শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

ঘুষ বাণিজ্যে হয়রানি ও অন্তহীন ভোগান্তির শিকার গ্রহীতারা

সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস

প্রকাশের সময় : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ শামীম শিরাজী, সিরাজগঞ্জ থেকে

সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এখন দুর্নীতিতে ভরে গেছে। অফিসের হেল্পডেক্স থেকে শুরু করে প্রতিটি দ্বারে দ্বারে, পদে পদে, অবাধে দুর্নীতি চলছে। বলা যায়, ‘টপ টু বটম’। ফলে দিনদিন গ্রহীতাদের হয়রানি ও ভোগান্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাকা ঘুষ না দিয়ে এ অফিস থেকে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দালাল চক্রের একটি সিন্ডিকেট অফিসের কতিপয় দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশে এ অপকর্ম চলছে। সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ গ্রহণের ঘটনা এখন তাই ‘ওপেন সিক্রেট’। এ যেন সকলের কাছে দিবালোকের মত পরিষ্কার। এসব জেনেও না জানার ভান করায় স্থানীয় প্রশাসনের উপর ক্ষোভ বাড়ছে ভুক্তভোগীদের। এব্যাপারে জেলার অভিজ্ঞ মহল উচ্চ পর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। পাসপোর্ট করতে আসা ভুক্তভোগী ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ অফিসে ঢুকতেই প্রধান ফটকে দ-ায়মান নিরাপত্তা কর্মীরা জানতে চান। কোথায় যাবেন? কি কাজে যাবেন। পাসপোর্ট করার কথা জানালেই অনেকেই তাদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করার প্রস্তাব করেন। অফিস রুমে ঢুকতেই রয়েছে আনসার বাহিনী। তারাও তাদের মাধ্যম পাসপোর্ট করতে উৎসাহিত করেন। হেল্পডেক্সে গেলেও কর্মচারীর কাছে কিছু জানতে চাইলে তারাও নাকি তাদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করার ফলপ্রসু সুবিধার কথা জানান। এরপর রয়েছে দালাল চক্র ও সিন্ডিকেট। নিজ চেষ্টায় এককভাবে কেউ পাসপোর্ট করতে পারছে-এমন অবস্থা এখন শূন্যের কোঠায়। পাসপোর্ট নিতে আসা গ্রহীতারা তাদের ভোগান্তির সব বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা জানান এ প্রতিবেদককে। অফিসের উত্তর পাশে গোপন কক্ষে নাকি রয়েছে অফিস কর্মচারীদের দালাল চক্র। তাদের কাছে গেলে ফরম পূরণসহ সব কাজ হয়ে যায়। অন্যথায় নানান অজুহাতে বারোটা বাজে পাসপোর্ট গ্রহীতাদের। একটু ভুল হলে, লেখা ঘষামাজা হলে, পুনরায় ফরম কিনে পূরণ করতে হয়। আবার ফরম আঞ্চলিক অফিসে না পাওয়া গেলেও ফটোকপির দোকানে সেটা উচ্চ মূল্যে ক্রয় করতে হয়। ফরম পূরণে ‘ফ্লুর্ড’ ব্যবহার চলবে না/তবে দালালের মাধ্যমে গেলে এটা কোন সমস্যাই নয়। কিছু বাড়তি টাকা গুনতে হবে এই যা। গেটে, ভেতরে, অফিসে ও বাইরে যে কোন দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করলে কারো কোন সমস্যা থাকে না। যারা নিজেরা ন্যায্যভাবে পাসপোর্ট করতে চায় তাদের নানাবিধ ভোগান্তি, এর আর কোন শেষ নেই। ভুক্তভোগীরা কাজিপুর উপজেলার আকরাম, কামারখন্দের তফিজ, রায়গঞ্জের শহীদ, বেলকুচির মোজাম্মেলসহ অনেকেই জানান, অফিসের ভেতরে সোহেল, বাইরে সালাম, বেলকুচিসহ অন্যান্য উপজেলার দালাল চক্র প্রকাশ্যে ঘুষ নিয়ে কাজ করছে। টাকা ঘুষ না দিলে চলে স্টিম রোলার। পাসপোর্ট গ্রহীতাদের অভিযোগের কমতি নেই। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় তারা জানান, কেউ কাগজপত্র জমা দিয়েও পাসপোর্ট পাচ্ছে না, কারো পুলিশ প্রতিবেদন ভাল আসেনি বলে পাসপোর্ট মেলেনি। পরে ঘুষ দিলে সব ঠিক হয়ে যায়। এ রকম আরও কত কী অভিযোগ। ভুক্তভোগীদের মতে, পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন হয়রানি আর ঘুষ, নামের বানান সংশোধনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা আর পদ্ধতিগত ত্রুটি। পাসপোর্ট ডেলিভারী ও ছবি সত্যায়িত করতে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির স্বীকার হন তারা। বলা যায়, সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের প্রতিটি পদে পদে দুর্নীতিতে ভরে গেছে। কাউকে কোন অভিযোগ দিলেও অভিযোগ আমলে নেয়া হয় না। উল্টো তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে নাজেহাল হতে হয়। পাসপোর্ট নিজে হাতে জমা দেয়া ও ছবি তোলাতেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ রয়েছে। দালালদের সিরিয়াল আগে চলে যায়। কেউ মুখ খুললে কর্মচারীদের ইশারা-ইঙ্গিত দিয়ে দালালরা কেটে পড়ে। ভুক্তভোগীরা পড়ে মহাবিপাকে। ঘটনায় এখানেই শেষ নয় স্থানীয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকের ৩টি পাসপোর্টের জন্য ৩ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে দালাল মো. আব্দুস সালাম খান। তিনি সাংবাদিককে জানান, প্রতি পাসপোর্টে এক হাজার টাকা করে অফিসে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের টাকা জমা হয় সহকারী হিসাব রক্ষক রেহেনা জেসমিনের কাছে। কার্যদিবস শেষে তা বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হয় নিজ থেকে উপরে। তিনি আরও জানান, এ টাকা না দিলে নানা রকম ভুল ধরে ফাইল ফিরিয়ে দেন। পুলিশ রিপোর্ট ভাল এলেও মামলা ও বয়স নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ফাইল চাপা রাখা হয়। টাকা না দিলে ফিঙ্গারিং ও ছবি উঠাতে কালক্ষেপণ করে। এ রকম নানান সমস্যার সৃষ্টি করে। তিনি আরও জানান, তদন্ত অফিসের জনৈক অফিসার নাকি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সমস্ত পাসপোর্ট নিজেই করে থাকেন। অন্য কেউ তার অংশে ভাগ নিতে পারেন না। সিরাজগঞ্জ শহরের বড়গোলাপট্টির (মুজিব সড়ক) মো. আব্দুস সালাম খানের তথ্য মতে প্রতি পাসপোর্টে এক হাজার সেলামী দিতে হয়। এ হিসাবে সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এর সূত্রমতে সহকারী পরিচালক ফাতেমা বেগম গত ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট-২০১৬ পর্যন্ত তার ১৪ মাসের কার্যদিবসে প্রায় ২০ হাজার ৭২৭টি পাসপোর্ট জমা ও বিতরণ করেছেন। সে হিসাব মতে ১৪ মাসে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ঘুষ আদায় হয়েছে। এব্যাপারে সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক ফাতেমা বেগমের সাথে কথা বলতে গেলে জানা যায়, তিনি ঈদের ৬ দিন সরকারি ছুটির সাথে আরও তিনদিন যোগ করে ৯ দিনের ছুটিতে বাড়ি গেছেন। ঈদের আগের গুরুত্বপূর্ণ ৩ দিনের ছুটিতে অসুস্থ, মুমূর্ষু রোগীরা তাদের জরুরি পাসপোর্ট করতে চাইলে কিভাবে তা সম্ভব হবে-এ প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে উল্টো তাকে (উপ-পরিচালক) ফোন করে বলেন, অফিসে সাংবাদিক এসেছে। পরে অফিসের সহকারী হিসাব রক্ষক রেহেনা জেসমিন তার ফোনে ফাতেমা বেগমের সঙ্গে এ প্রতিবেদককে কথা বলান। প্রতিবেদক উপরোক্ত অভিযোগের কথা জানালে এসব ঘুষ দুর্র্নীতির কথা অস্বীকার করে জানান, এব্যাপারে আমার কাছে কোন অভিযোগও আসেনি। সহকারী হিসাব রক্ষকের কাছে প্রতি পাসপোর্টে এক হাজার টাকা ঘুষ জমা হয় কিনা এ প্রশ্নের জবাবে রেহেনা জেসমিন জানান এসব মিথ্যা কথা। এদিকে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক জনৈক ব্যক্তি জানান, কামারখন্দ উপজেলার অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান পাসপোর্ট অফিসের দালাল মো. আব্দুস সালাম খান বড়গোলাপট্টিতে বাসা ভাড়া নেন। এরপর সে ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে যান’। দালালীর মাধ্যমে সে এখন কোটিপতি। শহরে জায়গা কিনে ৫ তলা বাড়ি করেছেন। তার সম্পদের হিসাব-নিকাশ নিলে থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসবে। শুধু সে কেন এ অফিসের অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী এমনকি আনসার পর্যন্ত উৎকোচ গ্রহণ করছে। অনেক আনসার বছরের পর বছর রয়ে গেছে। কেউ বদলি হলেও এখানে এসে দালালী করছে। এজন্য তাদের ৬ মাস পর পর বদলির ব্যবস্থারও সুপারিশ করেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি। সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পাশে দিয়ার ধানগড়া গ্রামের পঞ্চায়েত কমিটির নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক জনৈক ব্যক্তি জানান, উপরোক্ত অভিযোগগুলো সত্য। বিভিন্ন গ্রামের অসহায় মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এ অফিসে এসে। অন্যান্য দালালদের পাশাপাশি হজ এজেন্সিগুলোও এ দালাল পেশায় যুক্ত হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন, তিনি জানান, অফিসে আউড সোর্সিং ও সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অসাধ্য সাধন করে থাকেন। এগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। তাহলে পাসপোর্ট গ্রহীতাদের দুর্ভোগ কমবে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যভাবে পাসপোর্ট করতে পারবে। সিরাজগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মো. মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদকে পাসপোর্ট অফিসের ঘুষ-দুর্নীতি ও পাসপোর্ট গ্রহীতাদের হয়রানির ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এগুলো আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগও দায়ের করেননি। অভিযোগ পেলে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন