চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের বিপরীতে মেঘনা নদীতে নতুন করে চর ভেসে ওঠায় নদীর মোহনা সংকুচিত হয়ে গেছে। উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহে শহররক্ষা বাঁধে আঘাত হানছে। প্রায় তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে চর শীত মৌসুমে ভেসে থাকলেও বর্ষায় ডুবে যায়। আর এই চরই এখন শহররক্ষা বাঁধের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, শহর রক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে দ্রুত চর খননের পাশাপাশি বাঁধের স্থায়ী সংস্কার জরুরি। তা না হলে চাঁদপুর শহর মেঘনায় তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
গত ২/৩ বছর আগে চাঁদপুর শহররক্ষা বাঁধের মোলহেডের সামনে মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা চর দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে দর্শনার্থীদের কাছে। পরিচিতি পায় ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে। নদীর সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি শীতের সময়ে চাঁদপুরসহ আশপাশের জেলা থেকে অনেকে এ চরে বেড়াতে যান।
মাঝ নদীতে চর জেগে ওঠায় সংকুচিত হয়ে গেছে মেঘনা। বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহে দেখা দেয় সমস্যা। ডুবোচরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পানির চাপ দেয় শহররক্ষা বাঁধে। এর ফলে বাঁধ এলাকায় গভীর থেকে আরও গভীর হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ঘূর্ণিস্রোত ও ঢেউ। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে চাঁদপুর শহর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধীরে ধীরে চর বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি বাঁধ এলাকায় বাড়ছে মেঘনা নদীর গভীরতা। বাঁধ এলাকায় মেঘনা নদীর গভীরতা সর্বোচ্চ ৫৭ মিটার পর্যন্ত। শিগগির মেঘনার বুকে নতুন করে জেগে ওঠা চর পরিকল্পিতভাবে খননের পাশাপাশি শহররক্ষা বাঁধের স্থায়ী সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে ভাঙনের কবলে পড়তে পারে চাঁদপুর শহর।
পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়ার অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল চাঁদপুর জেলা। এক সময় চাঁদপুরের দুঃখ বলা হতো মেঘনাকে। মেঘনার করাল গ্রাসে দিশেহার ছিল জেলাবাসী। নদীর ভাঙনে জমিজমা, বসত ভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক মানুষ। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নদী ভাঙনরোধে নির্মাণ করা হয় শহররক্ষা বাঁধ। পরে ভাঙনের মুখে এ বাঁধ তেমন স্থায়ী হয়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, চাঁদপুর শহর ভাঙনরোধে ১৯৭২ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ১৪০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন বাজার এলাকায় ১৭৩০ মিটার শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পরে ২০০৯-২০১০ সালে আরও প্রায় ২৪ কোটি ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে পুরান বাজার এলাকার ১৬৩০ মিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকেই বদলাতে থাকে ভাঙনের চিত্র। চাঁদপুরের মানুষ ফিরে পায় স্বস্তি। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের পর দীর্ঘ সময় পার হলেও তা রক্ষায় নেয়া হয়নি কোন স্থায়ী উদ্যোগ।
স্থানীয় লোকজন জানান, প্রতি বছর বর্ষায় মেঘনা নদীতে ভাঙন দেখা দিলে ভাঙনরোধে গ্রহণ করা হয় অস্থায়ী ব্যবস্থা। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও বাঁধ রক্ষায় আসেনি স্থায়ী সমাধান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, গত ২০১৯ ও ২০২০ সালে চাঁদপুর শহরের পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় একাধিকবার ভাঙনের শিকার হয়েছে শহররক্ষা বাঁধ। এতে ৬৭ মিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। বাঁধ রক্ষায় অস্থায়ীভাবে কাজ হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ সালে ৫৮ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয় ২৮ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ সালে ৪৮৫ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয় ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ২০১৯-২০ সালে ৩২৪ মিটার সংস্কার কাজে ব্যয় হয় ১ কোটি ১১ লাখ টাকা। পুরান বাজার শহররক্ষা বাঁধ এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত ২০১৯ সাল থেকে ভাঙনে অন্তত শতাধিক মানুষ হারিয়েছেন তাদের বাসস্থান। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই মেঘনায় বিলীন হবে এ বাঁধ।
চাঁদপুর চেম্বারের পরিচালক গোপাল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই পুরানবাজার ঐতিহ্যবাহী একটি বাজার। বিভিন্ন সময়ে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বাজার অনেকটাই এখন বিলুপ্তির পথে। ভাঙনরোধে অচিরেই শহররক্ষা বাঁধের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।’
চাঁদপুর সরকারি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, শহররক্ষা বাঁধের মোলহেডের উল্টোদিকে মেঘনার মধ্যখানে চর জেগে ওঠায় নদী সংকুচিত হয়ে গেছে। এর উত্তর পাশে নদীর প্রশস্ততা অনেক। এতে বর্ষায় পানির চাপ বেড়ে পাড়ে ঘূর্ণি স্রোতের সৃষ্টি হয়ে ভাঙন দেখা দেয়। চরটি পরিকল্পিত খননের পাশাপাশি শহররক্ষা বাঁধ স্থায়ীভাবে সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে চাঁদপুর শহর বড় ধরনের ভাঙনের মুখোমুখি হতে পারে।
চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রেফাত জামিল বলেন, ২০০৯-২০১০ সালের পর বাঁধের স্থায়ী সংস্কার কাজ হয়নি। পরে বাপাউবো গঠিত কারিগরী কমিটির অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ৪২০ কোটি টাকার একটি স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্প তৈরি করে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মার্চই মন্ত্রণালয়ে যাচাই কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, তিন নদীর সংযোগে চাঁদপুর শহরের হাইড্রো-মরফোলজিক্যাল অবস্থা পর্যালোচনা করে বিস্তারিত সমীক্ষার প্রস্তাব পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তিনি বলেন, গত বছর ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান, আইডব্লিউএমের প্রিন্সিপাল সারওয়াত জাহানসহ বিভিন্ন দপ্তরের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়। কমিটি একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের আলোকে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিন হাজার ১০৩ কোটি ২ লাখ টাকার চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ পুনর্বাসন প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ে যাচাই কমিটি চলতি বছরের ৪ মার্চ আবার সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে প্রকল্পের পরিধি এবং কারিগরি বিষয় চূড়ান্ত করার পরামর্শ দেয়। সব কাজ শেষ করে আবারও তা ২ জুন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রেফাত জামিল বলেন, শহররক্ষা বাঁধ টিকিয়ে রাখতে হলে জরুরি ভত্তিতে নদীর মাঝে জেগে ওঠা চর খনন করে মেঘনার গতিপথ ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি শহর রক্ষা বাঁধের স্থায়ী সংস্কার প্রয়োজন। তা না হলে শহররক্ষা বাঁধ বিলীন হয়ে চাঁদপুর শহর তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন