ডা. মাও. লোকমান হেকিম
যে কোন শস্যের ভালো ফলন নির্ভর করে মানসম্মত বীজের ওপর। সময়মত বীজের সহজ প্রাপ্যতার বিষয়টিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল ভালো বীজ পাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা রয়েছে তেমনিই সময়মত সঠিক দামে বীজ সংগ্রহ করাও চাষীদের পক্ষে প্রায়শ কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। তাই কৃষির উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। কৃষি আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কৃষক আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারিগর। কৃষি খাতে সমৃদ্ধি মানে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া। ক্ষুধার বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতে যাওয়া। কৃষি ও কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। অথচ কৃষিতে উৎপাদনী সাফল্যের প্রধান উপকরণ ভালবীজ। ভাল বীজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বাংলাদেশের মত কৃষি প্রধান দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। কিন্তু কৃষিনির্ভর অথনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ভাল বীজের মত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপকরণের সরবরাহ ও ব্যবহার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
এদেশের কৃষিতে যে পরিমাণ বীজ ব্যবহার হয় গড়ে তার প্রায় ২০% আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে সরবরাহ হয়। অবশিষ্ট ৮০% বীজ আসে কৃষকের বাড়িতে সংরক্ষিত উৎস থেকে। সাধারণত কৃষকেরা ফসলের একটি অংশ বীজ হিসেবে সংরক্ষণ ও পরবর্তী মৌসুমে ফসল উৎপাদনের জন্য বীজ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, কৃষকের বাড়িতে সংরক্ষিত এসব বীজের মান খুবই দুর্বল যা থেকে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায় না। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, শুধুমাত্র মানসম্পন্ন বীজ এককভাবে ১৫-২০% পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধিতে এবং প্রায় ১০% পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয় কমাতে সহায়তা করতে পারে। সর্বোপরি ভালো বীজের ব্যবহার কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশাল অবদান রাখতে পারে।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুরুষের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের প্রশংসনীয় অবদান স্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশগুলোতে কৃষির সাথে বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীদের মতো এত নিবিড় সম্পর্ক আর কোথাও দেখা যায় না। বিশেষ করে এ দেশে ফসলের বীজ ব্যবস্থাপনার প্রায় সবটুকু দায়িত্বই তারা সুচারুভাবে পালন করে থাকেন। ফসল বীজ নির্বাচন, বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ, বীজ সংরক্ষণ এমনকি বাড়িতে ছোট-খাটো বীজ ব্যবসাও পরিচালনা করেন বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীরা। এভাবে অনাদিকাল থেকে সকলের দৃষ্টির অগোচরে তারা দেশের কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। সুতরাং বীজ উন্নয়ন বিষয়ক সকল কর্মকা-ে গ্রামীণ নারীদের সক্রিয় অংগ্রহণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য।
তাদের এ কর্মকা- এককভাবে ক্ষুদ্র মনে হলেও সামগ্রীক বিবেচনায় গ্রামীণ নারীরাই হচ্ছেন বাংলাদেশে ফসলের বীজের সর্ববৃহৎ যোগানদার। বাংলাদেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রামীণ এ নারীদের শ্রমশক্তি সুর্নিদিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগানো সম্ভব হলে কৃষি অর্থনীতিতে ঘটতে পারে বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন। বলাবাহুল্য বাংলাদেশে ভালো মানের বীজ সংকট এদেশের কৃষি উন্নয়নের প্রশ্নে সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভালমানের বীজের অভাবে কৃষকেরা অর্থ বিনিয়োগ ও সর্বোচ্চ শ্রম দান করেও কাংক্ষিত ফসল উৎপাদন সফল হয় না। সুতরাং বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করে গ্রামীণ নারীদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাদেরকে উৎসাহিত ও প্রশিক্ষিত করা হলে দেশে বিপুল পরিমাণ ভালমানের বীজ উৎপাদন হবে। পাশাপাশি গ্রামীণ নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নসহ সামাজিক অবস্থানও শক্তিশালী হবে। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ বীজ ঘাটতি মোকাবিলার পাশাপাশি ক্রমঃসংকুচিত প্রচলিত রপ্তানী খাতের বিকল্প বিবেচনায় অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে বীজ রপ্তানী বাণিজ্য খুলে দিতে পারে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার। তাইতো বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ‘যদি তুমি জানো যে আগামীকাল কেয়ামত হবে আর যদি আজ তোমার হাতে কোন বীজ বা চারাগাছ থাকে, তবে রোপণ কর।’
য় লেখক : চিকিৎসক, কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন