বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

বানারীপাড়ায় ঐশি ট্র্যাজেডি একসঙ্গে জন্ম আর একসঙ্গে চিরবিদায়

প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এস মিজানুল ইসলাম, বানারীপাড়া (বরিশাল) থেকে

রাব্বি ও শান্তা। বয়স ৮। জমজ ভাইবোন। ওরা ছিল জন্ম প্রতিবন্ধী। ওদের সবকিছুই ছিল একসঙ্গে। খাওয়া, ঘুমানো, খেলা পর্যন্ত। মায়ের চোখের আড়াল হয়নি ক্ষণিকের জন্যও। ওদের স্বাভাবিক জীবন গতি স্তব্ধ হলো গত ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার। বরিশালে বানারীপাড়ায় লঞ্চ দুর্ঘটনা তাদের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। একসঙ্গে জন্মেছিল ওরা, আবার একসঙ্গেই চলে গেল। ওদের এমন চলে যাওয়া মানছে না কেউ। শুধু মা-বাবা নন, আত্মীয়-স্বজন থেকে প্রতিবেশীদের মধ্যেও চলছে শোকের মাতম। রাব্বি ও শান্তার বাবা সিদ্দিকুর রহমান মোল্লা। সিলেট জজ কোর্টের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। মা রোকসানা বেগম গৃহিণী। লঞ্চ দুর্ঘটনায় মা-বাবা প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের জমজ সন্তানদের কেড়ে নিয়েছে সন্ধ্যা নদী। সিদ্দিকুর রহমান দম্পতি ডুবে যাওয়া লঞ্চের জানালা দিয়ে বেড়িয়ে ভেসে উঠতে পেরেছিলেন। কিন্তু সন্তানদের বাঁচাতে পারেননি। নিজেদের সে ব্যর্থতায় সন্ধ্যার তীরে তাঁরা আহাজারি করতে করতে সন্তানদের খুঁজতে থাকেন। দুর্ঘটনার দিন বুধবার সন্ধ্যায় কন্যা শান্তার লাশ পান। আর ছেলে রাব্বির লাশ পাওয়া যায় গত ২২ সেপ্টেম্বর সকালে লঞ্চ উদ্ধরের সময়। রাব্বির লাশ লঞ্চের সঙ্গে লেপটে ছিল। পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায়। বানারীপাড়ার পার্শ্ববর্তী উপজেলা উজিরপুরের ওটরা ইউনিয়নের মশাং গ্রামের বাড়িতে। লাশবাহী নৌকায় বাবা সিদ্দিকুর রহমান বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘লঞ্চের নিচতলার ইঞ্জিনের পাশেই আমরা ছিলাম। লঞ্চটি যখন দাসেরহাটে পৌঁছল তখন শান্তা ওর মায়ের কোলে ঘুমাচ্ছিল। রাব্বি আমার হাত ধরে বসা ছিল। হঠাৎ লঞ্চটি কাত হয়ে ডুবে যেতে থাকে। আমি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বেশ কয়েকবার দোয়া-কালাম পড়ি। একইভাবে আমার স্ত্রী শান্তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই লঞ্চটি চরকির মতো সাত-আটবার পাক খায়। এ সময় ছেলে আমার হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। ঘটনার কিছু সময় পরে জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে একইভাবে আমার স্ত্রীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে। এ ঘটনার প্রায় চার ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা সন্ধ্যা নদীতে ডুুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ১১টি লাশের সাথে মেয়ে শান্তার লাশ উদ্ধার করে। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধারকারী জাহার নির্ভীক ডুবন্ত লঞ্চটি উদ্ধার করে। তখন লঞ্চে রাব্বির মৃতদেহ পাওয়া যায়। লাশটি মশাং গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তখন মা-বাবা লাশ কোলো নিয়ে বিলাপ করে আর বারবার মূর্ছা যান। মা রোকসানা বেগম বিলাপ করে বলেন, ‘মাইয়াডা মোর কোলেই ঘুমাইছিল। হেই গুম আর বাঙে নায়। সন্ধ্যা নদী মোর বুকের ধন নিয়া গ্যাছে। তোরা মোর দুই সন্তানের লাশ দ্যাখতে আইছো। আল্লাহ ওদের বাঁচাইয়া আমায় নিয়া গ্যালা না ক্যান। মুই অ্যাহোন কী নিয়া বাঁচমু। মোরে এ কোন শাস্তি দেলা।’ মা রোকসানাকে সান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা ছিল না স্বজনদের। বৃস্পতিবার রাব্বি ও শান্তার দাফনের পর মা-বাবা কবরের পাশে বিলাপ করছিলেন। শোকে আক্রান্ত ছিল পুরো গ্রাম। রাব্বি-শান্তার দাদা আয়নাল হক মোল্লা। দুটি লাশ বহন করে নিয়েছিলেন বাড়িতে। তিনি বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল ওরা। শারীরিক প্রতিবন্ধিতা দূর করতে মঙ্গলবার নেছারাবাদের (স্বরূপকাঠি) শার্ষীনার কাছে সন্ধ্যা নদীতে ভ্রাম্যমাণ ভাসমান হাসপাতাল জীবনতরীতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। ওইদিন ওরা স্বরূপকাঠিতে এক খালার বাসায় ছিল। বুধবার সেখান থেকে বানারীপাড়া হয়ে লঞ্চযোগে গ্রামের বাড়ি ফিরছিল। ফিরতে গিয়েই দুর্ঘটনার কবলে পরে দুটি অবুঝ শিশু চলে গেল পৃথিবী থেকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন