শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

মুসলিম উম্মাহর ব্যাধি ও পরিশুদ্ধতার উপায়

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ২০ মে, ২০২১, ১২:০১ এএম

মুসলিম উম্মাহ আজ দিশেহারা। পৃথিবীর আনাচে কানাচে লুণ্ঠিত মানবতার নাম মুসলিম সমাজ। আমাদের চিন্তা করা দরকার, যে মুসলিম উম্মাহ সর্বদা নেতৃত্ব দিতে অভ্যস্ত ছিল, আজ তাদের এই অধঃপতন কেন? কেনইবা মাত্র ৫.২ মিলিয়ন ইহুদী প্রায় দেড়শো কোটি মুসলমানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে বায়তুল মুকাদ্দাসে আধিপত্য বিস্তার করছে? কেনইবা প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের নেতারা মুসলমানদের সংখ্যাধিক্যের ভ্রুক্ষেপ করছে না? কেনইবা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা সত্ত্বেও আমাদের রক্ত জেগে ওঠে না? নিশ্চয়ই মুসলিম উম্মাহ গুরুতর পাপে জড়িয়ে আছে, যা এমন অধঃপতনের পথকে সুগম করছে। কেননা মুসলিম উম্মাহ কখনো কাফেরদের শক্তির দ্বারা পরাজিত হয় না বরং নিজেদের দূর্বলতার কারণেই পরাজিত হয়। যার স্পষ্ট উদাহরণ বদর ও উহুদ যুদ্ধ। বদরের প্রান্তরে মুসলমানদের দৃঢ়তার বলয়ে অনায়াসেই বিজয় লাভ করে কিন্তু উহুদ প্রান্তরে সামান্য আনুগত্যহীনতার কারণে মুসলমানদের সাময়িক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। উম্মাহ›র প্রতিটি মানুষের অন্তরে আজ ব্যাধির আবাস।দুনিয়ার লোভ ও মৃত্যুকে অপছন্দ করাই হলো সেই গুরুতর ব্যাধি।সাহাবায়ে কেরাম জান্নাত লাভের আশায় মৃত্যুকে ভালোবাসতেন কিন্তু আমরা দুনিয়ার লোভে মৃত্যুকে অপছন্দ করছি।উম্মাহর দুর্যোগটা মূলত মুসলমানদের অন্তরে দুনিয়ার ভালোবাসা বেড়ে যাওয়া এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ব্যাপারে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ বাণী করেছেন। গ্ধরাসূল স. বলেন,খাদ্য গ্রহণ কারীদের যেমনি ভাবে খাবার পাত্রের চতুর্দিকে ডেকে আনা হয়,তেমনি ভাবে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে একে অপরকে ডেকে আনবে।এক ব্যক্তি বললো,সেদিন আমাদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে কি এরূপ হবে?তিনি বললেন, তোমরা বরং সেদিন প্রচুর সংখ্যক হবে;কিন্তু তোমরা হবে বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মতো।আর আল্লাহ তোমাদের শত্রুদের অন্তর থেকে তোমাদের আতঙ্ক দূর করে দিবেন এবং তোমাদের অন্তরে ‹আল-ওয়াহন› ঢেলে দিবেন। সাহাবীরা বললেন, হে রাসূল সাঃ ‹আল-ওয়াহন› কি? তিনি বললেন,তাহলো দুনিয়ার ভালোবাসা এবং মৃত্যুকে অপছন্দ করাগ্ধ।[আবু দাউদ-৪২৯৭] আজ এই দুনিয়ার লোভে মুসলমানগণ নিজেদের জাত-পরিচয় ভুলে গেছে।সামান্য স্বার্থের জন্য মুসলিমরা দ্বীনের ক্ষেত্রে ত্রুটি করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।ক্ষমতা ও অর্থ লোভে কাফেরদের সাথে হাত মিলাচ্ছে, এমনকি রাসূলের অভিশাপ প্রাপ্ত ইহুদীদের সাথেও সখ্যতা গড়ে তুলছে।মুসলিম আজ তার ইতিহাস ঐতিহ্য ভুলে গেছে। আমরা ভুলে গেছি সাহাবায়ে কেরামগণের শহীদী চেতনা,ভুলে গেছি তারিকের পুত্র জিয়াদ কর্তৃক আন্দালুসিয়া তথা বর্তমান স্পেন জয়ের সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ভুলে গেছি সুলতান ইমামুদ্দিন জিনকি ও তার পুত্র নুরুদ্দিন মাহমুদ জিনকির ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস, ভুলে গেছি সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী কর্তৃক সমগ্র খ্রিস্টান জাতিকে পরাজিত করে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের ইতিহাস।ভুলে গেছি লেবাননের বীর শহীদ ওমর মুখতারের সেই অমীয় বক্তব্য ‘আমরা কলোনী মুক্ত করবো নয়তো শহীদ হবো›।সেদিন ইতালির মুসোলোনী কর্তৃক শত লোভ-লালসার প্রস্তাব ওমর মুখতারকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি।ফাঁসির কাষ্ঠে ওমর মুখতারের বক্তব্য ছিলো,আমার শাহাদাত উম্মাহর জন্য শিক্ষা হবে যে,মুসলিম ফাঁসির কাষ্ঠ বরণ করবে তবুও বাতিলের সাথে আপোষ করবেনা।কিন্তু আফসোস যে,মুসলিম উম্মাহ সামান্য ক্ষমতা,আর্থিক সহায়তা ও পণ্য-দ্রব্যের লোভে কাফেরদের নিকট নিজেদের আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দিচ্ছে। মুসলমানদের নিকট আজ আখেরাতের মূল্য নেই।আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ›লা বলেন,গ্ধবলুন,দুনিয়ার সুখ সামান্য। আর যে তাকওয়া অবলম্বন করবে তার জন্য আখিরাত উত্তমগ্ধ।(সূরা নিসা-৭৭) মুসলমান আজ এই আয়াত অমান্য করায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে আর ধ্বংসের পরেই হয় পরিবর্তন। আল্লাহ বলেন,গ্ধযদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও,তবে তিনি তোমাদের স্থলে অন্য কোনো জাতীকে স্থলাভিষিক্ত করবেনাগ্ধ(সূরা মুহাম্মদ-৩৮) আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া সামান্য মাত্র।এ ব্যাপারে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর কসম!আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া হচ্ছেথথযেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রের জলে এই আঙ্গুল(তর্জনী) রাখলো অতঃপর তোমাদের কেউ যেন দেখে তার আঙ্গুল কতটুকু পানি উঠিয়ে আনতে পেরেছে। আজ দুনিয়া ও আখেরাতের এই পরিধির দৃষ্টিকোন থেকে আমরা। আমাদের পরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করতে হবে,দূর করতে হবে আমাদের ব্যাধি।

ব্যাধি থেকে পরিশুদ্ধতার উপায়ঃ ১.দুনিয়ার বোঝা থেকে ভারমুক্ত হওয়াঃদুনিয়ার সাথে সম্পৃক্ত অন্তর লুণ্ঠিত ভূমি মুক্ত করতে পারে না।দুনিয়া মুখী মানুষ কেবল নিজের জন্যই বেঁচে থাকে;কেবলই খাদ্য, পানীয়,প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিনোদন ও বিলাসিতায় মত্ত থাকে।এই অবস্থায় বিজয় অর্জন করা সম্ভব নয়।

২. সর্বদা মৃত্যুর কথা স্বরণ করাঃমৃত্যর স্বরণ কোনো দুঃখপূর্ণ বা নেতিবাচক বিষয় নয় বরং রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের অনুসরণ। মৃত্যুর স্বরণ সর্বদা নিজের কর্মকান্ডের হিসাব গ্রহণ, গুনাহ থেকে তাওবা করা,আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করে।

৩. ইলমি মজলিসে উপস্থিত হওয়াঃইলমে মজলিস বিজয়ের চূড়ান্ত একটি মাধ্যম।সর্বদা ইলমি মজলিস গুলোর উপস্থিতি যেকোনো মুসলমানকে পদস্খলন থেকে রক্ষা করে, ভুল-ত্রুটি থেকে বাঁচিয়ে দেয়, শরিয়তের জ্ঞান দান করে এবং সীরাতে মুস্তাকিমের পথে পরিচালিত করে।

৪.আকিদার ভিত্তিতে সমাজকে ঐক্যবদ্ধকরণঃএই বন্ধন হলো সেই বন্ধন,যা চিন্ন হবেনা;এটাই সেই বন্ধন,যাতে মহান আল্লাহ বরকত দিয়েছেন এবং সুদৃঢ় করেছেন।এই বন্ধন মুসলিম উম্মাহকে এক ছায়াতলে আবদ্ধ করে।

৫.গভীরভাবে রাসূল সাঃ এর জীবনী অধ্যয়ন করাঃরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনটাই হলো ইসলাম। তাঁর জীবনই কুরআনের বাস্তব নমুনা।তিনি নিজে সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন।আমরা রাসূলের জীবনী নিয়ে সঠিক ভাবে চিন্তা করলে,আমরা চিনে নেব,কে বন্ধু আর কে শত্রু;আমরা বুঝতে পারবো বিজয়ের মাধ্যম ও পরাজয়ের কারণসমূহ।

৬.উম্মাহর গর্বিত ইতিহাস জানাঃনবীগণ থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী,তাবে-তাবেয়ী,সলফে সালেহীন এবং যুগে যুগে ঘটমান উম্মাহর বিজয় ইতিহাস জানতে হবে।তা আমাদের অন্তরে নতুন করে জেগে উঠার সাহস ও স্বপ্ন জোগাবে।

৭. আল্লাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্বহীনতাঃআল্লাহর শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন ইমানের দুর্বলতা ও আকিদার ভ্রষ্টতার ল²ণ। আল্লাহ বলেন,গ্ধহে মুমিনগণ,তোমরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে,সে নিশ্চয়ই তাদের একজন।নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম স¤প্রদায়কে হিদায়াত দেননা।সুতরাং তুমি দেখতে পাবে,যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে,তারা কাফিরদের মাঝে(বন্ধুত্বের জন্য)ছোটাছুটি করছে।(সূরা মায়িদাহ-৫১)

৮. আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকাঃআল্লাহর সাহায্য কেবল তাদের জন্যেই,যারা তার ফায়সালায় সন্তুষ্ট থাকে এবং তাঁর ব্যাপারে আস্থাশীল। অপরদিকে আল্লাহর ফয়সালায় অসন্তুষ্ট,ক্রুদ্ধ লোকদের সাহায্যের সমীকরণে কোনো স্থান নেই।

৯. সময়কে যথাযথ কাজে লাগানোঃগম্ভীর ও গুরুত্বপূর্ণ জীবনে এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট হতে পারে না।রাসূলের জীবনে একটি মিনিটও অযথায় ব্যয় হয়নি।যথাযথ পরিকল্পনা ও সঠিক পদ্ধতি ছাড়া কেউ উঁচু স্তরে পৌঁছাতে পারেনা।তাই প্রত্যেক মুসলমানকে সময়ের মূল্যায়ন করতে হবে,যথাযথ ভাবে সময়কে কাজে লাগাতে হবে।

১০. সর্বত্র জিহাদের শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়াঃপ্রচুর তথ্য সন্ত্রাস,মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ও বিভিন্ন ট্যাগ যেমন,উগ্রপন্থা,চরমপন্থ,ব্রেইন ওয়াশড,জঙ্গি ইত্যাদি লাগানোর ফলে বর্তমানে অনেক সাধারণ মুসলিম ‹জিহাদ› শব্দ শুনলেই ভয় পায়।এইজন্য শরয়ী দৃষ্টিকোন থেকে জিহাদের মূল শিক্ষা ও প্রতিপাদ্য বিষয়টা সর্বত্র তুলে ধরতে হবে।কারণ জিহাদ হলো মর্যাদাপূর্ণ শ্রেষ্ঠ আমল।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,›আমি জিহাদের সমতুল্য কোনো আমল পাইনি›। (সহীহ বুখারীঃ২৭৮৫)

সবিশেষ উল্লেখ্য যে,নিজেদের পাপ-পঙ্কিলতা মোচন করতঃ সকল ব্যাধি দূর করতে হবে।মুসলিম উম্মাহকে নতুন করে বিশ্ব জয়ের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। নিজেদের ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনতে আমাদের দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন,আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন