শরীফুর রহমান আদিল
কোরবানির দিন থেকে আজ পর্যন্ত কোরবানি দাতা ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম নিম্ন হওয়ায় লোকসানের আশঙ্কায় হতাশ ছিলেন। কেননা, এ বছর কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে ট্যানারি মালিকরা যে খেলায় মেতে উঠেছে তাতে কারোই মন ভালো থাকার কথা নয়। কিছুদিন আগ থেকে সরকার ও ট্যানারি মালিকদের সাভারে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে রেশারেশি চলছিলো আর তখন থেকেই এ বছর চামড়ার দাম নিয়ে জনসাধারণের মাঝে এক ধররেন শঙ্কা তৈরি হয়েছিল। গত ৯ সেপ্টেম্বর চামড়া শিল্প মালিকরা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেন যেখানে গরুর চামড়া ৪০-৫০ টাকা, খাসির চামড়া ২০-২২ টাকা ও বকরির মূল্য ১৫-১৭ টাকা। আর এ ঘোষণা দিলেও ফড়িয়ারা অনেকে চামড়া কিনেছেন ঘোষণাকৃত দামের চেয়েও অনেকটা কম দামে আবার কারো কারো চামড়া রয়ে গিয়েছে অবিক্রিত অবস্থায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফকির, গরিব-মিসকিনসহ অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানসমূহ। কোরবানি দাতা, গরিব-মিসকিন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এ বছর কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন তা একটু দেখা যাক, গত বছর যে চামড়ার দাম ছিল ২ হাজার টাকা এ বছর সে চামড়ার দাম হলো মাত্র ৫০০ টাকা! যদিও এ বছর চামড়ার দাম নির্ধারণে গত বছরের থেকে পার্থক্য ছিল কেবলমাত্র ৫-১০ টাকা কিন্তু কোরবানি দাতারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৫০০ টাকা!
ভাবতে বড় কষ্ট লাগে, যেখানে বিত্তবানরা সরকারের কোটি কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয় তাদের বিষয়ে কোন সুরাহা হয় না সুরাহা হলো ফকির-মিসকিনদের হক ধ্বংসের! বিষয়টি গরিব-মিসকিন আর দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সম্পদ হওয়ায় কেউ এ নিয়ে প্রতিবাদও করেনি। আর যাদের এই টাকাটা পাওয়ার কথা তারা তো সহজ-সরল আর নিরীহ তাদের প্রতিবাদ করারও কোন পথ নেই। বারবার তাই আক্ষেপ লাগে এই ভেবে, আমরা কি আমাদের বিলাসী জীবন কিংবা মুনাফার জন্য আমাদের গরিব-দুখী সকলকে অভুক্ত রাখতে হবে? চামড়ার বাজারের এই দরপতনের জন্য ব্যবসায়ীরা তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেন যথা : আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার মূল্যের দরপতন, লবণের দাম বেশি ও রমজানের পর থেকে কোরবানির আগ পর্যন্ত সংগ্রহকৃত চামড়া অবিক্রীত থেকে যাওয়া। অথচ ব্যবসায়ীদের দেওয়া তিনটি কারণ জনসাধারণের মাঝে কৌতূহল আর সন্দেহ সৃষ্টি করছে কেননা, সরকার হাজারীবাগের ট্যানারি মালিকদের তাদের প্রতিষ্ঠান সাভারে স্থানান্তের প্রক্রিয়ার শুরু করার নির্দেশনা দিলেও ২০-৩০টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা কর্র্ণপাত করেনি ফলে উচ্চ আদালত গত আগস্টের ১২ তারিখ থেকে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে দৈনিক ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার বিধান করে রায় প্রদান করেন এবং শিল্পসচিবের ভাষ্য মতে, গত ১৬ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৫৫ লাখ ৯০ হাজার লাখ টাকা জরিমানার টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়। এখন প্রশ্ন উঠে এতো টাকা তারা কোথা থেকে জরিমানা প্রদান করবে? তারা কি নিজেদের ভিটে-মাটি বিক্রি করে সরকারকে মাসে মাসে ৩ লক্ষ টাকা করে জরিমানা প্রদান করবে? নাকি এই জরিমানার টাকা আদায়সহ জরিমানার টাকার সুদে আসলে নিয়ে নিজেদের ব্যবসা তুঙ্গে নেওয়ার জন্য এবারের চামড়ার দাম সর্বনিম্নে ঘোষণা করেছেন? ঐদিন মালিক পক্ষ লবণের দাম দ্বিগুণ হওয়া, মাল অবিক্রীত থাকাসহ নানা অভিযোগ তুলছেন। তবে ব্যবসায়ীরা যাই বলেন না কেন এটা যে এক ধরনের প্রতারণা ও ষড়ষন্ত্র তা অনেকের কাছে স্পষ্ট। চামড়ার এ বছর যে অল্পমূল্যে ব্যবসায়ীরা ক্রয় করেছেন এখান থেকে কি সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে? এ বছর চামড়ার দাম যেভাবে কমেছে তার ফল কি জনগণ ভোগ করবে? এবার কি জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট কিংবা মানিব্যাগর দাম কমবে? কারণ যেখানে এসব পণ্য উৎপাদনকারী উপাদানের মূল্য কম তবে উৎপাদিত পণ্যের দামও তো কমে আসার কথা, বাস্তবতা হলো কখনোই আমরা দেখি না এসবের দাম কমতে, বরং প্রতিবছরই এসব পণ্যের দাম বাড়ছে জ্যামিতিকহারে তবে কেন চামড়ার এই পানির দর?
ব্যবসায়ীদের প্রথম অভিযোগ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম ২০ শতাংশ দরপতন হয়েছে অথচ রহফবী সঁহফর.পড়স-এর মতে, গত ৬ মাসে চামড়ার দামের কোন পরিবর্তন হয়নি! অন্যদিকে চীনসহ আরো কয়েকটি দেশ ব্যবসায়িক পলিসির কারণে এ ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে এই হিসেবে চামড়ার দাম আরো বেশি হওয়ার কথা আর যদি চামড়ার দাম কমই হতো তবে কি বর্হিবিশ্বের কয়েকটি সংস্থা আমাদের দেশে অন্যান্য লাভজনক খাত বাদ দিয়ে এ ব্যবসায় পরিচালনার জন্য বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করতো? অন্যভাবে বলা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশে পশু কোরবানির সংখ্যা ১ কোটি ৬৫ লাখ বললেও এবার এ সংখ্যা আরো কম। আর কোরবানির জবেহকৃত পশুর চামড়া থাকে অন্যান্য সময় জবেহকৃত পশুর চমড়া থেকে ভালো ও উন্নত। যদি অনুন্নত চামড়া বেশি দামে কিনতে পারা যায় তবে উন্নত চামড়ার দাম কেন নিম্ন হবে?
ব্যবসায়ীরা তাদের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে গত রমজান থেকে সংগৃহীত চামড়া এখনো থেকে যাওয়া কে দায়ী করলো কিন্তু প্রশ্ন হলো গত রমজান মাস থেকে এ পর্যন্ত কতগুলো চামড়া সংগ্রহ করা গেছে? যদি কোরবানির সময় ৭০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ করে তবে বাকি ১১ মাসে কী পরিমাণ চামড়া সংগ্রহ করে তা সহজেই অনুমেয়। ১১ মাসে ৩০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ করলে তবে প্রতিমাসে সংগ্রহের গড় প্রায় ৩% আর দুইমাসে ৬%! এই ৬% চামড়া থেকে যাওয়ার জন্য এবারের পশুর চামড়ার দাম কমবে ৮৫%! কি অদ্ভুদ হিসাব। আবার গত ২ মাসের অবিক্রীত থাকায় ক্ষতির পরিমাণ কত? এ ক্ষতি কি দিনে ১০,০০০ কিংবা মাসে ৩০০০০০ টাকার চাইতেও বেশি? ব্যবসায়ীদের যে মনোভাব দেখা গেছে তাতে তারা সাভারে খুব সহসাই কিংবা ১০,০০০ টাকা জরিমানার ভয়ে স্থানান্তরিত হওয়ার কোন লক্ষণ আপাতত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তবে কি তারা লোকসান নিয়েই এ ব্যবসা চালিয়ে যাবে? নাকি এখানে রয়েছে বড়কোনো শুভঙ্করের ফাঁকি এ প্রশ্ন এখন সকল জনসাধারণের।
কিছু অসাধু ও অনৈতিক ব্যবসায়ী গরিব-মিসকিনদের টাকা নির্লিপ্তভাবে আত্মসাৎ করতে তৈরি করেছে লবণের কৃত্রিম সংকট। সরকারের উচিৎ ছিল লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী সিন্ডিকেট খুঁজে বের করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা কিন্তু সরকার সেটি না করে উল্টো এসব ব্যবসায়ীদের সাথে সুর মেলালো! অথচ এ বছর লবণ ৭০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ২১ লাখ মেট্রিক টন অথচ এর আগের বছর লবণ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১৮ লক্ষ টন! তবুও লবণের সংকট, আর এ অজুহাতে দাম বৃদ্ধি? সরকার কোরবানির ২ মাস আগ থেকে লবণের কৃত্রিম সংকটসৃষ্টিকারীদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিলে এ সংকট সৃষ্টি হতো না। যেভাবেই সমীকরণ মিলানোর চেষ্টা করি না কেন ফলাফল কেন জানি বারবার শূন্যই হয়। তাই মনের ভিতরে একটি কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে আর তা হলো ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য কি কেবল ও একমাত্র মুনাফা? আর তা করতে গিয়ে যদি ভিক্ষুক কিংবা ফকিরের মুখের আহারও কেড়ে নিতে হয় তাই করতে হবে? এদেশে এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থে গরিব-মিসকিনদের ভিক্ষা দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে ব্যবসা করতে হবে!
এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে, পূর্বে চামড়া ও কোরবানির উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য তৈরি করা যেতো এখন এসব কাঁচামাল দিয়ে পণ্য তৈরি হচ্ছে আরো ৫ গুণ বেশি পণ্য। আর উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ওষুধসহ চিকিৎসার কতিপয় ষন্ত্র। আর নিত্যনতুন স্টাইল ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাদুকা, ব্যাগসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ছে দৈনন্দিন তাও আবার জ্যামিত্যিকহারে আর এসব পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০% তবুও কেন চামড়ার দাম কমবে? শুধুমাত্র চামড়া দিয়ে বাংলাদেশ যদি পাদুকা আর ট্রাভেল ব্যাগ তৈরি করে তবে বাংলাদেশ শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র থেকে আয় করতে পারবে প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি ১২ লাখ মার্কিন ডলার (যা চামড়া রপ্তানির ৮%)। আর এ চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে দেশের মোট তৈরিকৃত পাদুকার ৩০ শতাংশ জাপানের উন্নত কোম্পানিগুলোতে বাংলাদেশ পাদুকা রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে বাকি ৬০ ভাগ বিক্রি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে। গত পাঁচ বছরের হিসাবে দেখা গিয়েছে যে, বাংলাদেশ যে পরিমাণ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেছে তা প্রতিবছরই বৃদ্ধি পেয়েছে তবু চামড়া শিল্পমালিকদের নানা অজুহাত।
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যে পরিমাণ প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানির চাহিদা রয়েছে তা বাংলাদেশ সারাবছর যতগুলো চামড়া অর্জন করে তা তার অর্ধেক অর্থ্যাৎ বিশ্বে চামড়ার চাহিদা রয়েছে দ্বিগুণ কিন্তু তারপরও কেন এ অজুহাত? এ পরিস্থিতি আরো কয়েক বছর চলতে থাকলে আমাদের চামড়ার বেশিরভাগ ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কেননা সেদেশ থেকে এদেশের আড়তদাররা পায় উচ্চমূল্য, খরচ হয় কম এবং টাকাটাও পায় সাথে সাথে। মনে রাখতে হবে, প্রতিবছর চামড়া বর্হিবিশ্বে রপ্তানি করে আমরা কোটি কোটি টাকা আয় করছি। এ হিসেবে অনেকের ধারণা পোশাক শিল্পের পরই স্থান দিতে হবে চমড়া শিল্পকে অন্যদিকে, বাংলাদেশে যতগুলো কওমী মাদরাসা রয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের খরচের প্রধান উৎস হলো এই কোরবানির চামড়া থেকে অর্জিত আয় আর এক্ষেত্রে সরকার একটু মনোযোগী হলে এটির মাধ্যমেই বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে আগামীর বাংলাদেশ, পূরণ হতে পারে উন্নত দেশের স্বপ্ন আর বাস্তবয়িত হবে ভিশন-২০৪১।
য় লেখক : প্রভাষক, দর্শন বিভাগ, ফেনী সাউথ ইস্ট ডিগ্রি কলেজ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন