আব্দুল্লাহ আল শাহীন
অচেনা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেয়াটাই প্রবাস জীবন। তাছাড়া, নিজের আশপাশের ঘটে যাওয়া অনেক কিছুকেই এড়িয়ে চলার অভ্যাস করার মনমানসিকতা তৈরি করা হচ্ছে একজন প্রবাসীর প্রথম সফলতা। দ্বিতীয় সফলতা হচ্ছে সুন্দর একটি স্বপ্নকে চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তৃপ্তি পাওয়া এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সকল পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাই হচ্ছে প্রবাসীর চলার গতিবেগ। বিপদ-আপদে কিংবা দুঃখ-কষ্টে থমকে যাওয়ার মধ্যে প্রবাসীর পরিচয় ফুটে উঠে না বরং এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই প্রবাসীর পরিচয় ফুটে উঠে। শুধু প্রবাসী কেন যে কারো থমকে যাওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে যুবকদের সকল বাধাকে ধৈর্য এবং সাহসের সাথে মোকাবেলা করে জীবনযুদ্ধে বিজয়ের নেশায় এগিয়ে যেতে হবে।
ঈদ মানে খুশি ঈদ মানে আনন্দ। দুনিয়ার মুসলমানের জন্য দুই ঈদ অনেক আনন্দের। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার সাথে মুসলমানের ঐক্যের নমুনা জড়িত। ঈদের দিনে গরিব-ধনি, ছোট-বড় সবাই আনন্দ করে। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের সাথে হাসিখুশি ভাগাভাগি করে। পবিত্র রমজানে মহান রাব্বুল আলামিনের হুকুম মুতাবেক সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতর এবং জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফার মাঠে ফরজ হজের বিদায়ী খুতবার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক হজ শেষে ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা। বিশ্ব মুসলিম আনন্দের সাথে পালন করে এই দুই ঈদ। তবে যারা নিজ দেশ থেকে বহু দূরে মানে প্রবাসে তাদের বেলায় ঈদ যেন অন্যরকম। বিশেষ করে যারা জীবনের চলার পথ সুন্দর ও সচ্ছল করতে প্রবাসে পারি জমান তাদের বেলায় ঈদের আনন্দ ও পরিবেশ ভিন্ন আমেজের। তারপরও ঈদ বলে কথা শত কষ্ট এবং ব্যস্ততার মধ্যে ঈদের খুশি টাচ করে প্রবাসীদের অন্তরে। হতে পারে খুশির পরিমাণ একটু কম। তবে এটা বাস্তব ঈদের আনন্দে প্রবাসীরা নিজেদের শামিল করেন নিজেদের করে। কেউ কর্মস্থলেই ঈদের জামায়াত আদায় করেন। আবার কেউ ঈদের জামায়াত আদায় করে কর্মস্থলে গিয়ে কাজে মিছে ঈদের আনন্দ খুঁজেন। নয়তো নামাজ আদায় করে বাসায় গিয়ে মোবাইল কানে লাগিয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে মুখে হাসি সচল রেখে দেশে মা-বাবা, ভাই, বোন কিংবা প্রিয়জনের সাথে কথা বলে ঈদের আনন্দ খুঁজেন।
বাংলাদেশ থেকে অনেক দূর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত যেখানে প্রায় ১০০ ভাগের জনসংখ্যার ৮ ভাগই বাংলাদেশী। আমরা যারা এখানে আছি আমাদেরও ঈদ পালন করা হয় তবে তা এক ভিন্ন মাত্রা আনন্দের, মানে- কিছু কষ্ট, কিছু আনন্দ, কিছু গ্লানি, কিছু তৃপ্তি, কিছু অতৃপ্তি, ত্যাগের মাধ্যমে আমাদেরকে ঈদ উদযাপন করতে হয়। তার সবচেয়ে বড় কারণ পাশে নেই মা বাবা আত্মীয়স্বজন নেই বাড়ির পাশের ঈদগাহ। অবশ্য বাড়ির পাশের ঈদগাহ থেকে আরো বড় ও মধুর কণ্ঠের নামাজের সুর রয়েছে তারপরও যেন অতৃপ্তি। নেই মায়ের হাত দিয়ে মুখে টেলিয়ে দেয়া সেমাই কিংবা অন্য কিছু। নেই বাড়ির আনন্দে মাতহারা শিশুদের চিকন কণ্ঠের চিৎকার। নেই বিবাহিতদের স্ত্রীর নরম হাতের গরম সন্দেশ। আমিরাতে অনেক উন্নত মানের মিষ্টি খেলেও ওই তৃপ্তি পান না বলে বিবাহিত প্রবাসীরা বলেন। অনুপস্থিত থাকে সেলামি দেওয়া নেওয়ার বিষয়। নেই নতুন জামা ক্রয়ের উৎসাহ তারপরও ক্রয় করতে হয় দেশ থেকে মা-বাবা বা দাদা-দাদির কিংবা স্ত্রীর অনুরোধে। কিন্তু এই ঈদ পোশাকে যে মজা কতটুকু লাগে তা টের পাওয়া যায় ঈদের দিন গায়ে দেওয়ার সময়।
ঈদের দু’চার ঘণ্টা আগ মুহূর্তে চাকরি থেকে এসে গোসল শেষে দু-একজন বন্ধুদের সাথে বা একা ঈদের নামাজে যাওয়া আর দেশে বাবার সাথে, চাচার সাথে, ভাইদের সাথে কিংবা সন্তানের হাতে ধরে যাওয়া এক নয় এক হতে পারে না। নামাজ শেষে কোলাকুলি রীতি সকল দেশে রয়েছে ভিন্ন পদ্ধতিতে মধ্যপ্রাচ্যে ঈদের নামাজ শেষে এই কোলাকুলি বা আরবদের চুমু খাওয়া অনেক তৃপ্তির ও ভাতৃত্বের এক সনদ ও বটে। নামাজ শেষে দেশে ফোন যখন করা হয় তখন অনেক প্রবাসীরা চোখের পানি সামলাতে পারে না। আবার অনেকে চোখের পানি সামলে নেয় কিন্তু মনের ভেতর যে কষ্টের বন্যা চলে তা থামাবে কে?
বিকেল বেলা কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে নানান শহর থেকে আসা পরিচিত আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করা হলো একজন প্রবাসীর সবচেয়ে বড় ঈদের আনন্দ। ঈদ বলে কথা তাই শত কষ্টের মধ্যে দুই ঈদে প্রবাসীরা নিজ জায়গায় থেকে অনেক আনন্দ করে তবে আনন্দের মাত্রা দেশ থেকে অনেকাংশ কম। ঈদ উপলক্ষে অনেকের ছুটি থাকে। আবার অনেকের ঈদের দিন বিকেলেই কাজে যেতে হয়। এই ছুটির মধ্যেই প্রবাসীদের ঈদের আমেজ পরিমাপ করা যায়। সংস্কৃতি ও পরিবেশের পার্থক্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীরা নিজেকে সামাল দিতে পারেন না আবার অনেকে নিজেকে সহজেই মানিয়ে নেন। প্রবাস জীবনে এই মানিয়ে নেয়ার মধ্যেই রয়েছে প্রবাসে বসবাসের নিজের অবস্থান।
ঈদের আনন্দোৎসব কিন্তু মুখ্য নয়। ঈদের পবিত্রতা রক্ষা করা হচ্ছে ঈমানী দাবি। প্রবাসে নিজেদের দেখভাল করতে হয় নিজেই অর্থাৎ নফছ হচ্ছে প্রবাসীর প্রশাসন। সঠিক পথে সঠিক মতে প্রবাসের আইন মোতাবেক জীবনযাপন করার মাধ্যমে স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করা উন্নত মানসিকতার কাজ।
আমরা প্রবাসীরা তখন দুশ্চিন্তাহীন থাকতে পারি যখন শুনি আমার আত্মীয়স্বজন এবং প্রিয় জন্মভূমির মানুষ নিরাপদে আছে। প্রবাসীদের মুখে হাসি ফুটে তখন যখন টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে শান্তির বার্তা শোনা যায়। যখন পরিবার থেকে বলা হয় আমরা খুব ভালো আছি, যখন বলা হয় তোমার উপার্জিত টাকা পেয়ে আমরা সচ্ছলতার সহিত চলছি। প্রবাসীরা তখন কষ্ট পায় যখন শুনে দেশে গুম-খুন, ডাকাতি, জুলুম- নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই কষ্ট ঈদে ছুটি না পাওয়ার কষ্ট থেকে বহুগুণ বেশি। এই কষ্ট ঈদে আপনজন কাছে না পাওয়ার চেয়ে বেশি। প্রবাসীরা নিরাপদ জনপদের বাংলাদেশ চায়। প্রবাসীরা সুন্দর সংস্কৃতির প্রিয় জন্মভূমি চায়। দেশের প্রতিটি মানুষের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত দেখতে চায়। প্রবাসীরা স্বপ্নের বাংলাদেশ চাইতে পারে কারণ প্রবাসীরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
য় লেখক : আরব আমিরাত প্রবাসী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন