শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

হালদায় মা-মাছের ডিমের প্রত্যাশিত ফলাফল কেন আসেনি -প্রফেসর ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া

বিশেষ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০২১, ১২:১৪ পিএম | আপডেট : ১২:৫৮ পিএম, ২৮ মে, ২০২১

দেশের অর্থনৈতিক নদী, মৎস্য ব্যাংক হালদা। নদীটিকে এ বছর বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করে সরকার। হালদার মৎস্য, জীববৈচিত্র্য, নদীর স্বাভাবিক গতিধারা সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নদীতীরে নৌ পুলিশের তদারকিতে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়।
অবৈধভাবে মাছ শিকার, বালু ও মাটি তোলা, নৌকার চলাচল বন্ধে প্রশাসন ঘন ঘন অভিযান পরিচালনা এবং জরিমানা করে। বিশেষত মা-মাছ সুরক্ষায় তৎপরতা ছিল আগাগোড়া দৃশ্যমান।

এশিয়ায় মিঠাপানির রুই কাতলা মৃগেল অর্থাৎ কার্প জাতীয় বড় মাছের প্রাকৃতিক বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। আল্লাহ কর্তৃক প্রকৃতির বিস্ময়কর দান হালদা নদী এবং তার মৎস্যরাজি ছাড়াও বহুমাত্রিক সম্পদ ও সম্ভাবনা।

অন্যান্য বছরের মতো সদ্য হালদার মা-মাছেরা ডিম ছেড়েছে। কিন্তু হালদায় মা-মাছের ডিম প্রত্যাশা অনুযায়ী এবার মিলেনি। প্রত্যাশিত ফলাফল কেন আসেনি?
এ বিষয়ে একটি প্রাসঙ্গিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন হালদা বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ড. মোঃ মনজুরুল কিবরীয়া। নিচে তা তুলে ধরা হলোঃ

গত ২৫ মে দিনগত রাত বারোটার সময় হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছ মৌসুমের প্রথমবারের মতো নমুনা ডিম ছাড়ে। একই দিন রাত ১টার সময় থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি টিম পানির গুনাগুণ পরীক্ষাসহ হালদা নদীর মাছের প্রজননের বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণ করে আসছে। ২৬ তারিখ দুপুর বারোটার সময় ব্রুড মাছ দ্বিতীয় দফায় নমুনা ডিম দেয়।
সর্বশেষ ২৬ মে রাত সাড়ে এগারোটার সময় থেকে স্থানীয় জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীরা ডিম সংগ্রহ শুরু করে।
এবছর হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা এবং হালদা নদী রক্ষায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী থেকে শুরু করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হালদার মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রকে নিয়ে অন্যরকম প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়। আমার দেখা বিগত ২১ বছরের মধ্যে হালদার পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং ব্রুড মাছ রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।

এতদসত্ত্বেও পরিবেশগত দুটো প্যারামিটার সব হিসাব নিকাশ উলটপালট করে দেয়। হালদা নদীর রুই জাতীয় মাছের ডিমের প্রত্যাশিত ফলাফল আসেনি। এর অন্যতম কারণ দুটি-
১. এপ্রিল থেকে জুন মাস হালদার রুই জাতীয় মাছের প্রজনন সময়। এই তিন মাসের মধ্যে প্রতি মাসের আমাবস্যা অথবা পূর্ণিমা তিথিতে ভারী বৃষ্টিপাত হলে পরে নদীতে মাছ ডিম ছাড়ে। কিন্তু এবছর এপ্রিল-মে দুই মাস অতিবাহিত হলেও হালদার নদীর উজান অঞ্চলে প্রত্যাশিত বৃষ্টি হয়নি, ফলে পাহাড়ি ঢল না আসায় নদীতে মাছের ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি।
২. মে মাসের চতুর্থ জো অর্থাৎ পূর্ণিমা তিথি ছিল ২৩ থেকে ২৯ তারিখ। এ সময় অল্প পরিমাণ বৃষ্টি হলে মাছের গোনাড পরিপক্বতার কারণে মাছ ডিম ছাড়ার জন্য তৈরি হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। একই সাথে হালদা নদীর জোয়ার-ভাটার নদী হওয়ার কারণে জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা অনেক বৃদ্ধি পায়।

এই জোয়ারের পানির সাথে হালদা নদীর পানিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটে। যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
পরিবেশগত এই দুটো বাধার কারণে হালদা নদীতে মাছের প্রজননের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ব্যাহত হয়। কিন্তু মাছের গোনাড এর পরিপক্বতার কারণে সামান্য অনুকূল পরিবেশ ডিম ছাড়তে বাধ্য হয়। যার জন্য হালদা নদীতে প্রচুর মাছের অবস্থান এবং দূষণ মুক্ত থাকা সত্ত্বেও রুই জাতীয় মাছ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যাশিত ডিম ছাড়েনি।
তবে আমরা আশা করছি হালদার লবণাক্ত পানির দূরীকরণের মাধ্যমে এবং উজানে প্রত্যাশিত বৃষ্টি হলে পরে হালদা নদীতে মাছ আবার দ্বিতীয়বারের মতো ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক টিম হালদা নদীতে মাছের প্রজনন সংক্রান্ত নিম্নোক্ত প্রাথমিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে।
এবছর ডিম ধরার নৌকার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি, যার সংখ্যা প্রায় ৩৫০ টির মতো। নদী থেকে সরাসরি ডিম সংগ্রহের লোকের সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এবছর প্রায় ৮০০ জন ডিম সংগ্রহকারী নদী থেকে সরাসরি ডিম সংগ্রহে অংশ নেয়।
প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির তথ্য অনুযায়ী এবারের সংগৃহীত ডিমের মোট পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কেজি।
গেল বছরে রেকর্ড

হালদা নদীতে গতবছর ২৩ মে আহরিত হয় ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম। যা বিগত এক যুগের সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২০১৯ সালে ৭ হাজার কেজি ডিম মিলে। ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল ২২ হাজার ৬৮০ কেজি (দশ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ), ২০১৭ সালে এক হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮শ’ কেজি, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে ৬২৪ কেজি, ২০১২ সালে এক হাজার ৬শ’ কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়।
উপযুক্ত পরিবেশ প্রকৃতি ও আবহাওয়ায় (‘জো’) ঝাঁকে ঝাঁকে রুই কাতলা মা-মাছ নদীর তলদেশ থেকে উঠে ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রাহক অভিজ্ঞ জেলেরা নৌকা ও জাল নিয়ে বিশেষ কৌশলে ডিম সংগ্রহ করেন। হালদার পাড়ে কুয়াগুলোতে নিয়ন্ত্রিত পানি ও তাপমাত্রায় ডিম থেকে রেণু, পোনা ফোটানোর পর বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ সারাদেশের পুকুর দীঘিতে সরবরাহ হয়। বিশেষজ্ঞ ও মাছ চাষিরা জানান, হালদার পোনার চাহিদা খুবই বেশি। কেননা এই ডিমে ফোটানো রেণু পোনা দ্রুত বর্ধনশীল। যা কম সময়েই ঢাউস সাইজের রুই কাতলা মাছে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে হালদা নদীর প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক অবদান কমপক্ষে ৮শ’ কোটি টাকার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন