শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

প্রজন্ম রক্ষায় সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ এখন মোবাইল ফোন। তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের জুড়ি নেই। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। এনড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। এই মোবাইল ফোন দিয়ে শুধু বার্তাই আদান-প্রদান করা যায় না, ছবি আদান-প্রদান করা যায়, ইন্টারনেটে বিভিন্ন বিষয়ে আপ, গেইম, ভিডিও, চ্যাটিং ইত্যাদি অনেক কিছুই করা যায়। ইন্টারনেট প্রযুক্তি যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিস্ময়ময় অগ্রগতি এনেছে। ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টগ্রাম, লিংকউইন, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব, হোয়াটস আপ, ইমো ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার মানুষের অশেষ উপকারে লাগছে। তেমনি এসবের অপব্যবহারে মানুষ ও সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার শুধু দূরকে নিকট ও পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দেয়নি, জ্ঞান, বিদ্যাচর্চা, শিক্ষা, গবেষণা, মানবকল্যাণ, সমাজকল্যাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য কর্মসংস্থানসহ নানা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। পক্ষান্তরে এসবের অপব্যবহারে নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়েনি, এমন কোনো অপরাধ, অপকর্ম, অশ্লীলতা ও অহিত নেই, যা তাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না। শিশু থেকে তরুণ, প্রায় কারো হাত মোবাইল ফোন ছাড়া নেই। তারা রাতদিন মোবাইল ফোন টেপাটিপি করছে। করোনাকারণে গত প্রায় দেড় বছর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। এই গোটা সময় তাদের গ্রাস করে নিয়েছে মোবাইল ফোন, ইন্টানেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কথায় বলে, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। এ ক্ষেত্রেও তার প্রমাণ রয়েছে। লেখাপড়া, খেলাধুলা, শরীর চর্চা, ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড না থাকায় তাদের মধ্যে খারাপ অভ্যাস, অশ্লীলতা ও অপরাধপ্রবণতা বিস্তার লাভ করছে। শিশু ও স্কুল পড়–য়ারা নানারকম ভিডিও, গেম, চ্যাটিং ইত্যাদির নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এক শ্রেণীর কিশোর ও তরুণ ইতোমধ্যেই উচ্ছন্নে গেছে। মাদকাসক্তি, ইভটিজিং, গ্যাং কালচার, টিকটক অপরাধ ইত্যাদিতে তারা অভ্যস্থ হয়ে গেছে।

বিরাজমান বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে দেশের সচেতন মানুষ রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়েছে। আজকে যারা শিশু, কিশোর কিংবা তরুণ, তারাই ভবিষ্যতে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে, পরিচালনা করবে। তারা যদি মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে ধ্বংসের পথে চলে যায়, তাহলে জাতির ভবিষ্যত কী হবে? সংঘবদ্ধ ইভটিজিং, কিশোরে গ্যাং কালচার সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, অশ্লীলতার ছড়াছড়ি, মাদকের রমরমা, টিকটকের নারী পাচার ইত্যাদি আলামত হিসাবে দেশ ও সমাজের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ ব্যাপারে এখনই সচেতন ও তৎপর না হলে সমূহ বিপদ ও বিপর্যয় কেউ ঠেকাতে পারবেনা। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণদের সুরক্ষায় পরিবারকে বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে হবে, ভূমিকা রাখতে হবে। প্রথমত, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সীমিত করতে হবে। যারা এসব প্রযুক্তির উদ্গাতা, তাদের দেশেও অনেকে সেটা করেছে। এক্ষেত্রে সরকারীভাবেও একটা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থাকা উচিৎ। দ্বিতীয়ত, পরিবারের শিশু, কিশোর ও তরুণ সদস্যরা কী করছে, কাদের সঙ্গে কথাবার্তা বা মেলামেশা করছে তার একটা তত্ত¡-তালাস বাবা-মা বা অভিভাবকদের করতে হবে। সন্তান-সন্ততির জন্য তাদের আরো সময় দিতে হবে, সখ্য বৃদ্ধি করতে হবে। তৃতীয়ত, পারিবারিকভাবে তাদের জন্য নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে। নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা আত্মসুরক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর শক্তি যোগায়। চতুর্থত, সামাজিক শৃংখলা ও শাসন এক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। আগে আমাদের সমাজে শৃংখলা ও শাসন এমন ছিল যে, কোনো শিশু-কিশোর কিংবা তরুণ এদিক-ওদিক করার সাহস পেতো না। কেউ করলে তার অভিভাবকদের সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। পঞ্চমত, কিশোর গ্যাং, টিকটক ইত্যাদির অপকর্ম ও অপরাধ দমনে আইনশৃংখলা বাহিনীকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। এইসঙ্গে ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি দেশে গড়ে তুলতে হবে।

কোনো উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও প্রযুক্তির ভালো দিক যেমন আছে তেমনি খারাপ দিকও আছে। ব্যবহারের ওপর তার ভালো-খারাপ নির্ভর করে। যে ছুরি দিয়ে চিকিৎসক অপারেশন করেন, সেই ছুরিই কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারে, যদি তা কোনো ঘাতক ব্যবহার করে। মোবাইল ফোনের কোনো দোষ নেই, দোষ নেই ইন্টারনেটের কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের। এদের যারা ব্যবহার করছে তাদের ব্যবহারের ওপর ভালো-খারাপ হচ্ছে। কাজেই, এসবের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বা নিয়মবিধি থাকা প্রয়োজন। অনেক দেশেই এই নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মবিধি প্রবর্তন করা হয়েছে। চাকরির ক্ষেত্রে ডোব টেস্ট বাধ্যতামূলক হওয়া যেমন প্রয়োজন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থীর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রফাইল, স্ট্যটাস, শেয়ার ইত্যাদি বিবেচনা করা উচিৎ। এতেও এসবের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কমতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, পরিবর্তনটা আনতে হবে মানুষের ভেতরে। শৈশব-কৈশরে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা, বাবা-মার ভালোবাসা, ঘনিষ্ট সাহচার্য নজরদারি, পারিবারিক-সামাজিক শাসন-বারন ইত্যাদি নবীন প্রজন্মের মধ্যে অন্তর্গত পরিবর্তন সাধন করতে পারে। পাঠ্যপুস্তকেও এমন নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে, যা তাদের চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। তখন লেখাপড়ার দিকে সবারই নজর দিতে বাধ্য হতে হবে। তারা আরও মনে করেন, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের প্রসার মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আসক্তি কমিয়ে দিতে পারে। মোট কথা, যে কোনো মূল্যে আমাদের নব প্রজন্মগুলোর সুরক্ষা জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সমন্বিত উদ্যোগ ও প্রয়াসের বিকল্প নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন