শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

পরীক্ষায় অসদুপায় হারাম

প্রকাশের সময় : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ : গত ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হলো এসএসসি পরীক্ষা। দেশে এ পরীক্ষাই সর্ববৃহৎ পাবলিক পরীক্ষা। উচ্চশিক্ষিত আগামী প্রজন্ম গঠনে এসএসসি পরীক্ষা এক বিরাট মাইলফলক। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জীবনেও এ পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
এই নিয়ে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানান, এবার মোট ১৬ লাখ ৫১ হাজার ৫২৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৮ লাখ ৪২ হাজার ৯৩৩ জন ছাত্র এবং ৮ লাখ ৮ হাজার ৫৯০ জন ছাত্রী। আটটি সাধারণ বোর্ডের অধীনে এসএসসিতে ১৩ লাখ ৪ হাজার ২৭৪ জন, মাদরাসা বোর্ডের অধীনে দাখিলে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৬৫ জন এবং কারিগরি বোর্ডের অধীনে এসএসসি ভোকেশনালে ৯৮ হাজার ৩৮৪ জন পরীক্ষার্থী রয়েছেন। একজন শিক্ষক হিসেবে সবার সুস্থতা ও প্রস্তুতি অনুযায়ী সাফল্য কামনা করে সবার জন্য আমার নিচের নিবেদন। আশা করি লেখাটি সবার উপকারে আসবে।
মানুষের জীবন আসলে কতগুলো পরীক্ষার সমষ্টি মাত্র। আবার জীবনের সব মুহূর্ত শেখার এবং সবদিনই পরীক্ষার জন্য। বলা হয় ‘ছাত্র জীবন মধুর জীবন যদি না থাকে এক্সামিনেশন’! কিন্তু ঈমানদার হিসেবে ভাবা উচিত, দুনিয়ার পরীক্ষায় ফেল করলেও ফের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকে, অথচ আল্লাহর পরীক্ষায় ফেল করলে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার উপায় নেই। তাই স্মরণে রাখতে হবে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন যেন আমাদের জন্য হারাম জীবিকার বাহন না হয়। কারণ, দুনিয়ার যোগ্যতার প্রায় সব কিছুই নির্ভর করে মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতায়।
‘পরীক্ষা’ শব্দের আরবি সমার্থক হলো ইম্তিহানুন, ইখ্তিবারুন, তাজ্রিবাতুন, ইব্তিলাউন ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন আঙ্গিকে ‘পরীক্ষা’ শব্দটি ব্যবহৃত। সুরা বাকারা ১২৪ নম্বর আয়াতে আছে “স্মরণ করো যখন ইব্রাহিমকে তার রব কতিপয় বিষয়ে (আনুগত্যের) পরীক্ষা নিলেন...”। ইব্রাহিম (আ.) ‘খলিলুল্লাহ্’ বা আল্লাহ্র বন্ধু। মহান আল্লাহ্ তাঁকে অসংখ্যবার পরীক্ষা করেছেন। সুরা তওবা, আহযাব, মু’মিনে ইব্রাহিমকে (আ.) ত্রিশটি পরীক্ষার বিবরণ পাওয়া যায় (তাফসিরে রুহুল মা’নি, ১/৪৯৩)। সুরা বাকারা ১৫৫ নম্বর আয়াতে আছে “আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো ভয়, ক্ষুধা, সম্পদহানী, প্রাণহানী, শস্যহানী দ্বারা...”। তিনি আরো বলেন “আল্লাহ্কে ভয় করো এবং ভেবে দেখো আগামীর জন্য কী সঞ্চয় করেছো... ?” (হাশর: ১৮)
অনুমান, পর্যবেক্ষণ এবং প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত উপলব্ধির নাম ‘জ্ঞান’। ইতর প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পার্থক্যের মূল ভিত্তি জ্ঞান। মহান আল্লাহ্র প্রথম নির্দেশ “পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন...” (আলাক : ০১) এবং শিক্ষার গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনিই বলেন, “তিনি মানুষকে তাই শিখিয়েছেনÑ যা সে জানতো না” (আলাক : ০৫)। প্রিয়নবী (স.) বলেন, “দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানান্বেষণ কর”। অন্যদিকে মানুষের জ্ঞানগত যোগ্যতা পরিমিত হয় প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন পরীক্ষায়। মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গির সমষ্টি যোগ্যতার ভিত্তিতে তৈরি হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তথা ‘রিয্ক’ বা জীবিকার ব্যবস্থা। তাই হালাল জীবিকার সঙ্গে বৈধ পন্থায় যোগ্যতা অর্জনের সম্পর্ক সুনিবিড়।
মনে রাখতে হবে, মানুষের দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে সে পরীক্ষিত হয়ে, প্রশিক্ষিত হয়ে, পরিশীলিত হয়েই আখিরাতের জীবনে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহ মানুষকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন “জেনে রাখ, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক সংঘাত ও ধনেজনে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়...” (হাদিদ : ২০)। তাই যেনতেন উপায়ে পরীক্ষায় পাস করা ঈমানদারের উদ্দেশ্য হতে পারে না। নকল করা, দেখাদেখি করা, ফেসবুক, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং সেন্টারের অসৎ বাণিজ্যিক কৌশল, তথাকথিত ১০০% কমন সাজেশনের মোহে গা ভাসিয়ে দেওয়া ঈমানদারের জন্য অশোভনীয়ই নয় বরং হারাম। আমাদের আগামী প্রজন্ম তথা জাতি ধ্বংসকারী অপতৎপরতা রোধে শিক্ষক, অভিভাবক ও সচেতন নাগরিক সমাজকে সোচ্ছার ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই পরীক্ষায় অনৈকিতা প্রতিরোধ সম্ভব।
সবার ‘রিযিকদাতা’ মহান আল্লাহ্ মানুষের জন্য ব্যবস্থা করেছেন ‘রিজ্কান কারিমা’ (সম্মানজনক জীবিকা) এবং তা অর্জনের কৌশল হতে হবে ‘হালালান তাইয়্যেবা’ (বৈধ ও পবিত্র)। কিন্তু যথাযথ যোগ্যতা অর্জন না করে ভুয়া কৌশলে যোগ্যতা অর্জন বা চাকরি লাভ করলে ঐ ‘রিযক’ কি হালাল থাকে? পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার অপকৌশল নিছক প্রতারণা এবং প্রতারণার মাধ্যমে আয় প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ বলেন, “বিনাস ও বিপর্যয় ধোঁকাবাজদের জন্য...” (মুতাফ্ফিফিন : ০১)। প্রিয়নবী (স.) সতর্ক করে বলেন, “যে দেহ হারামে গঠিত-পরিপুষ্ট তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না...” (বাইহাকি)। মুসলিম শরিফের একটি দীর্ঘ হাদিসে আছে “এক মুসাফির আকাশের দিকে হাত তুলে ডাকছে : হে প্রভু! হে প্রভু... অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম, সে হারামের মধ্যে সবসময় অতিবাহিত করে। তবে তার দোয়া কিভাবে কবুল করা হবে”?
বস্তুত মনুষ্যত্বের সুস্পষ্ট অনুপস্থিতির কারণেই মানুষ অনৈতিকতার পথে হাঁটে। তাই কবি বলেন, “ধর্মকথা প্রেমেরবাণী জানি উচ্চ মহান খুব/ কিন্তু সাপের দাঁত না ভেঙ্গে মন্ত্র ঝাড়ে কোন বেকুব”। পরিশেষে বলবো: আল্লাহই একমাত্র ভরসা এবং মুমিনের আশ্রয়। পরীক্ষার সবকিছুকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শেষদিন, শেষ পরীক্ষার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সব অবহেলা, হতাশা, উত্তেজনা, মান-অভিমান এবং অবশ্যই সব অসদুপায় ও অসৎ চিন্তা পরিহার করতে হবে। আল্লাহর দয়া, পিতা-মাতা, শিক্ষক-গুরুজনের দোয়ায় সবার সুস্থতা ও প্রস্তুতি অনুযায়ী সাফল্য কামনা করি। আমিন।
ষ লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন