মহামারিতে বেকারত্ব বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। কলকারখানা ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক মন্দার ছায়া বিস্তার করেছে বিশ্বব্যাপী। সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা থেকে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের নতুন কিছু চিন্তা করার সময় এসেছে। চাকরি করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার মাধ্যমেই চাকরি দেওয়া সম্ভব। সফল উদ্যোক্তা গতিশীল নেতৃত্ব দানের অধিকারী হয়ে থাকেন। উদ্ভাবনী শক্তির বলে তারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার নতুন উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ এবং তা ব্যবহার করে।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যদি বড় হন, তাহলে তারা আরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারবে। এ লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও নতুন করে সাজানো দরকার। ঘরে ঘরে স্নাতক তৈরি না করে আমাদের উদ্যোক্তা তৈরিতে নজর দেওয়া উচিত। অসম্ভবকে সম্ভব করতে ঝুঁকি নিতে পারে তারুণ্য। প্রথা ভাঙায় দুঃসাহস দেখাতে পারে তরুণরাই। সময়ের সঙ্গে বদলাচ্ছে এই দেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণ সমাজ। ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা বাড়ছে। তারুণ্যের শক্তি, সাহস আর পরিশ্রমের ফলে ব্যবসায় সাফল্যও পাচ্ছে তারা। ফলে বদলাচ্ছে দেশের অর্থনীতির আকার। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের। কর্মসংস্থানের একটি বড় অধ্যায় হল আত্মকর্মসংস্থান। যারা উদ্যোক্তা তারা কেবল নিজের দায় নেয় না, তারা সমাজের বড় দায়ও কাঁধে নেয়। আত্মকর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তি নিজের কর্মসংস্থানের চিন্তা করে কাজে হাত দেয়। একজন আত্মকর্মসংস্থানকারী ব্যক্তি তখনই একজন উদ্যোক্তায় পরিণত হবে, যখন সে নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সমাজের আরও কয়েকজনের কর্মসংস্থানের চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করে। ঝুঁকি আছে জেনেও এগিয়ে যায় এবং একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি করে উদ্যোক্তারা। বিভিন্ন প্রকল্পে অনেক তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে। উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের মানসিকতা বদলাতে হবে। চাকরি করব না, উদ্যোক্তা হবো, এই মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। এতে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশও লাভবান হবে।
ব্যবসার রয়েছে বিভিন্ন ধরণ। কেউ কেউ পণ্য কেনা-বেচা বা আমদানি-রপ্তানি করে। কেউ পণ্য উৎপাদন করে বিপণনের ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন বিষয়ের উপর ব্যবসার সাফল্য নির্ভর করে। এসব বিষয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যবসায়িক কলাকৌশল, পদ্ধতি ও নিয়ম-কানুন। ব্যবসা শুরু করার পূর্বে এসব জানা প্রয়োজন। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ব্যবসায়িক পরিবেশের সকল উপাদান অনুকূল না হলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উন্নতি লাভ করে টিকে থাকা কঠিন। যে ব্যক্তি দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার সাথে ফলাফল অনিশ্চিত জেনেও ব্যবসা স্থাপন করে ও সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে, তিনি ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা বা শিল্পোদ্যোক্তা। ব্যবসার উদ্যোগ এবং ব্যবসা উদ্যোক্তা শব্দ দুটি একটি অন্যটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যিনি ব্যবসায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনিই উদ্যোক্তা। সঠিক দিকনির্দেশনা, মূলধন ও সম্পদের প্রাচুর্য তা নিয়ে ভাবনা ও পরিকল্পনা একটি সুষ্ঠ কর্মপরিকল্পনা পর্যায় ক্রমে একজন উদ্যোক্তা/ব্যবসায়ীকে তার লক্ষ্যের দিকে পৌঁছতে সাহায্য করে। মূলধন ও সম্পদ ব্যবসার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলেও মুখ্য বিষয় নয়, কেননা সঠিক দিকনির্দেশনা অনুযায়ী অগ্রসর না হলে তাতে বিনিয়োগের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।করোনা ভাইরাসের প্রকোপে উদ্যোক্তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। তাদের জন্য আলাদা আর্থিক প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনে উদ্যোক্তাদের আগের লেনদেন বিবেচনা করে ঋণ দিতে। তবে উদ্যোক্তাদের ব্যাংকে যেতে হবে। কোনো কারণে উদ্যোক্তারা প্রথমবার ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার কারণ খুঁজে দ্বিতীয়বার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে হবে। প্রকৃত উদ্যোক্তারা নিজেদের ভুল অকপটে স্বীকার করে এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। নিজের অভিজ্ঞতা ও অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং নিজের কর্মক্ষেত্রে সেই শিক্ষার প্রয়োগ উদ্যোক্তার একটি বিশেষ গুণ। সফল উদ্যোক্তা তাদের কাজের সাফল্যে পরিতৃপ্তি ও অসীম আনন্দ পান। ব্যবসায় একবার ব্যর্থ হলে ব্যর্থতার কারণগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে হতাশ হওয়ার পরিবর্তে শিক্ষা গ্রহণ করে নতুনভাবে কাজ শুরু করার মধ্যে ব্যবসায়ের সাফল্য নিহিত। সুষ্ঠু ব্যবসা পরিকল্পনা প্রণয়ন ব্যবসায় সাফল্য অর্জনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সঠিক ব্যবসা পরিকল্পনা প্রণয়ন। ব্যবসায় হাত দেওয়ার পূর্বে ব্যবসার কাজ কখন এবং কীভাবে করা হবে তা অগ্রিম চিন্তা করে পরিকল্পনা করতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেছেন, ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তা সাপ্লাই চেইন এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তৈরিতে মেন্টর ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তাদের গাইড লাইন প্রদানের জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ২০০ জন মেন্টর তৈরি করা হবে। আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে ইনোভেশন ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে। যাতে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পোদ্যোক্তা সমন্বিতভাবে কাজের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজ আরও ত্বরান্বিত হবে। বাংলাদেশে ২০৩০ সালে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। তাই এখন থেকেই আমাদের চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ খুজতে হবে। উদ্যোক্তা হওয়ার পূর্বশর্ত হলো নিজের মধ্যে সৃজনশীল মানসিকতা লালন করা। আমাদের বাস্তবতা এমন, যেখানে একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষের পক্ষে উদ্যোক্তা হওয়া কঠিন। কারণ তারা চাকরির পেছনে ছোটেন। স¤প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ফজলে কবির তরুণদের চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা হতে বলেছেন। দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই ক্ষুদ্র উদ্যোগের ওপরই আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত। শিক্ষাব্যবস্থাকে সেভাবেই ঢেলে সাজানো উচিত। একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি চাকরি করে রাষ্ট্রকে হয়তো বছরে ২০ হাজার টাকা রাজস্ব দেবেন, কিন্তু তিনি যদি উদ্যোক্তা হন, তাহলে অন্তত ১০ জন মানুষকে নিয়োগ দিতে পারবেন। এতে যেমন তার জীবনের নিরাপত্তাহীনতা দূর হবে, তেমনি ওই ১০ জনও চাকরি পাবেন। প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তা তৈরির অনেক সুযোগ আছে। শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার লক্ষে এ মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তরসম‚হ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার লক্ষে মন্ত্রণালয়ের তত্ত¡াবধানে সংশ্লিষ্ট আইন, নীতিমালা, বিধিমালা প্রণয়নসহ সময়ে সময়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এ মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কর্তৃক শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ এবং শ্রম আইন যথাযথভাবে প্রতিপালনের বিষয়টি প্রতিনিয়ত মনিটর করা হচ্ছে। শ্রম অধিদপ্তর কর্তৃক শ্রমিকদের সংগঠন সংক্রান্ত বিষয়াদি, সালিশী কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি দেখভাল করা হয়। সমগ্র দেশে বিস্তৃত সাতটি শ্রম আদালত এবং একটি শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত দাবী, ক্ষতিগ্রস্থ শ্রমিকদের আইনী প্রতিকার পাওয়ার বিষয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। ন্য‚নতম মজুরী বোর্ড প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন সেক্টরে মজুরী নির্ধারণের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ করার মাধ্যমে শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা পালন করছে। সর্বোপরি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন দপ্তরসম‚হের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে সুসংহত ভ‚মিকা পালনসহ যুগপোযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারি সকল পর্যায়ে কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবধরণের আইন ও পরিবেশগত উদ্যোগ ও বিনিয়োগ একান্ত আবশ্যক। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি নীতিমালা, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। সর্বোপরি শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার সুরক্ষা, সুষ্ঠু মালিক-শ্রমিক সমন্বয় ও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিতের লক্ষ্যে এ মন্ত্রণালয় প্রতিনিয়ত আইন, বিধিমালা নীতিমালা প্রণয়ন করছে এবং তা যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পরিবর্তন ও সংস্কার করা দরকার।
সরকারের উচিত হবে, নীতি সহযোগিতা দিয়ে উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়ানো। প্রথমত, কোন কোন খাতে উদ্যোক্তা তৈরি করা সম্ভব, তার একটি বাস্তব সম্মত জরিপ করতে হবে। এর ভিত্তিতে সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোক্তা তৈরির কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সারা দেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হবে।
লেখকঃ নিবন্ধকার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন