শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

দু’মুঠো ভাত জুটলেও জুটে না আর কিছু

প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল ওয়াজেদ কচি, সাতক্ষীরা থেকে : আমারে বলিল জামা-কাপড় পরিষ্কার কইরি রাখতি, বিকালে জঙ্গলে যাবে। আমি জামা-কাপড় পরিষ্কার করে রাখলি দুপুরে গরম ভাত খেয়ে ও আর ওর বাপ বাদায় যায়। বিকালেই জাইলেরা এসে খবর দেয়, ওর বাপ বনে পইড়িছে। ছেলে ওর বাপকে নিয়ে রাতে বাড়ি আসে। বাপের শেষকৃত্য কইরি পরের দিনই দু’মুঠো ভাতের জন্যি ছেইলি আবার বাদায় চলি যায়।’ কথাগুলো বলতে বলতেই চোখ ছল ছল করে ওঠে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের পানখালী জেলে পল্লীর বাঘ বিধবা সীতারানীর (৫৫)। সেই থেকেই নদীতে কাঁকড়া ও রেণু ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। শুধুই কি বিধবা, স্বামী দুর্গাপদ মÐলকে হারানোর সাথে সাথে ললাটে জুটেছে নানা অপবাদও। স্বামীকে বাঘে ধরলেই নানা রকম সামাজিক কুসংস্কার ঘিরে ধরে তাদের। শুনতে হয়, অপায়া, অল²ীসহ নানা অপবাদ। অনেককে ছাড়তে হয় স্বামীর ভিটা। দুর্বিষহ হয়ে ওঠে জীবন। সীতারানী জানান, ছেলের বউ আছে। বনে গিয়ে যা পায়, তাতে তাদেরই চলে না। তাই নিজেকেও সবসময় ভাতের জন্য যুদ্ধ করতে হয়। দু’মুঠো ভাতের জন্য পানখালী জেলেপল্লীর সীতা রানী, হারু বালা, কমলা, ফুলবাসীদের মতো শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জসহ সুন্দরবন উপক‚লের শত শত বাঘ বিধবার জীবন হয়ে উঠেছে ওষ্ঠাগত। গাবুরা ইউনিয়নের চবকারা গ্রামের বাঘ বিধবা বকুল বেওয়া (৬০) জানান, ঠিক কত বছর আগে স্বামীকে বাঘে নিয়ে গেছে তা মনে নেই তার। তবে, বছর ত্রিশেক আগে যে তিনি বিধবা হয়েছেন তা সহজেই অনুমেয়। সেই সময়ই স্বামীর ভিটা ছাড়তে হয় তাকে। তারপর চকবারায় এসে বসবাস শুরু করেন সরকারি জায়গায়। নদীতে রেণু ও কাঁকড়া ধরতেন। কিন্তু এখন আর শরীরে ‘জো’ নেই তার। ভিক্ষা করে জীবন চলে। আর পাচুর স্ত্রী তিন সন্তানের জননী কমলা জানান, দুই ছেলে ও এক মেয়ের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দিতে সারাদিনই নদীতে থাকতে হয় তাকে। এতে দু’মুঠো ভাত জুটলেও আর কোনো কিছুই জোটে না তাদের কপালে। প্রায় প্রত্যেক বাঘ বিধবার জীবন কাহিনীই একইরকম। এই ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেন সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল প্রত্যেকেই। কিন্তু ভয়কে অতিক্রম করেই জীবিকার তাগিদে বাদায় যেতে হয় তাদের। ঘটে একই ঘটনা। তারপরও কাজ না থাকায় সেই একই পথে পাড়ি জমান বনজীবীরা। আর বনদস্যুদের উৎপাততো রয়েছেই। স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার হিসেব মতে, গাবুরা ইউনিয়নে ২৮৫ জন, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে ৮১ জন ও মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে ১৪৩ জনসহ শ্যামনগর উপজেলায় ১১৬০ জন বাঘবিধবা রয়েছেন। এদের কারো কারো স্বামী সুন্দরবনে মধু, গোলপাতা বা মৎস্য আহরণ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছেন। আবার কুমিরের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছেন অনেকে। স্থানীয় সুন্দরবন গবেষক পিযুষ বাওয়ালি পিন্টু বলেন, শ্যামনগরের একটি অংশের মানুষ জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয় তারা। কখনো বাঘ কিংবা কুমির, আবার কখনোবা বনদস্যুদের দ্বারা। এতে অনিরাপদ হয়ে পড়ে বনজীবীদের পরিবার। বিশেষ করে অল্পবয়সে বিধবা হলে তার আর কুল থাকে না। নানা সামাজিক কুসংস্কারে অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করেন তারা। এ সময় বাঘ বিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার আহŸান জানান তিনি। অন্যদিকে, শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম বলেন, পূর্বে বাঘ বিধবাদের পুনর্বাসনে কোনো কর্মসূচি ছিল না। তবে, অতি সম্প্রতি তাদের তালিকা নিয়ে বয়সের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনা ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন