আল-আকসা মসজিদ মুসলমানদের প্রথম কিবলা এবং ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। এই আল-আকসা মসজিদ এবং জেরুজালেম নিয়ে চলছে দীর্ঘ দিন থেকে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ। আল-আকসা এবং জেরুজালেম নিয়ে কেন এতো সংঘাত এবং যুদ্ধ-বিগ্রহ? এর মূলে একটি কারণ রয়েছে। কী সেই কারণ? এর কিছুটা বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে, আল-আকসা এবং জেরুজালেম নিয়ে ইতিহাসের আদিকাল থেকে চলে আসা সংঘাত-সংঘর্ষের মূল রহস্য। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে দুটি স্থানকে এবাদতকারীদের জন্য কেবলা করেছেন। একটি বায়তুল্লাহ তথা কাবাঘর এবং অপরটি হলো বায়তুল মোকাদ্দাস তথা আল-আকসা মসজিদ। পবিত্র কুরআন এবং হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুটি পবিত্র স্থানকে রক্ষণাবেক্ষণ এবং কাফেরদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখার খোদায়ী বিধান দু’রকম পরিলক্ষিত হয়। কাবা শরীফকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ গ্রহণ করেছেন, যার দরুন বায়তুল্লাহ বা কাবা শরীফের উপর কোনো অত্যাচারী কখনো আক্রমণ করে ধ্বংস করতে পারে নাই, বরং তারা নিজেরাই ধ্বংস হয়েছে। যেমন ইয়ামানের খ্রিস্টান বাদশা তার বিরাট হস্তী বাহিনী নিয়ে কাবা শরীফে আক্রমণ করতে চাইলে আল্লাহতায়ালা আবাবীল নামক ছোট ছোট পাখির সাহায্যে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। কিন্তু বায়তুল মোকাদ্দাস সম্পর্কে রাব্বুল আলামীনের নীতি ভিন্ন। বায়তুল মোকাদ্দাসের ক্ষেত্রে মহান রাব্বুল আলামীনের বিধান হলো, বায়তুল মোকাদ্দাসের অনুসারীরা যখনই আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হবে তখনই আল্লাহর আযাব হিসাবে বায়তুল মোকাদ্দাস তাদের হাত ছাড়া হয়ে যাবে এবং কোনো অত্যাচারী কাফের মুশরিকের দখলে চলে যাবে। আল্লাহর নবী হযরত সোলাইমান (আ.) কর্তৃক আল-আকসা মসজিদ পুনঃনির্মাণের পর থেকে এই বাস্তবতাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইহুদি-খ্রিস্টানগণ যখনই তাদের নবীগণের বিরুদ্ধাচরণ করেছে তখনই তাদের উপর কোনো জালেম বাদশা চড়াও হয়েছে এবং তাদের আল-আকসা থেকে বহিষ্কার করেছে, মসজিদকে ধ্বংস করেছে এবং মসজিদের মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। এ বিধান আল্লাহতায়ালা কেয়ামত পর্যন্ত বলবৎ রেখে দিয়েছেন এবং এই নিয়ম উম্মতে মুহাম্মদী তথা মুসলমানদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পবিত্র কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য এবং আল-আকসার দীর্ঘ ইতিহাস তাই প্রমাণ করে।
৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতের সময় মুসলমানগণ বায়তুল মোকাদ্দাস এবং জেরুজালেম বিজয় করেন। এরপর মুসলমান শাসকদের মধ্যে যখন বিভেদ এবং ক্ষমতার মোহ প্রধান্য পেয়ে বসে তখন ১০৯৬ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা আল-আকসাকে মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। আবার যখন গাজী সালাহ উদ্দিন আয়ুবীর মত বলিষ্ঠ ঈমানের অধিকারী মুসলিম সেনাপতির আগমন ঘটে তখন তিনি ১১৮৭ সালে আবার আল-আকসা এবং জেরুজালেম অধিকার করেন। এর পর থেকে নানা চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে ১৯১৭ সালে উসমানী খেলাফেতের পতনের মাধ্যমে জেরুজালেম এবং আল-আকসা চলে যায় ব্রিটেনের দখলে। ১৯৪৮ সালের পরে কিছুদিন আল-আকসা এবং জেরুজালেম আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এক সময় অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল তা দখল করে নেয়। বর্তমানে তার নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে আল-আকসা এবং জেরুজালেম।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমান, ইহুদি এবং খ্রিস্টান তিন ধর্মের কাছেই আল-আকসা এবং জেরুজালেম পবিত্র ভূমি। আমরা যেভাবে আল-আকসাকে আমাদের প্রথম কেবলা এবং মক্কা-মদীনার পরেই ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসাবে সম্মান করি, ইহুদি, খ্রিস্টানরাও আল-আকসা এবং জেরুজালেমকে তাদের ধর্মীয় তীর্থস্থান মনে করে। ইহুদিরা মনে করে, এই এলাকা তাদের আদি নিবাস এবং বাইবেলে বর্ণিত তাদের পূর্বপুরুষ আব্রাহাম তথা হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে যে পবিত্র ভূমি প্রদান করার কথা বলা হয়েছে সেই পবিত্র ভূমি। তারা মনে করে, পবিত্র আল-আকসার ভিতরে টেম্পল মাউন্টে তাদের গীর্জা রয়েছে।
ফিলিস্তিনের জায়গা-জমি জবরদখল করে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহেও উপরোক্ত কারণ বিদ্যমান। অর্থাৎ মুসলমানদের ঈমানী দুর্বলতা, বিভেদ এবং নৈতিক অধঃপতন। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে জেরুজালেম তথা ফিলিস্তিন তুর্কী উসমানী (অটোমান) সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৭৮ সালে ফিলিস্তিনে ৮৭% মুসলমান, ১০% খ্রিস্টান এবং ৩% ইহুদির বসবাস ছিল। এই সময়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানগণ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতেন। বিংশ শতাব্দির শুরু হতে ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদিরা ব্যাপক বিদ্বেষের শিকার হয়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে ইউরোপ জুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরি হয়। সেই সময় ইহুদিরা বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু হিসাবে মার খেতে থাকে। এ অবস্থা থেকেই ইহুদিরা মূলত তাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করার চিন্তা শুরু করে। ১৮৯৭ সালে একজন ইহুদি জার্নালিস্ট তিউবার হার্ডস ‘জায়োনিজম’ নামক একটি কনসেপ্ট তৈরি করেন। এই কনসেপ্টে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করার সুস্পষ্ট ধারণা ছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে বসবাস করতে শুরু করে।
১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন ছিল ব্রিটেনের দখলে। ১৯১৭ সালে বৃটিশরা ফিলিস্তিন তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পরই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তারা ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সহযোগিতা করবে। তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন, যা পরবর্তীতে ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ নামেই পরিচিতি লাভ করে।
১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালে অটোমান সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে মধ্যপ্রাচ্য ব্রিটেন এবং তার মিত্র ফ্রান্সের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়। ফিলিস্তিন চলে যায় ব্রিটেনের অধীনে। এর পর থেকে ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থেকে লাখ লাখ ইহুদি ফিলিস্তিনে আসতে থাকে। ১৯৩০ দশকে ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারে যে, ইহুদিরা ফিলিস্তিন দখল করে নিচ্ছে। ১৯৩৮ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা হয়ে যায় ৩০%। ইহুদিরা বিভিন্ন দেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ফিলিস্তিনে এসে ব্রিটিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিদের জায়গা জমি দখল করে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে। অন্য দিকে শিক্ষা, কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা শক্তি অর্জন করতে থাকে। ফিলিস্তিনিদের জায়গা জমি জবরদখল করে টিকে থাকার জন্য তারা সামরিক শক্তিও অর্জন করে। ফিলিস্তিনিরা ইহুদি আগ্রাসন প্রতিহত করতে চাইলে ব্রিটিশ সৈন্যরা ফিলিস্তিনিদের কঠোর হস্তে দমন করে। ইহুদিদের পাশে সরাসরি আমেরিকা এবং ব্রিটেন থাকলেও সেই সময়ে ফিলিস্তিনিদের পাশে কোন মুসলিম রাষ্ট্র ছিল না। এই সময় ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ সেনাবাহীনীতে ভর্তি হয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পর ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি আরো জোরালো হয়। ব্রিটেন বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে যায়। জাতিসংঘ সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের অর্ধেকের চেয়ে বেশি ভূমি বহিরাগত ইহুদিদের হাতে তুলে দিয়ে ফিলিস্তিনে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একটি ফিলিস্তিন এবং অপরটি ইসরাইল। অথচ, ইহুদিরা ছিল ফিলিস্তিনের মূল ভূখন্ডের ১০ শতাংশের মালিক। অন্যদিকে ফিলিস্তিনকে এমন ভাবে ভাগ করে দেয় যে, কিছু অংশ ফিলিস্তিন আবার কিছু অংশ ইসরাইল আবার কিছু জায়গা ফিলিস্তিন এবং কিছু জায়গা ইসরাইল। অর্থাৎ ইসরাইলের অবৈধ দখলদারিত্ব ফিলিস্তিন জুড়ে ছড়িয়ে দেয় জাতিসংঘ, যাতে পরবর্তীতে ইহুদিরা সহজে ফিলিস্তিন কব্জা করতে পারে। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের ফলে আরব ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইলি ইহুদিদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই দাঙ্গায় লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ঘরবাড়ি হারিয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ইহুদিরা আরো গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ দখল করে নেয়।
১৯৪৮ সালে ১৪ মে ব্রিটেন ফিলিস্তিন ছেড়ে চলে যায় এবং ঐ দিনই ইহুদিরা ইসরাইলকে পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করে। এর পরের দিন আরবের বিভিন্ন দেশ ইসরাইলে আক্রমণ করে। অবশ্য এর পরেও আরো কয়েকবার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং আজ অবদি চলছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সংগ্রাম। কিন্তু ইসরাইলকে প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি, বরং জেরুজালেমসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান ইহুদিরা দখল করে নিয়েছে, উচ্ছেদ হয়েছে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ভিটে মাটি থেকে। বর্তমানে ফিলিস্তিনের ২১ ভাগ ভূমি রয়েছে ইসরাইলের দখলে। ইসরাইলের অগ্রযাত্রার পেছনে রয়েছে তাদের বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং ব্রিটেন-আমেরিকাসহ জাতিসংঘের কৌশলগত সহযোগিতা। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি মুসলমানগণ সফল না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো- মুসলমানদের পারস্পরিক দ›দ্ব-কলহ এবং সমন্বয়হীনতা এবং সর্বোপরি ঈমানী দুর্বলতা। অনেক মুসলিম দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের চারটি রাষ্ট্র অবৈধ ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আবার অনেক রাষ্ট্রের সখ্য রয়েছে ইসরাইলের সাথে। আর আল্লাহর বিধান হলো, যখনই মুসলমানগণ ঈমানী বলে বলিয়ান হবে, আল-আকসা তখনই তাদের হাতে আসবে। আর যখন মুসলমানগণ তাগুতের তাবেদারী করবে তখন শুধু আল-আকসা তাদের হাত ছাড়া হবে না বরং তারা হবে অপমানিত, লাঞ্চিত ও নিপীড়িত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন