উত্তর কোরিয়ায় সম্প্রতি নতুন একটি আইন পাশ হয়েছে, যার উদ্দেশ্য যে কোন ধরণের বিদেশি প্রভাব প্রতিহত করা। এই আইনে বলা হয়েছে - কেউ যদি ভিনদেশি সিনেমা দেখে, ভিনদেশি পোশাক পরে, এমনকি গালিও দেয়, তবে তাকে কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
কল্পনা করুন তো, আপনি টানা লকডাউনের মধ্যে আছেন, কিন্তু আপনার ইন্টারনেট নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঢোকার সুযোগ নেই। আপনার তথ্য পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম গুটিকয়েক রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেল - যেগুলো আপনাকে সেটাই শুধু বলে, যেটা দেশের নেতারা আপনাকে শোনাতে চায়। এই হলো উত্তর কোরিয়ার জনজীবন। আর এখন কিম জং-আন নতুন এক আইন দিয়ে আরও চেপে ধরতে চাইছেন, যে আইনটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা’ রুখে দেয়ার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে বলে বর্ণনা করা হচ্ছে উত্তর কোরিয়ায়। এখন কেউ যদি দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা কিংবা জাপানী কোন ভিডিও'র বড় চালানসহ ধরা পড়েন, তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কেউ যদি ওই ভিডিও দেখা অবস্থায় ধরা পড়েন, তবে তার শাস্তি ১৫ বছরের কারাদণ্ড।
আর এই আইন শুধু লোকে কী দেখবে আর কী দেখবে না - সেটা নিয়ে নয়। সম্প্রতি কিম রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে পাঠানো এক খোলা চিঠিতে ইয়ুথ লিগের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন তরুণদের ‘অস্বাস্থ্যকর, স্বতন্ত্রবাদী, সমাজতন্ত্রবিরোধী আচরণ’কে রুখে দেয়। তিনি বিদেশি ভাষা, পোশাক এবং চুলের ছাঁট বন্ধ করতে চান। এগুলো তার চোখে ‘বিপজ্জনক বিষ’। সোলের একটি অনলাইন প্রকাশনা দ্য ডেইলি এনকে খবর দিচ্ছে, কে-পপ তারকাদের মতো চুলের ছাঁট ও গোড়ালি পর্যন্ত খাটো ট্রাউজার পরার অভিযোগে তিনজন কিশোরকে প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় এই পত্রিকাটির নিজস্ব সূত্র আছে। তবে বিবিসির তরফ থেকে খবরটিকে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায়নি।
এসবের কারণ কিম এমন এক যুদ্ধে লিপ্ত যার জন্য পারমানবিক অস্ত্র কিংবা কোন ক্ষেপণাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। বিশ্লেষকদের মত, তিনি বাইরের তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছতে দিতে চান না, কারণ উত্তর কোরিয়ায় জীবনযাত্রা দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠছে। লাখ লাখ মানুষ সেখানে খাদ্যাভাবে আছে বলে ধারণা করা হয়। এরকম পরিস্থিতিতে মি. কিম নিশ্চিত করতে চান, এশিয়ার অন্যতম ধনী শহর সোলের ঝাঁ চকচকে কে-ড্রামার পাত্রপাত্রীদের জীবনযাত্রা দেখানোর পরিবর্তে উত্তর কোরিয়ার জনগণকে খুব সতর্কতার সাথে প্রস্তুত করা প্রোপাগান্ডা গেলানো হোক।
মহামারি ঠেকাতে গত বছর উত্তর কোরিয়া সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার পর দেশটি বহির্বিশ্ব থেকে আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি বিচ্ছিন্ন। প্রতিবেশী চীন থেকে জরুরি পণ্যের আমদানি ও বাণিজ্য বলতে গেলে স্থবির হয়ে আছে। যদিও কিছু সরবরাহ আসছে, কিন্তু আমদানি খুবই সীমিত। স্বেচ্ছা আরোপিত এই বিচ্ছিন্নতা দেশটির ব্যর্থ অর্থনীতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। এ বছরের গোঁড়ার দিকে কিম নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, তার জনগণ ‘নিকৃষ্টতম অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে’। ‘এতে বলা আছে, যদি একজন শ্রমিক ধরা পড়ে, তাহলে কারখানার প্রধানকেও কারাদণ্ড দেয়া যাবে। যদি একটি শিশুর সমস্যা থাকে তাহলে তার পিতামাতাকেও সাজা দেয়া যাবে,’ - বিবিসিকে বলেন দ্য ডেইলি এনকের প্রধান সম্পাদক লি স্যাং ইয়াং। তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়ার তরুণদের যদি দক্ষিণের প্রতি বিন্দুমাত্র আকাঙ্ক্ষাও থাকে, এতটুকু স্বপ্নও থাকে মনের গহীনতম কোনে, তাহলে তা ‘ভেঙে-গুড়িয়ে’ দেয়াই আইনটির উদ্দেশ্য।
গত বছর যেসব পক্ষ ত্যাগকারী উত্তর কোরিয়া থেকে বেরিয়ে আসার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তাদের একজন চই জং-হুন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘সময় যত কঠিন হয়, বিধি-বিধান, আইন ও শাস্তি তত কঠোর হয়।’ তিনি বলেন, ‘মনস্তাত্বিকভাবে, আপনার পেট যখন ভরা থাকে তখন আপনি যদি একটি দক্ষিণ কোরিয়ার সিনেমা দেখেন, সেটা আপনার অবসর বিনোদন হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু যখন সেখানে খাবারই নেই, টিকে থাকাটাই দুষ্কর, মানুষ তো তখন অসন্তুষ্ট হবেই।’
এর আগের অভিযানগুলো প্রমাণ করেছে যে, চীনা সীমান্ত হয়ে আসা বিদেশি চলচ্চিত্র দেখার ক্ষেত্রে এখানকার মানুষ কতটা করিৎকর্মা। চইয়ের মতে, অনেক বছর ধরে সেখানে নাটকগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ইউএসবি স্টিকের মাধ্যমে। এসব ইউএসবি স্টিক এখানে খুব সহজলভ্য। এগুলো লুকিয়ে ফেলা সহজ এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে এনক্রিপ্ট করা যায়। ‘আপনি যদি পরপর তিনবার ভুল পাসওয়ার্ড দেন, তাহলে ভেতরের ফাইল স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যাবে। আপনি এমনকি এমনভাবে পাসওয়ার্ড সেট করতে পারবেন, যে একবার ভুল পাসওয়ার্ড দিলেই ফাইল মুছে যাবে। এমনও অনেক ঘটনা আছে যেখানে একটি নির্দিষ্ট কম্পিউটারেই ইউএসবি স্টিকটির ফাইলটি খোলা যাবে। এটি আপনি অন্য কম্পিউটারে খুলতে পারবেন না, ফলে কাউকে দিতেও পারবেন না।’
ইয়ুন মি-সো স্মরণ করেন, তার প্রতিবেশীরা সিনেমা দেখার জন্য কী না করেছেন! তারা একবার একটি গাড়ির ব্যাটারি ধার করে এনেছিলেন। তারপর সেটাকে একটি জেনারেটরের সাথে যুক্ত করেছিলেন টেলিভিশন চালানোর জন্য। তিনি একটি দক্ষিণ কোরিয়ার নাটক দেখার কথা স্মরণ করেন, যেটির নাম ‘স্টেয়ারওয়ে টু হেভেন’ বা স্বর্গের সিঁড়ি। এটি ছিলো একটি প্রেমের গল্প, যেখানে একটি মেয়ে প্রথমে তার সৎ মায়ের সাথে লড়াই করে এবং পরে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে। এই নাটকটি কুড়ি বছর ধরে উত্তর কোরিয়ায় ভীষণ জনপ্রিয়।
এটি সে সময়ের কথা যখন চীন থেকে আনা সস্তা সিডি ও ডিভিডির কল্যাণে ভিনদেশি গণমাধ্যমের প্রতি আসক্ত হয় উত্তর কোরিয়ার মানুষ। তখনই পিয়ংইয়ংয়ের শাসকেরা বিষয়টি লক্ষ্য করেন। চই স্মরণ করছিলেন, ২০০২ সালে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে তল্লাশি চালিয়েই কুড়ি হাজার সিডি জব্দ করেছিল। কিম জিউম-হিউক বলছেন, ২০০৯ সালে তাকে যখন আটক করা হয়েছিল, তখন তার বয়স মোটে ১৬। অবৈধ ভিডিও ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে গঠিত একটি বিশেষ বাহিনী তাকে আটক করে। তার অপরাধ ছিল তিনি তার এক বন্ধুকে দক্ষিণ কোরিয়ার পপ সঙ্গীতের কিছু ডিভিডি দিয়েছিলেন। ডিভিডিগুলো তার বাবা চীন থেকে নিয়ে এসেছিলেন। তার সাথে একজন প্রাপ্তবয়স্ক বন্দীর মতো আচরণ করা হয়েছিল। তাকে একটা গোপন কামরায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। তাকে ঘুমাতে দেয়া হয়নি। তাকে টানা চার দিন ধরে ক্রমাগত লাথি ও ঘুষি মারা হয়েছিল, বলছিলেন তিনি।
জিউম-হিউক পিয়ংইয়ংয়ের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা শেষ পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছিলেন। কিন্তু কিমের নতুন আইনের আওতায় এভাবে কাউকে ছাড়িয়ে আনা এখন প্রায় অসম্ভব। ওই সময়ে ধরা পড়া অনেককেই শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু এটাকে যথেষ্ট মনে না হওয়ায় শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে, উত্তর কোরিয়ার কোন কোন বন্দীশিবিরের আকার গত বছর বাড়ানো হয়েছে। চই বিশ্বাস করেন কঠোর নতুন আইনের সাথে এর সম্পর্ক আছে। সূত্র: বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন