মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

বিনিয়োগ বাড়াতে হবে

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০২১, ১২:০২ এএম

কেউ বলে উচ্চাভিলাষী বাজেট, কেউ বলে নিজেদের পকেট ভারী করার বাজেট, আবার কেউ বলে গতানুগতিক বাজেট। তবে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় মানুষের জন্য বাজেট। আমাদের দেশের মতো অর্থনীতিতে বাজেটের ধারাবাহিকতার বাইরে যাওয়ার সুযোগও নেই। যাকে বলা যেতে পারে, ছকে বাধাঁ নিয়ম রক্ষার বাজেট। জীবন যেখানে করোনায় বিপর্যস্ত, সেখানে বাজেট হওয়া উচিৎ আয়- ব্যয়ের নিরিখে বাস্তবায়নযোগ্য। এটি মহামারী করোনার ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ের বাজেট। করোনার এই সময়ে বাজেটে বড় ঘাটতি সঙ্গত। দুই দফায় করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে এখন ধার করে হলেও মানুষের জীবন ও জীবিকা রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে, ব্যয় বাড়াতে হবে। আমাদের বাজেট জিডিপির ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির সাময়িক প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হয়েছে। এক বছর পার হলেও প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার এখনো ঘোষণা করেনি সরকার।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের ওপরে ধরা হয়েছে, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার, তা কীভাবে হবে বলা হয়নি। বিশেষ করে, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে এক জায়গায় আটকে আছে। যদিও চলমান মহামারী পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী অর্থবছরে বাজেটে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ। দেশের মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগই কর্মক্ষম। প্রতিবছর ২০ লক্ষাধিক মানুষ শ্রমবাজারে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, করোনার সময়ে দেশে নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। কাজ হারিয়ে অনেকে গ্রামে ফিরেছে। এমতাবস্তায় এবারের বাজেটটি দেশের সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা বিবেচনায় নিয়ে সাজানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী।

কৃষক, পেশাজীবী, শ্রমজীবী, দিনমজুর, ব্যবসায়ীসহ সব পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে ও প্রান্তিক পর্যায়ে অসহায় মানুষের সহায়তা বাড়াতে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ১ লাখ ৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, যা চলতি অর্থবছরে মূল ও সংশোধিত বাজেটে ছিল ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে ১২ হাজার ৪০ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। নতুন করে প্রায় ১৪ লাখ মানুষকে এর আওতায় আনা হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি প্রতিবেদন বলছে, ৪৬ শতাংশ ভাতাভোগী যোগ্য না হয়েও ভাতা নিচ্ছে। সঠিক লোকের কাছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সহায়তা পৌঁছাতে পারলে বাড়তি ব্যয় ছাড়াই ২৬ লাখ পরিবারের ১ কোটি ৭ লাখ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে তুলে আনা সম্ভব। সবচেয়ে বেশি অনিয়ম বা ভুল হয়েছে বয়স্ক ভাতার তালিকায়। শুধু আওতা বাড়িয়ে লাভ হবে না। ত্রুটিপূর্ণ তালিকা সংশোধনও দরকার। সামাজিক সুরক্ষা খাতের মধ্যে পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ও ভর্তুকি রয়েছে। বাস্তবে দরিদ্র মানুষের জন্য প্রকৃত বরাদ্দ দেড় শতাংশের মতো হবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত কতটা নাজুক, তা চলমান মহামারিতে ফুটে উঠেছে। স্বাস্থ্যের এ ভঙ্গুরতার মূল কারণও আমাদের জানা। বাংলাদেশে প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। ভিয়েতনামের মতো দেশে জিডিপির ৮ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়। আমাদের দেশে রাখা হয় মাত্র ১ শতাংশের আশপাশে। নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান খাতে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ২৯ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ৩ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। এছাড়া করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কমাতে টিকাদানে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ও জরুরি প্রয়োজন মেটাতে বাজেটে এবারও ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর পাশাপাশি গতবারের মতো এবারও স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা গবেষণা খাতে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সার্বিক জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নয়নে এই বরাদ্দ খুবই কম। আবার বরাদ্দ বাড়িয়েও লাভ নেই। খরচ করতে পারছে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন বিভাগের (আইএসইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের (জুলাই-এপ্রিল) ১০ মাসে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ২৫ শতাংশ। এ থেকে স্পষ্ট, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট ব্যবহারের সক্ষমতার অভাব রয়েছে। অথচ এই করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। কৃষি বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য একটি খাত, গত বছর করোনার প্রকোপে যখন জিডিপিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখা সেবাখাতসহ অন্যান্য খাতে ধস নেমেছিল, তখন কৃষিখাতই আমাদের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই বাজেটে এই খাতে বিশেষ নজর থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কৃষি খাতে প্রস্তাবিত বাজেটে মূল বাজেটের ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ নির্র্ধারণ করা হয়েছে। এর আকার ২১ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর ছিল ২০ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। মোট বাজেট বরাদ্দের হিস্যা কৃষিখাতে একই রয়েছে। টাকায় বেড়েছে মাত্র ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। বরাদ্দের প্রবৃদ্ধি একই রকম রয়েছে।

তবে আশার কথা হলো, সরকার এবারও বাজেটে কৃষিতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রেখেছে এবং এবারের বাজেটে শর্ত সাপেক্ষে দেশের উৎপাদিত সব ধরনের ফল, শাক-সবজি প্রসেসিং শিল্প, দুধ ও দুগ্ধজাতপণ্য উৎপাদন, সম্পূর্ণ দেশীয় কৃষি হতে শিশু খাদ্য উৎপাদনকারী শিল্প, কৃষিযন্ত্র উৎপাদনকারী শিল্পের জন্য ১০ বছরের করমুক্ত সুবিধা প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু প্রান্তিক কৃষকরা কতটুকু লাভবান হবে সেটি ভেবে দেখার বিষয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি করোনা-পূর্ব মুহূর্তে প্রকৃত অর্থেই উন্নয়ন অগ্রযাত্রার এক বিশেষ পর্যায় ছিল। প্রবৃদ্ধির এই আশাজাগানিয়া উন্নতির সুফল যদি দীর্ঘমেয়াদে পেতে চাই- তা হলে আমাদের সুদূরপ্রসারী ভাবনা, পরিকল্পনা, পদক্ষেপ ও উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ হতে হবে শিক্ষা খাতে। জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এমন মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে-যারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে নিজ নিজ দেশের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারবে। ইউনেস্কো এবং বিশেষজ্ঞদের মতে, কভিড-১৯ এর ফলে পারিবারিক অর্থসংকট, শিশুশ্রম, বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি, ঝরেপড়া, অপুষ্টিজনিত প্রতিবন্ধকতা ও বাল্যবিবাহের কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা খাতে বিগত দুই দশকে যে অগ্রগতি হয়েছে, তা বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হবে। তাই এই মুহূর্তে শিক্ষা খাতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। সব সময় শিক্ষা খাতের বাজেটে তথ্য প্রযুক্তি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকার এবারও অন্যান্য বিভাগ বা মন্ত্রণালয় যুক্ত করে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রেখেছে ৯৪ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালে ছিল ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা। বরাদ্দ বেড়েছে ৯ হাজার ১১৩ কোটি টাকা বা ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ।

জাতিসংঘের ইকোনোমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড পেসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৫টি দেশের মধ্যে জিডিপির তুলনায় শিক্ষা খাতের খরচে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম। প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের অর্জিত আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করা হয়েছে, তা শিক্ষার্থীদের ঘাড়েই বর্তাবে বলে আশঙ্কা করছে শিক্ষার্থীরা। এটি গুরুত্বসহকারে ভেবে দেখতে হবে। শিক্ষা বাজেটকে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। এখানে বিনিয়োগ করলে এক প্রজন্ম পরে এর সুফল পাওয়া যায়। গুণগত শিক্ষা জীবন ও জীবিকা-দুটোই নিশ্চিত করে। শিক্ষাখাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না করে একটি জাতি কখোনো টেকসই উন্নতি করতে পারে না। বাজেট তখনি সফল হবে যখন এর বাস্তবায়ন হবে। সুপরিকল্পনা ও সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজেটে বরাদ্দ অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য শিক্ষাখাতে জোড়াতালি না দিয়ে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের বিকল্প নেই। ২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। অর্র্থমন্ত্রী বাজেট ঘোষণার আগেই বলেছেন, মানুষ ও ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর বাজেট হচ্ছে। বাজেটেও তাই দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি কর ছাড় দেওয়ার পক্ষে অর্থমন্ত্রী। ফলে বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। উৎপাদন বাড়বে। এর প্রতিফলন দেখা যাবে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধিতে। তবে প্রবৃদ্ধি নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার কিছু নেই। আমাদের দেশে প্রবৃদ্ধি হলো কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। ফলে দেশে আশঙ্কাজনক হারে আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য বেড়ে গেছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
লেখক: পুঁজিবাজার বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন