটনা, অতিরিক্ত ওজন, বিল্ডিং এবং যন্ত্রপাতির উপর বা কাছাকাছি কাজ করা, বিস্ফোরক বা দাহ্য গ্যাস ও ধুলা, বিপজ্জনক ধোঁয়ার বিরুদ্ধে সতকর্তা, ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

শ্রমিকদের চোখের নিরাপত্তার জন্য উপযুক্ত চশমা বা চোখের আবরণের ব্যবস্থা থাকতে হবে যেখানে উৎপাদন প্রক্রিয়ার করনে উৎক্ষিপ্ত বা বিচ্ছুরিত কণা বা টুকরো থেকে অথবা অতিমাত্রায় আলো বা উত্তাপের কারনে চোখের ক্ষতির আশংকা থাকে। যেখানে শারীরিক আঘাত, বিষক্রিয়া বা গুরুতর রোগের সম্ভাবনা আছে, এমন কোন ক্ষতিকর অপারেশণের ক্ষেত্রে কর্মরত প্রতিটি শ্রমিকের জন্য সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা নিয়োগকর্তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ব্যক্তিগত সুরক্ষার জন্য সরঞ্জাম দেওয়া সত্তে¡ও এটি ব্যবহার না করা হলে তার দায়িত্ব শ্রমিকের নিজের হবে।

একজন নিয়োগকর্তা তার অধীনস্ত কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ওপর একটি বাস্তব এবং প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণ প্রদান করতে এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য একটি সুরক্ষিত এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে বাধ্য। শারীরিক আঘাত, বিষক্রিয়া বা গুরুতর রোগের ঝুঁকি আছে এই ধরনের বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং কাজের জন্য উপযুক্ত প্রমাণিত না হলে তার দ্বারা ওই কাজ করানো যাবে না। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারকি এবং পর্যবেক্ষণ কাজে পরিদর্শকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়ে থাকেন। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দিনটি পালন করতে শোভাযাত্রা, শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকে। মে দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশন সহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালন করে। প্রতি বছর এই দিনটিতে শ্রমিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এবছর এই দিনটিকে সামনে রেখে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪টি হাসপাতালের ১৪৭৪ জন চিকিৎসক, ৪০৬ জন নার্স ও ৯৮১ জন অন্যান্য স্বাস্থ্য কর্মীর মধ্যে পূর্বঘোষিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রনোদনা প্রদান করবেন। টাকার অঙ্কে প্রণোদনার পরিমান ১৫ কোটি ২৭ লক্ষ ৬৪ হাজার ৯০২ টাকা। করোনা মহামারির মধ্যে গত বছরের ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেন মার্চ মাস থেকে যারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন, সরকার তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করবে। বর্তমান সরকার শ্রমিক বান্ধব সরকার। সরকার শ্রমিকদের অধিকার বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলে শ্রমিকরা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক ভালো আছে।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন