শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মৌসুমি ফল খাওয়ার উপকারিতা

মো: জহিরুল আলম শাহীন | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২১, ১২:০২ এএম

আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ বলে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের জীবন বাঁচাতে এবং সুখ-শান্তিতে বসবাসের নানা খাদ্য ও উপকরণ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা প্রকৃতিতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের কল্যাণেই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, তিনি সেই স্বত্ত¡া যিনি এই পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করেছেন। (সুরা: বাকারা, আয়াত- ২৯)। আল্লাহ তার বান্দাদের উপর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যে অশেষ অনুগ্রহ এবং নেয়ামত দান করেছেন। তিনি তার বান্দাদের এমন সব নেয়ামত দিয়েছেন, যা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মানুষের জীবন জীবীকা নির্বাহের এমন একটি নেয়ামত হলো মৌসুমী ফল। ফলফলাদির মর্যাদা গৌরব ও মহত্বের নিদর্শনবাহী। মহান আল্লাহ কোরআনে এসব ফল ফলাদির কথা জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ ঘোষণা করেন, যিনি তোমাদের জন্য মাটিকে করেছেন বিছানা, আকাশকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতপর তার মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল ফলাদি, তোমাদের জন্য রিযিক স্বরূপ। (সুরা বাকারা, আয়াত-২২)। আমরা প্রতিদিন জীবীকা নির্বাহের জন্য যে ফলমূল খেয়ে থাকি তা আল্লাহর অপার দয়া এবং মায়ার দান। আমাদের জন্য এক অনুপম নেয়ামত। এসব ফলফলাদি শুধু আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য পৃথিবীতে দান করেন নাই পরকালের জন্যেও রেখেছেন। এ পৃথিবীর ইমানদার নেক বান্দাদের মৃত্যুর পর আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদান স্বরূপ রেখেছেন জান্নাত। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের জন্য রেখেছেন নানা রকমের ফলফলাদি। বেহেশতের বসবাসকারী বান্দাদের খাবারের বিবরণ দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তাতে রয়েছে ফলমূল খেজুরের গাছ, যার খেজুর আবরণ যুক্ত (সুরা আর রহমান, আয়াত-১১)। আল্লাহ আরো ঘোষণা করেছেন, সেখানে তাদের জন্য থাকবে ফলফলাদি এবং থাকবে তারা যা চাইবে তাও (সুরা ইয়াসিন, আয়াত ৫৭)। ফলাফলাদির মত উৎকৃষ্ট খাবার আর নেই এবং এর গুরুত্বেরও শেষ নেই। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ:) আল্লাহর নিকট ইমানদার বান্দাদের রিযিকের জন্য দোয়া করেছেন। তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করে বলেন, ‘যে আমার রব আপনি একে নিরাপদ নগরী বানান এবং এর অধিবাসীদের ফলমূলের রিযিক দিন, যারা আল্লাহ ও আখিরাতের দিবসে ইমান এনেছে’ (সূরা বাকারা-১২৬)। মৌসুমী ফল পুষ্টি গুণে ভরপুর, যা মানুষ ও পশুপাখিকে সুস্থ্য ও সবল রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেহে গড়ে তুলে। আমরা গভীরভাবে মনোযোগ দিয়ে আল্লাহর কুদরতের দিকে খেয়াল করলে দেখি, আমাদের চারপাশে কিছু উদ্ভিদ আছে যেগুলো বড় বড় বৃক্ষ আর কিছু উদ্ভিদ রয়েছে লতার মতো। যা মাটিতে শুয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে এসব মৌসুমী ফলফলাদি সৃষ্টি করেছেন। যা খুবই সুস্বাদু এবং মানব দেহ সুস্থ্য থাকার জন্য খাদ্যের সব উপাদান এর মধ্যে সজ্জিত করে দিয়েছেন। এসব মৌসুমী ফল শুধু মানুষই নয় অন্যান্য প্রাণীরাও ভিন্ন আকার আকৃতির ফল খেয়ে জীবীকা নির্বাহ করে। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তিনি মহান আল্লাহ তায়ালা যিনি আসমান সমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছেন তা দিয়ে আবার জমিন থেকে তোমাদের জীবীকার জন্য নানা প্রকারের ফলমূল উৎপাদন করেছেন (সুরা ইব্রাহিম-৩২)। আসলে মৌসুমী ফলফলাদির উপকারের কথা বলে শেষ করার মত নয়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে মানুষ ও পশু পাখির শরীরে রোগের প্রতিরোধ হিসেবে মৌসুমী ফলফলাদির চেয়ে বেশি কার্যকর আর কোন ঔষধ নেই। টাটকা তরতাজা ফল খেলে শরীরে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠে। শরীরে তৈরি হওয়া বিষাক্ত টক্সিন বের করে ফেলে। ফলে কোন রোগ জীবাণু সহজে আক্রান্ত করতে পারে না। কোন ফল কাঁচা, কোন ফল সাদা, কোন ফল হলুদ, কোনটা সবুজ, কোন ফল আবার কালো, এসবই আল্লাহর কুদরতে তৈরি। এগুলো সেবন করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত। আমাদের জন্য এসব চিন্তার বিষয়। এসব চিন্তার মাধ্যমে আমাদের ভিতরে তাওহীদি শক্তি বা ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায় এবং মহান আল্লাহর একাত্ততা গভীরভাবে প্রকাশ পায়। যারা এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করেন বা বুঝার জন্য মগ্ন হন তারা মহান আল্লাহ তায়ালার এমন সব কুদরতি প্রমণাদি পান যা বান্দাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার পায়ে লুটিয়ে পড়ার পথ সৃষ্টি করে এবং ঈমানকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলে। আসুন এসব ফলফলাদি পরিমাণমত গ্রহণ করি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি। নি¤েœ কয়েকটি মৌসুমী ফলের কার্যকারিতাসহ তুলে ধরা হলো।

আম ঃ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ অত্যন্ত মিষ্টি সুস্বাদু ও সুন্দর গন্ধযুক্ত এবং রসালো ফল আম। আমকে বলা হয় ফলের রাজা। আমে আছে প্রচুর পরিমাণে এ, বি, সি আয়রন, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, কপার। আমে প্রিবায়োটিক খনিজ পদার্থ ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে। আম কোলেস্টেরল হৃদরোগ, স্ট্রোকের ঝুকি কমায়, যকৃতের কার্যকরতা সবল করে। চোকের দৃষ্টি শক্তি প্রখর রাখে এবং রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। তাজা আম পটাশিয়ামের ভালো উৎস। যা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা সবল রাখে। আমে যে কপার থাকে তা রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। দেহে ক্যান্সার প্রতিরোধে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে।
কাঁঠাল ঃ এ জনপ্রিয় ফলটিতে আমিষ, শর্করা, ভিটামিন এ, বি, সি, পটাশিয়াম, আয়রণ, জিংক একটু বেশি থাকে। কাঁঠালে সব ধরণের ভিটামিন খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি একটি খাদ্য। কাঁঠালের বিচি ও সমপরিমাণে উপকারী। এতে প্রচুর ভিটামিন এ আছে। যা শিশু ও বড়দের চোখের যাবতীয় রোগ এবং চোখে ছানি পড়া রোগ প্রতিরোধ করে। কাঁঠাল উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এর উচ্চ ক্ষমতার এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ ও হজম শক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে। কাঁঠালের বিটা ক্যারোটিন, লুটেইন উপাদান যা প্রোস্টেট, স্তন, পাকস্থলী ও ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। কাঁঠলের জিঙ্ক দেহের পরিমাণমত ইনসুলিন তৈরি করে।

লিচু ঃ লিচুতে ভিটামিন সি, বি কমপ্লেক্স ও খনিজ পদার্থ যেমন পটাশিয়া, ম্যাগনেসিয়াম, কপার, আয়রণ ফলিক এসিড পাওয়া যায়। এগুলো দেহে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রবল রাখতে ভূমিকা রাখে। দেহে যেকোনো টিউমার কোষ তৈরিতে বাধা দেয়। শরীরে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না, চামড়ার টান টান ভাব রক্ষা করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। চুলের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে, মুখের রুচি বৃদ্ধি করে।

জাম ঃ জাম দেখতে কালো কিন্তু গুণে খুবই ভালো। জামে ভিটামিন এ, বি, সি, আঁশ, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম থাকে, যা আমাদের দেহকে নানা রোগের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখে। এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। হাঁড়, দাঁত সুস্থ্য রাখে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। দেহে রক্ত তৈরি করে, মুখে রুচি বৃদ্ধি করে। স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি করে। জামের বিচি সেবনে ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে রাখে। গর্ভবতী মহিলা ও শিশুর জন্য জাম বেশ উপকারী। মুখের দুর্গন্ধ দুর করে দাঁত মজবুত, মাড়ি শক্ত ও দাঁতের ক্ষয়রোধ প্রতিরোধে জাম খুবই ভালো একটি ফল।

জামরুল ঃ হালকা মিষ্টি রসালো ফল। এতে ভিটামিন এ, বি, সি, প্রোটিন, আয়রণ ও খনিজ লবণ সমৃদ্ধ ফল। এতে প্রচুর পরিমাণে পানি থাকায় ডায়াবেটিস রোগীদের পানির পিপাসা নিবারণে বেশ উপকারী। লিভার ও কিডনী পরিস্কার করে সুস্থ্য রাখে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গর্ভবতী মহিলাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে জামরুল। চুল, দাঁত ও হাঁড়ের জন্য বেশ উপকারী এ ফল। হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। ডায়াবেটিস রোগের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, দেহ থেকে বিষাক্ত উপাদান বের করে দেয়। জামরুল মস্তিষ্ক এবং লিভারের জন্য খুবই উপকারী একটি ফল। চোখের নিচে কালো ভাব বা দাগ দূর করতে সাহায্য করে এ ফলটি।

আনারস ঃ মধুর রসে টুইটুম্বর সুমিষ্ট গন্ধ ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ আনারস অতুলনীয়। আনারসে প্রচুর পরিমাণে এ, বি, সি পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ও ফলেট থাকে। এতে প্রচুর খাদ্য শক্তি ও আঁশ আছে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। দেহ থেকে মল বের হতে সাহায্য করে। আনারসে প্রচুর ভিটামিন সি পাওয়া যায় যা সর্দি-কাশি ও রক্ত সঞ্চালনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আনারস স্তন, জরায়ু, কোলন ও চামড়ার ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে। দেহের হাঁড় ও জোজক কলাগুলোকে শক্তিশালী করে এবং দেহে শক্তি উৎপন্ন করে। দেহকে কৃমি মুক্ত রাখতে আনারাস সাহায্য করে। পিত্ততলী ও কিডনীর পাথর হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে দেয়। দেহের জ্বর নিবারণে আনারস প্রাকৃতিক ঔষধ হিসেবে কাজ করে।
লেখক: শিক্ষক ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কলাম লেখক।

 

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন