বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল), বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মতো সরকারি সব সংস্থাকে নিজেদের টাকায় চলতে হবে। নিজেরা যে টাকা আয় করে, সেই টাকা দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। গত ৪ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই নির্দেশ দেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনায় জনপ্রত্যাশাই প্রতিফলিত হয়েছে। ব্যাংক-বিমা, টেলিযোগাযোগ, পর্যটন খাতে বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালিত হতে পারে না। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বেশকিছু বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। সন্দেহ নেই, নির্দেশনাগুলোর মধ্য দিয়ে তার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতাই ফুটে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের মানুষের উপকার হবে, তারা কৃতার্থ হবে।
একথা ঠিক যে, লাভ করতে হলে সরকারি কর্মকর্তাদের আয়েশি ভাব ছেড়ে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টার পর্যন্ত অফিস করতে হবে, সর্বসাধারণের সাথে ভাল ব্যবহার করতে হবে। বেসরকারি মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাস্টমার কেয়ারে একজন সুইপার তাকেও কোনো সার্ভিস চাইতে গেলে সেখানে কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ভদ্র, মার্জিত তরুণ স্যার বলে সম্বোধন করে থাকে। আর সরকারি অফিসে কোনো সেবা নিতে গেলে মনে হবে জীবনে অনেক পাপ করেছি, আজ তার খেসারত দিতে এসেছি! সরকারি চাকরিজীবীরা জনগণের চাকর নয়, নিজেদের মালিক মনে করেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কর্মক্ষেত্র যেনো নানা-দাদার জমিদারি।
সরকারি প্রতিষ্ঠান মানে জনগণের প্রতিষ্ঠান। সরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান না থাকলে দেশের অতি মুনাফাখোর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের সেবা ও পণ্যমূল্য নির্ধারণে চরম অবিচার করে থাকবে। এজন্য দেশের সরকারি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান থাকা জরুরি। একনেকের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যথাযথই বলেছেন, ‘কোম্পানিগুলো তো ব্যবসা করছে, তাহলে নিজস্ব অর্থে পরিচালিত হতে পারবে না কেন?’ বিটিসিএল, ব্যাংক, বিমা, বিমান, ইসুরেন্সসহ সরকারি যেসব কোম্পানি রয়েছে, সেগুলোর আয় করা অর্থ থেকে উন্নয়ন কাজ করার কথা বলে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আর কতদিন তাদের ভর্তুকি দিতে হবে?’ আমরাও মনে করি, সরকারি সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থেই পরিচালিত হওয়া উচিত। এটা কোনো কথা হতে পারে না যে, সরকারি সংস্থাগুলো উন্নয়ন কাজের জন্য সরকারি অর্থের দিকে চেয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে উদ্ধৃতি দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলো তো নিজেরা আয় করে। তাহলে যে টাকা আয় করে, সেই টাকা দিয়ে কেন চলতে পারে না? কেন সরকারের দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়? সরকারি সংস্থাগুলোকে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো এবং স্বাবলম্বী হওয়ার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি কোষাগার থেকে সংস্থাগুলোকে টাকা দেওয়া হবে না বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।’
আমরা দেখছি, এদেশে শুধু নীতিকথাই চলে, কিন্তু নিয়মনীতিমত কাজ চলে না। ইতিমধ্যে দেশের চিনিকলগুলো লাকসান গুনতে গুনতে রুগ্ন হয়ে পড়েছে । ফলাফল সাধারণ শ্রমিকদের চোখের পানিতে ভাসিয়ে ‘মৃত্যু পরোয়ানা জারি।’ রোগী মারা গেলেই রোগ দূর হয় না। এই রোগ নামক ‘দুর্নীতি-লুটপাটে’ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোরও যে মৃত্যু ঘটাবে তা নিশ্চিত! যেমনিভাবে জ্বর মূলত কোনো রোগ নয়, সব রোগেরই লক্ষণ মাত্র, রোগের কারণ থাকে অন্য। রোগের যেমন লক্ষণ দেখেই ডাক্তারগণ চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন না। কত কারণে যে মানুষের শরীরে জ্বর হয় তার হিসাব করা কঠিন। কিন্তু কারণ খুঁজে বের করেই তার নিরাময় করতে হয়। সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, ৬টি চিনিকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে। লোকসানের বেঝো রাষ্ট্রের পক্ষে আর বহন করা সম্ভব নয়।
রোগের যেমন লক্ষণ দেখে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত না দিয়ে কারণ অনুসন্ধান করেন বিজ্ঞানীরা, তেমনি জীবন ও সমাজের সব ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য। রাষ্ট্রীয় কারখানার ক্ষেত্রে লোকসান হলো রোগের লক্ষণ, কিন্তু দেখতে হবে, রোগটা কী এবং রোগের কারণ কী? রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে আর একই পণ্য বা সেবা প্রদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফার পাহাড় গড়ছে। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লাভজনক হওয়ার নজির আমাদের আশপাশের দেশগুলোতেই রয়েছে। সীমিত আয়তনে বিপুল জনগোষ্ঠী এবং ক্রমবর্ধমান ভোক্তার এই দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হতে পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পারবে না কেন?
সরকারি সংস্থাগুলো কীভাবে চলবে, এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘আপনি ব্যবসা করবেন, সেখানে তো আমি গিয়ে বুদ্ধি দিতে পারি না। আপনি ব্যবসা করেন, তাই আপনিই বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করুন। সকাল-সন্ধ্যায় যদি মন্ত্রী-সচিবেরা সংস্থাগুলোকে বুদ্ধি দিতে যান, সেটা নিশ্চয়ই ভালো দেখাবে না।’ পরিকল্পনামন্ত্রীর এ কথা ঠিক মনে করে আমরা বলতে চাই, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের লোকসানি হওয়ার নেপথ্যে কোনো নীতিনির্ধারণী দুর্বলতা আছে কি না, থাকলে সে দায় কার? এ ছাড়া বেসরকারি খাতে লোকসান হলে সেটা উদ্যোক্তা, দায়িত্বশীল কর্তকর্তা বা ব্যবসায়ীর দায় হিসেবে থেকে যায়। কিন্তু সরকারি কল-কারখানা বা সেবা-প্রতিষ্ঠানে লোকসান হলে তার দায় কারো ওপর চাপে না।
সরকারি কল-কারখানায় শ্রমিকদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হয়েছে সব সরকারের আমলেই। এই দখলদারি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সব আমলেই হয়েছে। লোকসানের জন্য শ্রমিকদের দায়ী করে তাদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু শ্রমিকেরা তো কারখানা পরিচালনা করে না। পাটকল বা চিনিকল পরিচালনা করেন কর্তাব্যক্তিরা। কর্তাদের পরিচালনা করেন মন্ত্রী-সচিব। তাহলে কারখানগুলো যদি হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনে থাকে, তার দায় কেবল শ্রমিকেরা কেন নেবে? কেন মন্ত্রী-সচিব, এমডি-চেয়ারম্যানরা নেবেন না? কেন শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দেয়ার আগে কারখানার ব্যবস্থাপক তথা পদাধিকারীদের গোল্ডের হ্যান্ডশেক দেওয়া হবে না?
বেসরকারি কারখানায় সিবিএর দৌরাত্ম্য নেই। যে কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনবলও নেই। সিবিএ না থাকার কারণে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করে না। কোনো কোম্পানিকে লাভজনক করতে প্রথমেই দরকার উন্নত ব্যবস্থাপনা। সরকারি করপোরেশনগুলোয় এ দিকটায় কখনোই তেমন মনোযোগ দেয়া হয় না। কথায় আছে। ‘সরকারি মাল, দরিয়ামে ঢাল’। অর্থাৎ কোনো জিনিস যদি রাষ্ট্রের হয়, তবে সেক্ষেত্রে লাগামহীন অপচয়-অপব্যবহার ঘটলেও কোনো সমস্যা নেই। অদক্ষ, অযোগ্য ও অসৎ কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দ্রুত বিদায় করার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসানের অন্যতম কারণ।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে প্রতিবছর জনগণের করের টাকা ব্যয় করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান লোকসান থেকে বের হতে পারছে না। কিন্তু একই খাত যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে গিয়ে পড়ে তখন তারা কিভাবে লাভবান করে? রাষ্টায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে থাকার বড় কারণ অনিয়ম, অদক্ষতা ও দুর্নীতি। এ ছাড়া চরম অব্যবস্থাপনা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে তুলেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনবল রিক্রুট থেকে শুরু করে পরবর্তী কার্যসম্পাদনে সমস্যা থাকে। এসব সংস্থায় শ্রমিকদের একটি বেপরোয়াভাব থাকে। কারণ জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে।
আমরা মনে করি, লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে একটি টাইমলাইন বেঁধে দেওয়া উচিত। নির্দিষ্ট সময়ে তারা ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। একই ধরনের বেসরকারি কোম্পানি যে খাতে মুনাফা করছে, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান দিচ্ছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি। তবে এর চেয়ে বড় কারণ জবাবদিহি না থাকা। আর যতটুকু আছে তা শুধু কাগজে-কলমে। মূলত অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক দলাদলি, বেশি জনবল, সিবিএর দৌরাত্ম্য, পুরাতন যন্ত্রপাতি, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মুখ দেখছে না।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোকসানের কারণের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব, কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক সংগঠনের হস্তক্ষেপ, অধিক জনবল নিয়োগ, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, মানসম্মত পণ্য উৎপাদনে ব্যর্থতা ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়। কোথাও কোথাও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি বা পরিবর্তন আসেনি। এসব প্রতিষ্ঠানের লোকসান দেয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আগে কিছু কারণ উল্লেখ করেছি। কোম্পানিগুলোকে লাভজনক অবস্থায় আনতে হলে প্রয়োজন উন্নত, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনা। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে লাভ হবে না। বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলেও ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ছাড়া কোনোক্রমেই এগুলো লাভজনক করা যাবে না । আমরা দেখতে চাই, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বাস্তবে কতটা মেনে চলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিতে পারেন, পথনকশা আঁকতে পারেন, কিন্তু বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায় সংশ্লিষ্টদের ওপর। সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক না হলে শুধু নির্দেশনায় যে কাজ হবে না, তা বলাই বাহুল্য।
লেখক: সংবাদকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন