ব্রিটেন তার প্রাচীন শত্রু ফ্রান্সের তুলনায় একটি বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আরো সহনশীলভাবে গ্রহণ করেছে। গেল ৬ মে লন্ডন তার প্রথম লেবারপন্থী মুসলিম মেয়র সাদিক খানকে পুনর্নির্বাচিত করেছে। ব্র্যাডফোর্ড ওয়েস্টের এমপি নাজ শাহের মতো বেশ কয়েকজন তরুণ রাজনীতিবিদ ইসলাম ধর্মের আধুনিকতার প্রতিনিধিত্ব করছেন।
ব্রিটেনের প্রথম দু’টি মসজিদের একটি ১৮৮৭ সালে লিভারপুলে এবং অন্যটি ১৮৮৯ সালে ওকিংয়ে আরো বৃহৎ পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে দেশটির ৩ মিলিয়নের বেশি মুসলিমের জন্য ২ হাজার মসজিদ রয়েছে। ব্রিটেনের বø্যাকবার্নের ব্যাস্টওয়েল জেলার মতো বেশ কয়েকটি ঘন মুসলিম বসতিপূর্ণ অঞ্চলে একই রাস্তায় বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে।
তবে, দেশের বিভিন্ন স্থানের মুসলিম সম্প্রদায়গুলো বিস্তৃত ব্রিটিশ সমাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে এবং তারা ইসলামের উগ্র সংস্করণে বিশ্বাসী। বিশেষ করে ইয়র্কশায়ার এবং ল্যাঙ্কাশায়ারের পুরাতন মিল শহরগুলোতে বিষয়টি খুব বেশি প্রকট। জায়গাগুলোতে এখন সমান্তরাল সমাজ ব্যবস্থা চলছে, যেখানে চরমপন্থায় বিশ্বাসীরা স্বাভাবিক জীবন ধারার সংস্পর্শ এড়িয়ে নিজস্ব ইসলামি আদর্শ ও শাসন ব্যবস্থায় জীবনযাপন করে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে স্থানগুলোতে কী ঘটছে? এবং বৃহত্তর সমাজের সাথে তাদের সম্পর্ক কী? এসব জায়গায় একটি শ্রেণী আধিপত্য করছে। মসজিদগুলো ইসলামী আইন আরোপ করে স্কুলসমূহ পরিচালনা করছে। রেস্তোঁরাগুলো বসবার ক্ষেত্রে ‘পরিবারের জন্য নির্ধারিত আসন’-এর নামে ভদ্রভাবে লিঙ্গ বিভাজন করছে। তারা ব্রিটিশ সংসদে নিজস্ব প্রার্থী পাঠিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে তাদের কট্টরপন্থী প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
রক্ষণশীল ব্রিটিশ দার্শনিক রজার স্ক্রুটনের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি থিসিস লেখক এবং আমেরিকাতে পররাষ্ট্র বিষয়ক কাউন্সিলসহ বেশ কয়েকটি থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের পক্ষে এড হুসেন এ পরিবর্তন সম্পর্কে আরো গভীরভাবে জানতে মসজিদের পরে মসজিদ পরিদর্শন করেছেন এবং অঞ্চলগুলোতে এমন সব দোকান দেখেছেন, যেগুলো সমকামীকে পাথর ছুঁড়ে মারতে বা স্ত্রীদেরকে পর্দাতে রাখা বা জিহাদ করার পক্ষে বিশেষ আলেমদের লেখা বই প্রদর্শন করা হচ্ছে। ওসামা বিন লাদেনের প্রিয় দার্শনিক সাইয়্যেদ কুতুবের লেখাও সেখানে প্রায়শই পাওয়া দেখা যায়।
এসব আলেমের বেশিরভাগেরই ধর্মান্ধতার শেকড় ব্রিটেন থেকে দূরে সউদী ওহাবীদের মধ্যে নিহিত। তারা তাদের সহিংস আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে ব্রিটিশ মসজিদগুলোতে অর্থ ঢালছে এবং তরুণ ব্রিটিশ মুসলিমদের সমস্ত ব্যয়বাহী বৃত্তি প্রদান করছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হ’ল এই গোষ্ঠীর মধ্যে দেওবন্দীদের গুরুত্ব। হুসেন দাবি করেন যে, দেশের অর্ধশতাধিক মসজিদ এখন ওহাবীদের এই দেওবন্দী আন্দোলনের অন্তর্গত, যা ভারতে শুরু হয়েছিল। এরা মানুষকে তাদের আদর্শের আলোকে ধর্মান্তরিত করে খিলাফতকে সম্পূর্ণরূপে পুনর্গঠন করতে চায়।
বর্তমানে ইয়র্কশায়ারের ঐতিহাসিক শহর ডিউসবারি হ’ল তাদের আন্দোলনের এবং বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংগঠন এবং ‘তবলীগী জামাত’-এর ইউরোপীয় রাজধানী। মানুষের আত্মার মধ্যে হস্তক্ষেপ করা ব্রিটেনের নীতি নয়। তবে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রথমটি হ’ল, সহনশীলতার প্রতি বৈরিতা। ওহাবী আলেমদের প্রচারিত ইসলামের মৌলবাদী সংস্করণ কেবল অসহিষ্ণুতাকেই প্রচার করে না, চরমপন্থাকেও উৎসাহ দেয়। দ্বিতীয় হ’ল, বৈচিত্র্যের প্রতি বৈরিতা। হার্ভার্ডের সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট পুটনাম প্রমাণ করেছেন, লোকেরা যদি মনে করে যে, প্রাপকরা তাদের থেকে দৃষ্টিকট‚ভাবে আলাদা, তখন তাদের প্রতি সরকারী সেবা বিষয়ক সমর্থন খুব দ্রুত হ্রাস পায়। ডিউসবারি এবং ব্র্যাডফোর্ডের সমান্তরাল সমাজ ব্যবস্থার থেকে আরও প্রকটভাবে ভিন্ন ধরনের হওয়া বেশ শক্ত কাজ।
তৃতীয় কারণটি আরও বিপজ্জনক। ব্রিটেনে ইসলামের সত্যিকারের রূপরেখা গ্রহণের সাম্প্রদায়িক লড়াই চলছে। তবে, ব্রিটেন মৌলবাদী বিশ্বাসকে প্রকৃত ইসলাম হিসেবে ভুল করে স্ব-ঘোষিত সম্প্রদায়ের নেতাদের প্রতি সমর্থন করছে।
ব্রিটেন রোচডেলে দারুল উলূমের মতো মৌলবাদী স্কুলগুলোকে সহ্য করছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের হাদীস মুখস্থ করা, স্ত্রীকে মারধর করা ও সমকামীকে পাথর ছুঁড়ে মারার জন্য জিসিএসই’র নির্দেশ অনুসরণ করা হয়। হুসেন উল্লেখ করেছেন যে, বহু মাদরাসাছাত্র তাদের মাদরাসাগুলোতে তুরস্ক এবং সউদী আরবের জন্য ক্রমাগত প্রশংসা এবং ব্রিটিশ ইতিহাসের সব নেতিবাচক বিবরণ শুনতে পায়।
ব্রেক্সিটের ধাক্কা অনেক সামাজিক এবং ভৌগলিক বিভাজনকে নিরাময় করার স্পষ্ট আকাক্সক্ষা তৈরি করেছে, যেগুলো ব্রিটেনকে যুদ্ধবাজ উপজাতিগুলোর মধ্যে বিভক্ত করার হুমকিস্বরূপ। হুসেন আকুল আবেদন করেছেন যেন, এই নিরাময় অভিযানে মসজিদ জগতের অন্তর্নিহিত ঘটনাপ্রবাহকে উপেক্ষা করা না নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন